পুলিশ আপনার গাড়ি জব্দ করলে তা কি মরচে পড়ে রদ্দিতে পরিণত হওয়ার কথা?
২০২১ সালের ডিসেম্বরের কোনো এক দিনে গুলশান থানা প্রাঙ্গনে রাখা নিজের দামি মার্সিডিজ গাড়ির দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন ব্যবসায়ী নাজমুল হাসান (ছদ্মনাম)। অবহেলায়, অযত্নে গাড়িটির ওপর জমেছে ধুলোর আস্তরণ, রোদবৃষ্টির কারণে মরিচা ধরেছে কোনো কোনো জায়গায়।
মাস কয়েক আগে গুলশান এভিনিউয়ে বিলাসবহুল আরেকটি গাড়ির সাথে সংঘর্ষ হয় তার গাড়ির। এতে কেউ হতাহত হয়নি। দুটি গাড়ির কিছু জায়গা দেবে যাওয়া ও আঁচড় ছাড়া কোনো বড় ক্ষয়ক্ষতিও হয়নি। কিন্তু, পুলিশ পরে দুটি গাড়িই বাজেয়াপ্ত করেছে।
এখন নিজের গাড়ি ফিরে পেতে আদালতের আদেশের অপেক্ষায় দিন গুনছেন নাজমুল। অপর গাড়িটির মালিকও সেই অপেক্ষায় আছেন।
নাজমুল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ওটা ছিল সামান্য একটা দুর্ঘটনা। কিন্তু আজও আমরা আমাদের গাড়ি ফেরত পাইনি।"
তিনি জানান, তারা উভয়েই (দুই গাড়ির মালিক) সমঝোতার মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে চাইলেও পুলিশ গাড়ি বাজেয়াপ্ত করে একটি মামলা দিয়েছে।
"খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখা গাড়িটির জং ধরা ঠেকাতে আমি সেটি ঢেকে দিয়েছি। কারণ কবে ফেরত পাব তা আমার জানা নেই,"- নাজমুলের কণ্ঠে ছিল হতাশার সুর।
শুধু তারই নয়, গুলশান থানায় রাখা আরও ২০০টি জব্দ করা মোটরকার ও মোটরসাইকেলও একইভাবে পড়ে রয়েছে খোলা আকাশের নিচে। জং ধরছে সেগুলোয়।
গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আমিনুল ইসলাম টিবিএসকে জানান, (সড়ক দুর্ঘটনার) ক্রিমিনাল কেস চলমান থাকায় তারা আদালতের নির্দেশ ছাড়া এসব গাড়ি মালিকদের ফেরতও দিতে পারেন না।
তিনি বলেন, "এই এলাকায় আটক হওয়া বেশিরভাগ গাড়িই বিলাসবহুল। আমরা সাধ্যমতো সেগুলোর (জব্দ গাড়ির) যত্ন নেওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু সংখ্যায় বেড়ে গেলে তা করা কঠিন হয়ে যায়। ফলে দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকায় গাড়িগুলোতে জং ধরেছে।"
আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। ২০১৪ সালে অবৈধ মাদক ফেন্সিডিল বহনের দায়ে একটি পালসার মোটরসাইকেল জব্দ করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। তখন থেকেই কোনোপ্রকার রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াই সেটি পড়ে রয়েছে ডিবি কার্যালয়ের চত্বরে। এরমধ্যেই চুরি হয়েছে মোটরসাইকেলের সামনের অংশ, চাকা, হ্যান্ডেলবার, হেডলাইটের মতো গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সাব জুডিশিয়ারিতে মাদক মামলাটি থাকায় পুলিশ মোটরসাইকেলটি নিলামও করতে পারছে না।
এভাবেই রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য জেলায় থানার সামনে ও চত্বরের বিভিন্ন জায়গায় অযত্নে পড়ে নষ্ট হচ্ছে শত শত দামি কার, মোটরসাইকেল ও অন্যান্য যানবাহন। প্রমাণ হিসেবে জব্দ করা এসব যানের মূল্য কোটি কোটি টাকা।
সারাদেশের থানায় এ ধরনের কত গাড়ি রয়েছে তার সঠিক কোনো তথ্য নেই। তবে পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র জানায়, প্রায় এক হাজার কোটি টাকা মূল্যের অন্তত কয়েক হাজার গাড়ি রয়েছে।
রাজধানীর গুলশান, বনানী ও তেজগাঁও শিল্প এলাকার থানায় গিয়ে এই প্রতিবেদক অন্তত ৭০০ জব্দ করা গাড়ির সন্ধান পান। এগুলো থানা চত্বরে বা লাগোয়া কোনো রাস্তার পাশে পার্ক করে রাখা হয়েছে। বেশিরভাগ গাড়িই এখন রদ্দিতে পরিণত হয়েছে।
রাজধানীর বসিলা, শাহবাগে অবস্থিত ডাম্পিং স্টেশন এবং ডিএমপির গোয়েন্দা শাখায় দিয়ে আরও অন্তত ৫০০ জব্দ করা মোটরসাইকেল ও ৮০০-৯০০ কারের সন্ধান মেলে। ধুলো আর জং ধরে সেগুলোরও জীর্ণ দশা।
লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মৌলভীবাজার এবং কুমিল্লার টিবিএস সংবাদদাতারাও একই রকম চিত্র খুঁজে পেয়েছেন। অনেক জব্দ করা গাড়ি থানার সামনে এবং অস্থায়ী ডাম্পিং স্টেশনে পড়ে আছে।
অনেক সময়, মামলা সংশ্লিষ্ট গাড়ি মালিক বা তাদের আইনগত উত্তরাধিকারীরা আদালতের রায় সত্ত্বেও তাদের যানবাহন নিয়ে যান না, যার ফলে থানায় যানবাহন জমে থাকে।
পুলিশি সূত্র জানিয়েছে, জব্দকৃত গাড়ির বেশিরভাগই হয় সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত অথবা নিষিদ্ধ মাদক বহনে ব্যবহৃত হয়েছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুবিনুল ইসমাল টিবিএসকে বলেন যে, তাদের পার্কিং স্পেস না থাকায় জব্দ করা যানবাহনগুলো থানা চত্বর, আশেপাশের জায়গা এবং রাস্তায় ফেলে রাখতে হয়েছে।
তিনি বলেন, "আমরা মেট্রোপলিটন এলাকায় চারটি স্থায়ী ডাম্পিং স্টেশন চেয়ে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি, কিন্তু এখনও কোনো সাড়া পাইনি।"
এদিকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের সূত্র জানায়, অনুমোদনহীন গাড়ি বিক্রির জন্য তারা বেশ কয়েকটি নিলাম আয়োজন করে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গাড়ি বিক্রি হয়।
আটককৃত যানবাহনগুলোর বেশিরভাগই হলো- মোটরসাইকেল, বাস ও ট্রাক। নিলামের সময় ক্রেতারা সেগুলি কিনতে আগ্রহ দেখায় না। এছাড়াও, পুলিশ কখনও কখনও জব্দ করা গাড়ি দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার করে, বলে সূত্রটি উল্লেখ করেছে।
যেমন আদালতের অনুমতি নিয়ে ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড এর জব্দকৃত গাড়ি অফিসিয়াল ডিউটিতে ব্যবহার করছে ডিএমপি।
আদালত সূত্র জানায়, দামি গাড়িগুলি বেশিরভাগই নিলামের জন্য রাখা হয়; তবে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া এবং জনবলের ঘাটতি মামলার নিষ্পত্তিকে ধীর করে দেয়।
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক) সৈয়দ নুরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, কোনো গাড়ির দাবিদার না থাকলে আদালত তার একক কর্তৃত্বে সেগুলো নিলাম করতে পারেন।
"এছাড়া বছরের পর বছর ধরে যানবাহন নষ্ট হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পুলিশ কিছুই করতে পারে না,"- যোগ করেন তিনি।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নোয়াখালী জেলা ও দায়রা জজ আদালত গত বছর দুটি ভিন্ন নিলামে প্রায় ১০০টি মোটরসাইকেল বিক্রি করেছে।
ঢাকার বাইরেও একই চিত্র
কুমিল্লা হাইওয়ে পুলিশের পাঁচটি ডাম্পিং স্টেশনে ৫০ কোটি টাকা মূল্যের বিভিন্ন ধরনের প্রায় দুই হাজার গাড়ি পড়ে রয়েছে। এসব যানবাহনের মামলা বছরের পর বছর ধরে চলছে। মালিকদের মধ্যে আর এসব যানবাহন নিয়ে যাওয়ার তেমন আগ্রহ নেই।
কিছু যানবাহন খোলা আকাশের নিচে উন্মুক্ত ফেলে রাখা হয়েছে। উন্মুক্ত জায়গায় পড়ে থাকতে থাকতে বাহনগুলোতে জং ধরে গেছে, এগুলোর গায়ে বুনো গাছপালা বেড়ে উঠছে। কুমিল্লা জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, অনেক বাহনের যন্ত্রাংশও নষ্ট হয়ে গেছে।
জব্দকৃত গাড়ির সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। এ কারণে এসবের দেখভাল করতে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ।
লক্ষ্মীপুর জেলা পুলিশ লাইনের নির্ধারিত ডাম্পিং সেন্টারেও এরকম প্রায় ১৪০টি গাড়ি জব্দ করা হয়েছে। এসবের বেশিরভাগই মোটরসাইকেল।
২০০৬-০৭ সালে অপরাধের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী পরিচালিত যৌথ অভিযান অপারেশন ক্লিন হার্টের সময় অধিকাংশ যানবাহন জব্দ করা হয়েছিল। এরপর আর কেউ এসব গাড়ি দাবি করতে আসেনি।
এসব যানবাহনের অবস্থা এখন এতই শোচনীয় যে নিলামে তোলাও সম্ভব নয়। লক্ষ্মীপুর জেলা পুলিশের মোটরযান বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইমরানুল হক মৃধা জানান, আদালতের অনুমতি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ভালো অবস্থায় থাকা গাড়িগুলো নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছে।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) সেলিম মোহাম্মাদ শেখ টিবিএসকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা বা অন্য কোনো মামলায় কোনো যানবাহন আটক করলে—সেটা মোটরসাইকেলই হোক কি প্রাইভেট কারই হোক—কেবল সংশ্লিষ্ট আদালতের অনুমতিক্রমেই মালিকরা সেগুলো ফেরত পেতে পারেন। তাছাড়া এক্ষেত্রে মালিকানার কাগজপত্রও (রেজিস্ট্রেশন) বৈধ হতে হয়।
তিনি বলেন, "ডাম্পিং স্টেশনে পড়ে থাকা বেশিরভাগ গাড়িই বৈধভাবে নিবন্ধিত না। কোনো গাড়ির বৈধ মালিকানা না থাকলে এটা কেউ দাবি করতে পারে না।"
সিংহভাগ জব্দকৃত মোটরসাইকেলই সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে দেশে এসেছে। শেষপর্যন্ত মালিকরা আদালতে গিয়ে এসব বাহনের মালিকানা দাবি করতে পারেনি। তাই ডাম্পিং স্টেশনই বাহনগুলোর শেষ ঠিকানা হয়েছে বলে জানান সেলিম।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মোল্লা মোহাম্মদ শাহীন জানান, বেশিরভাগ যানবাহনই তারা মাদক, সড়ক দুর্ঘটনা ও অন্যান্য মামলার আলামত হিসেবে আটক করেছেন।
পুলিশ সাধারণত জব্দের প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট আদালতে জমা দেয় বলে জানান তিনি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আদালতের রায়ে দিতে বিলম্ব হয় বলে বছরের পর বছর ধরে যানবাহনগুলো অব্যবহৃত পড়ে থাকে। ফলে বাহনগুলোতে মরিচা ধরে যায়।
তিনি আরও বলেন, "আমাদের কাছে এরকম জব্দ করা যানবাহনের কোনো কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ নেই। শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট থানা আর ডিপার্টমেন্টগুলো এসব গাড়ির লগবুক রাখে। কাজেই প্রকৃতপক্ষে কতগুলো যানবাহন আইনি ফাঁকফোকরের কারণে নষ্ট হচ্ছে, তা অনুমান করা সম্ভব না।"
এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, কোনো পুলিশ সদস্যের ব্যক্তিগতভাবে এসব গাড়ি ব্যবহার করার অনুমতি নেই।
তিনি আরও বলেন, 'পুলিশের যানবাহন সংকট থাকায় আমরাও মাঝেমধ্যে আদালতের অনুমতি নিয়ে অফিসিয়াল উদ্দেশ্যে জব্দ করা গাড়ি বা মোটরসাইকেল ব্যবহার করি।'
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন:
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক টিবিএসকে বলেন, "পুলিশ জব্দকৃত যানবাহন নিয়ে যা করে, তা অবৈজ্ঞানিক এবং মান্ধাতার আমলের প্রক্রিয়া।"
নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশে কেউ দুর্ঘটনা ঘটানোর পর জরিমানা বা ক্ষতিপূরণ এড়াতে রাস্তার ধারে বা অন্য কোনো জায়গায় গাড়ি রেখে পালিয়ে গেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ওসব বাহন জব্দ করে না। বরং রিসাইক্লিং প্রতিষ্ঠানগুলো ওসব বাহন নিয়ে যায় এবং ওগুলোকে ভেঙে যন্ত্রাংশ খুলে বিক্রি করে।
শামসুল হোক বলেন, "আমরা এমন একটা সিস্টেম চালু করতে পারি। এতে দেশের প্রচুর অর্থ সাশ্রয় হবে। এ কাজের জন্য আমাদের পুরান ঢাকা আর চট্টগ্রামের ধোলাইখাল আছে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং হাব হিসেবে।"
শামসুল হক আরও বলেন, ছয়-সাত বছর আগে ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম ও অন্যান্য সুবিধা চালু হলেও পুলিশ জব্দকৃত গাড়ির ডিজিটাল ডাটাবেজ চালু করতে পারেনি।
তার মতে, "জব্দ করা যানবাহনের ডাম্পিং কোনো সমাধান হতে পারে না। কেউ মালিকানা দাবি না করলে আপনি সেগুলোকে রিসাইকেল [পুনরায় বিক্রি বা অন্য উপায়ে ব্যবহার] করতে পারেন।"