রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বগুড়ার আবাসন ব্যবসায় ধস
দেশে চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে রিয়েল এস্টেট (আবাসন খাত) ব্যবসায়ের জন্য সুপরিচিত ও সমৃদ্ধ বগুড়া এখন অনেকটাই মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে নতুন সম্পদে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ পাচ্ছেন না গ্রাহকরা।
বগুড়া রিয়েল এস্টেট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সাইরুল ইসলাম জানান, "তিন বছর আগে করোনার মধ্যে যুদ্ধ করে ব্যবসায় টিকে থাকতে হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে যাচ্ছে। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আবাসন ব্যবসায় ধস নেমেছে।"
"আমাদের ব্যবসার উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। যেমন— টাইলস, রড, সিমেন্ট, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ইত্যাদি। আমাদের ব্যবসায় অস্থিতিশীলতা আসায় তাদের ব্যবসাও ক্ষতির মুখে পড়েছে। কারণ তারা আমাদের ব্যবসার উপর অনেকটা নির্ভরশীল। এ কারণে অর্থনীতির বৃহৎ একটি অংশ কিছুটা স্থবির হয়ে আছে। এই পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া খুব জরুরি," যোগ করেন তিনি।
বগুড়ায় তরুণ উদ্যোক্তা ও প্রকৌশলী জুনায়েদ মিশারা বলেন, "এখন সেপ্টেম্বর মাস চলে। নতুন ভবনের নির্মাণের পুরো মৌসুম। কিন্তু ভবন নির্মাণ নিয়ে মানুষের আগ্রহ নেই। গত বছরের তুলনায় অর্ধেকও হয়নি এবার। বগুড়ার সার্বিক চিত্রই এমন।"
"চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা আর অর্থনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতিতে বগুড়ায় আবাসন খাতে ঝুঁকি নিতে সাহস পাচ্ছে না মানুষ," বলেন তিনি।
জুনায়েদ মিশারা বগুড়ায় গত ৫ বছর ধরে মাহির ইঞ্জিনিয়ারিং নামের প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গত পাঁচ বছরে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তি ও বাণিজ্যিক ভবনের নকশা এবং নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন।
বগুড়া রিয়েল এস্টেট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জানান, আবাসন খাতে গুরুত্বের বিবেচনায় দেশের মধ্যে চার নম্বর অবস্থানে রয়েছে বগুড়া। ঢাকার পরের অবস্থান বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রামের। তৃতীয় স্থানে ব্যবসায়ীকভাবে শক্ত খুঁটি তৈরি করতে পেরেছে 'লন্ডনখ্যাত' সিলেট। এরপরেই রয়েছে বগুড়া।
প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসা শুরুর ২৫ বছরের মধ্যে দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহরকে পেছনে ফেলে বগুড়ার আবাসন খাত ঊর্ধ্বমুখী গতিতেই ছিল। কিন্তু বড় ধাক্কা লাগে মহামারি করোনভাইরাসের সময়ে। এরপর রাজনৈতিক বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে উঠে দাঁড়াতে গেলে আরেকবার পা পিছলে পড়ে যায় বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে।
বগুড়ায় যেভাবে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা শুরু
বগুড়ার আবাসন ব্যবসায়ীরা জানান, ১৯৯৯ সালে বগুড়ার বিখ্যাত ব্যবসায়ী ময়েজ মিয়ার হাত ধরে শুরু হয় আবাসন ব্যবসা।
তিনি শহরের সরকারি আজিজুল হক কলেজ এলাকায় রেডিলাইট নামের একটি ভবন নির্মাণের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেন। এরপর দু'একজন এই ব্যবসার দিকে ঝুঁকে যান। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের 'প্রাণ কেন্দ্র' হলো বগুড়া। কৃষি, শিল্প যন্ত্রাংশ নির্মাণ কারখানা, খাদ্য পণ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়ায়াজাতকরণ এবং উৎপাদিত পণ্য দেশের বাহিরে রপ্তানিতে দেশের মধ্যে অন্যতম হলো বগুড়া জেলা। এ কারণেই এখানে মানুষের বসবাসের চাহিদা ব্যাপক। আর এ বিষয়টি মাথায় রেখেই বগুড়ায় আবাসন ব্যবসার প্রসার ঘটতে থাকে।
বগুড়া রিয়েল এস্টেট অ্যাসোসিয়েশন জানায়, বগুড়ায় অন্তত ৬০ জন ব্যবসায়ী আবাসন খাতেন সঙ্গে যুক্ত। তবে সংগঠনের সদস্য এখন ৪৩ জন। সব ব্যবসায়ী মিলে বগুড়ায় অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন।
এছাড়া, বগুড়ায় আবাসন খাতে অন্তত এক হাজার শ্রমিক কাজ করেন। বর্তমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অস্থিরতার ছাপ পড়েছে শ্রমিকদের জীবনেও।
সংগঠনটির নেতার জানান, আয়তনের দিক থেকে বগুড়া নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশের চেয়েও বড়। ৬৯ দশমিক ৫৬ বর্গকিলোমিটারের এই পৌরসভায় পাঁচ লাখের বেশি মানুষের বসবাস। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মেডিকেল কলেজ, আড়াই হাজার বছরের পুরোনো মহাস্থানগড়ের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বগুড়াকে আরও উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
এ কারণে এ শহরে বসবাসের চাহিদা এর আশপাশের অন্য জেলাগুলোর চেয়ে বেশি। বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার বনানী এলাকা থেকে সদরের মাটিডালি পর্যন্ত প্রায় ৬ কিলোমিটারের মধ্যে বেশি বেশি বহুতল ভবন গড়ে উঠছে বলে জানান তারা।
ট্রপিক্যাল বিল্ডিং টেকনোলজিস লিমিটেডের মালিক আনোয়ারুল করিম দুলাল বলেন, "গত কয়েক বছর ধরেই ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। শুরুতে বড় ধাক্কা দিল করোনা। এখন আবার রাজনৈতিক পরিস্থিতি। মানুষ এখন ভয়ে পকেট থেকে টাকা বের করতে চাচ্ছে না।"
তিনি বলেন, "গত পাঁচ মাস ধরে আমাদের ব্যবসা প্রায় বন্ধ। বলতে গেলে এখন আমাদের পকেটে ভাত খাওয়ার টাকা নেই। খুবই বাজে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে দিন যাচ্ছে। কারও সাথে কিছু শেয়ারও করা যাচ্ছে না।"
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বগুড়ার আবাসন ব্যবসায়ীরা দেশের জিডিপির ক্ষেত্রেও অবদান রাখেন। গত কয়েক বছরে বগুড়ায় কাজ শেখার পর ১৫০ থেকে ২০০ জন শ্রমিক ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। কিন্তু প্রতিনিয়ত সংকটের মুখে পড়লে মুখ থুবরে পড়বে এই খাত। অথচ এই খাতে বগুড়ায় ব্যবসায়ীরা অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকা লগ্নি করেছেন বলে জানান তারা। ফলে এই সংকটের সময় ব্যবসা না হওয়ার কারণে ব্যাংকের লোন বাড়ছে।
আবাসন খাতে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা উল্লেখ করে আনোয়ারুল করিম দুলাল আরও বলেন, "আমরা এখন অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। ব্যাংক থেকে ঋণ দিয়ে ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছি। কিন্তু ব্যাংকের কিস্তি নিয়মিত শোধ করতে পারছি না। বলতে গেলে আমরা এখন দেউলিয়ার পর্যায়ে যাচ্ছি।"
কয়েক বছর ধরে সুনামের সাথে বগুড়ায় আবাসন খাতে ব্যবসা করে যাচ্ছেন রুপকথা হোমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজেদুর রহমান রাজু। তিনি বলেন, গত তিন থেকে চার মাস ধরে কোনো বেচাকেনা নেই। হঠাৎ করেই এই পরিস্থিতি শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, " এখন কেউ টাকা ইনভেস্ট করতে চাচ্ছে না। দেশের ব্যাংকগুলোর অবস্থাও খুব একটা ভালো না। অনেকে ঋণ পাচ্ছেন না। তবে এরপরও আমরা আশাবাদী, দেশের অর্থনীতি সচল হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।"
আবাসন খাতের সংকটের কারণে সিরামিক ব্যবসায়ও ব্যাপক প্রভাব পড়েছে বলে জানান এক্স সিরামিক গ্রুপের রংপুর বিভাগীয় করপোরেট অ্যান্ড সেলস সেক্টর নির্বাহী ওবায়দুল হক সাব্বির।
এই কর্মকর্তা জানান, "গত কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নড়বড়ে পরিস্থিতির কারণে আমাদের টাইলস ব্যবসা অন্তত ৫০ শতাংশ কমে গেছে। শুধু আমাদের না দেশের সবার অবস্থা একই।"