হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিতে নকল সিগারেটের ব্যান্ড-রোল পাচার
চীন থেকে আমদানি হওয়া এ-ফোর সাইজের অফসেট পেপারের দুটি চালানে গত ডিসেম্বরে নকল সিগারেটের ব্যান্ড-রোল উদ্ধার করেছিল চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। চট্টগ্রামের আমদানিকারক বাপ্পু এন্টারপ্রাইজ এবং আরাফাত এন্টারপ্রাইজের চালান দুটিতে উদ্ধার হওয়া ব্যান্ড রোল বাজারজাত হলে ২৩০ কোটি টাকা রাজস্ব হারাতো সরকার।
চালান দুটি আটকের পর কাস্টমসের অনুসন্ধানে উঠে আসে চক্রটি এ ধরনের ১৩টি চালান খালাস করেছে। এসব চালানে অন্তত এক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির আশঙ্কা করছে কাস্টমস কর্মকর্তারা। চীনের রপ্তানিকারক ডিজি অ্যান্টি-ফেক (শেনজেন) কোম্পানি লিমিটেড থেকে আসে এসব পণ্য।
চট্টগ্রামের দুটি আমদানিকারক চীনের একই প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য আমদানি, পণ্য খালাসে নিয়োজিত একমাত্র সিএন্ডএফ এজেন্ট মধুমতি এসোসিয়েটস লিমিটেড এবং চালান আটকের পর চীনের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের এআইআর শাখার ডেপুটি কমিশনার শরফুদ্দিন ভূঁইয়া টিবিএসকে বলেন, "নকল ব্যান্ড রোল আমদানির মাধ্যমে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে বলে মনে আমরা সন্দেহ করছি। খালাস হওয়া এসব ব্যান্ডরোল বর্তমানে বাজারজাত হওয়া সিগারেটের প্যাকেটে অথবা আমদানিকারক, সিগারেটের ডিলারদের কাছে থাকতে পারে।"
নকল ব্যান্ডরোল আটকের ঘটনায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস গত ১৬ ডিসেম্বর বাপ্পু এন্টারপ্রাইজ এবং ২৩ ডিসেম্বর আরাফাত এন্টারপ্রাইজের বিরুদ্ধে নগরের বন্দর থানায় দুটি পৃথক মামলা দায়ের করে। একই সঙ্গে মামলা দুটি পিবিআই, সিআইডি এবং র্যাবের মাধ্যমে তদন্ত করতে স্বরাষ্ট্র সচিব, মহা পুলিশ পরিদর্শককে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে সুপারিশের অনুরোধ জনিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্র জানায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এস.আর.ও অনুযায়ী স্ট্যাম্প বা ব্যান্ডরোল দি সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (এসপিসিএল) হতে সংগ্রহ করতে হয়। ফলে এই জাতীয় পণ্য এসপিসিএল ছাড়া অন্য কোন প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রয় অথবা বিদেশ থেকে আমদানি করার কোন সুযোগ নেই।
এদিকে গত ৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে একটি চিঠি দিয়েছেন। এতে উল্লেখ করা হয়, মাঠ পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট জেলার ডিলার, খুচরা বিক্রেতা এবং সন্দেহজনক প্রতিষ্ঠানের গোডাউন থেকে নমুনা সংগ্রহ করে যাচাই করা প্রয়োজন। আমদানি হওয়া নকল ব্যান্ড রোলের স্টক শেষ হওয়ার আগেই সংশ্লিষ্ট জেলার ডিলার, খুচরা বিক্রেতা এবং সন্দেহজনক প্রতিষ্ঠানের গোডাউন হতে অবিলম্বে সন্দেহজনক নমুনা সংগ্রহ করে তা দি সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন (বাংলাদেশ) লিমিটেড (এসপিসিএল) থেকে পরীক্ষা করালে স্ট্যাম্প জালিয়াতির সাথে কোন প্রতিষ্ঠান জড়িত তা উদ্ধার করা সম্ভব হবে।
এছাড়া জালিয়াতি প্রতিরোধে করণীয় নির্ধারণে ভ্যাট গোয়েন্দা, কাস্টমস গোয়েন্দা ও ভ্যাট কমিশনারেটসমূহের সমন্বয়ে উল্লেখিত বিষয়টি পর্যালোচনা করা প্রয়োজন বলে ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। এর পাশাপাশি মানি লন্ডারিং বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং বাংলাদেশ ব্যাংক যৌথভাবে তদন্ত করতে পারে।
এই ঘটনায় নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের (মূল্য সংযোজন কর) যুগ্মপরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল ইসলামের নেতৃত্বে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন উপ-পরিচালক মুনাওয়ার মুরসালীন, সহকারী পরিচালক আলমগীর হুসেন, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মাশরেকী ইলিয়া কাজান এবং আব্দুল আউয়াল। ইতোমধ্যে দুই প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে।
ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মুনাওয়ার মুরসালীন বলেন, "নকল ব্যান্ড রোল আমদানির বিষয়টি নিয়ে আমরা তদন্ত করছি। এই চক্রের সাথে আর কোন কোন প্রতিষ্ঠান জড়িত রয়েছে তা খুঁজে বের করা হবে।"
চট্টগ্রাম নগরীর বন্দর থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ জাহেদুল কবির বলেন, নকল ব্যান্ড রোল উদ্ধারের ঘটনায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের দায়ের করা মামলা দুটি সিআইডি তদন্ত করছে।
ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট- সিআইডি চট্টগ্রাম মেট্রোর পুলিশ সুপার (এসপি) শাহনেওয়াজ খালেদ বলেন, "সিআইডি মামলা দুটির তদন্তভার গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন ডকুমেন্ট সংগ্রহ করা হচ্ছে। এই ঘটনার সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।"
ব্যান্ড রোল আমদানি করা প্রতিষ্ঠান 'অস্তিত্বহীন'
ব্যান্ড রোল আমদানি করা প্রতিষ্ঠান বাপ্পু এন্টারপ্রাইজের প্রাতিষ্ঠানিক ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে চট্টগ্রাম নগরীর আন্দরকিল্লার জিএ ভবনে। তবে জিএ ভবনে বাপ্পু এন্টারপ্রাইজ নামে কোন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব মেলেনি।
জিএ ভবন ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, এ ভবনে বাপ্পু এন্টারপ্রাইজ নামের কোনো প্রতিষ্ঠানই নেই। আরেক আমদানিকারক আরাফাত এন্টারপ্রাইজের ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে চট্টগ্রাম নগরীর যুবলী রোড এলাকার কাদের টাওয়ারে।
আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান দুটির মালিক বাপ্পু বড়ুয়া এবং মোহাম্মদ আরাফাত হোসেনের সাথে টেলিফোনে যোগাযাগের চেষ্টা করা হলে তাদের পাওয়া যায়নি। সিএন্ডএফ এজেন্ট এসোসিয়েশনের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া নম্বর অনুযায়ী মধুমতি এসোসিয়েটস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ ইলিয়াছের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করা হলে সেটিও বন্ধ পাওয়া যায়।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস সূত্র জানায়, পাপ্পু এন্টারপ্রাইজের চীন থেকে আনা এ-ফোর সাইজের পেপারের তিন কোটি উনিশ লাখ আশি হাজার পিস ১০ শলাকাবিশিষ্ট সিগারেটের প্যাকেটে ব্যবহারের উপযোগী হালকা খয়েরী রংয়ের নকল স্ট্যাম্প পাওয়া যায়। গত ১৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য চালানটি আটক করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে গত ২২ ডিসেম্বর আরাফাত এন্টারপ্রাইজের চীন থেকে আমদানি করা অফসেট পেপারের একটি চালানে নকল ব্যান্ড রোল খুঁজে পায় কাস্টমস। পণ্যচালান দুটি খালাস হয়ে গেলে ২৩০ কোটি টাকা রাজস্ব হারাতো সরকার।