শাহজালালে ভিসির স্বৈরশাসন?
২০১৭ সালের আগস্টে প্রথম দফায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসোত্তোর ছুটিতে থাকা অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদ। ২০২১ সালের ৩০ জুন একই পদে তাকে পুনঃনিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। দুই মেয়াদে প্রায় সাড়ে তিন বছর বড় কোনো ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়নি এই শিক্ষক নেতাকে। যদিও তার মেয়াদকালের একটা বড় সময়ই করোনার কারণে বন্ধ ছিল ক্যাম্পাস।
দ্বিতীয় দফায় উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় ছয় মাস পর এবার প্রথম বড় ধরনের ছাত্র বিক্ষোভের মুখে পড়লেন ফরিদ উদ্দিন আহমদ। এবার রীতিমতো তার পদত্যাগের দাবিতে টানা বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থীরা। তাকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিতও ঘোষণা করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
এই বিক্ষোভ শুরু গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের বিভিন্ন অব্যবস্থাপনা ও হল প্রভোস্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন ওই হলের ছাত্রীরা। প্রভোস্টের পদত্যাগসহ ৩ দফা দাবি জানান তারা। তবে রোববার তা পরিণত হয় এক দফা দাবিতে—উপাচার্যের পদত্যাগ। এক হলের সমস্যা নিয়ে আন্দোলন এখন রূপ নিয়েছে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে।
হল প্রভোস্ট জাফরিন আহমদ লিজার প্রদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা রোববার বিকেলে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ওয়াজেদ মিয়া আইআইসিটি ভবনে অবরুদ্ধ করে রাখে। ওইদিন সন্ধ্যায় তাকে উদ্ধার করতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ করে পুলিশ। এরপর পুলিশ-শিক্ষার্থী সংঘাত বেধে যায়। এ সময় সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ ও শটগানের গুলি ছোড়ে। এতে আহত হন অন্তত ৫০ জন।
পুলিশের এই হামলার পর থেকেই বদলে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি। প্রভোস্টবিরোধী আন্দোলন রূপ নেয় উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে। এক হলের ছাত্রীদের আন্দোলনে যুক্ত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে এর আগে পুলিশ কখনো হামলা চালায়নি। এমনকি ২০০৬ সালে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মোসলেহ উদ্দিনের বিরুদ্ধেও ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল। আন্দোলনকারীরা উপাচার্যের বাসভবনে ভাংচুর করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। তখনও পুলিশকে তিনি হামলার নির্দেশ দেননি। কিন্তু এবার তখনকার চেয়ে অনেক তুচ্ছ ঘটনায় পুলিশ দিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালানো হলো।
শাবিপ্রবির ওই অধ্যাপক বলেন, এই হামলার পর শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ খুবই যৌক্তিক।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোপ করে জানা যায়, অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিনের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ দীর্ঘদিনের, রোববারের পুলিশি হামলার ঘটনায় যার বিস্ফোরণ ঘটেছে।
একাধিক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, ফরিদ উদ্দিন আহমদ স্বৈরাচারি কায়দায় বিশ্ববিদ্যালয় চালাতেন; কারও মতামত নিতেন না। শিক্ষার্থীদের কথা বলার অধিকারও তিনি কেড়ে নিয়েছিলেন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিনি সবসময় বিভক্তি ও দ্বন্দ্ব লাগিয়ে রাখতেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদ হোসেন অপূর্ব বলেন, 'আমরা কোনো দাবি নিয়ে গেলে উপাচার্য গুরুত্বই দিতেন না। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের কোনো কর্মসূচিই পালন করতে দিতেন না। এমনকি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনেও তিনি বাধা দেন।'
আরেক শিক্ষার্থী মোসাদ্দেক মিম বলেন, 'ক্যাম্পাসের ভেতরে অনেকগুলো ফুড কোর্ট ছিল। এগুলো তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন। আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রোড পেইন্ট করি। এটাও তিনি করতে দেন না।'
এগুলো করতে না দেওয়ার কারণ সম্পর্কে মিম বলেন, 'শিক্ষার্থীরা যাতে কোনোভাবেই সংগঠিত হতে না পারে এজন্য তিনি সব অনুষ্ঠান আয়োজনে বাধা দিতেন। আমাদের মত প্রকাশের সব পথই তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন।'
পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী তাসনুভা খানম বলেন, হলে থাকা ছাত্রীরা আগে রাত ১০টা পর্যন্ত হলের বাইরে থাকতে পারত। ফরিদ উদ্দিন উপাচার্যের দায়িত্ব নেওয়ার পরই সন্ধ্যার মধ্যে হলে যাওয়ার আইন চালু করেন। সন্ধ্যার পর পর কেউ হলের বাইরে আছে কি না, তা প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা ঘুরে ঘুরে খোঁজ নেন। কেউ বাইরে থাকলে তাকে শাস্তি দেন।
শাবিপ্রবির ছাত্রলীগের কমিটি নেই দীর্ঘদিন ধরে। মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় গত বছরের ১৭ জুন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। এরপর আর নতুন কমিটি দেওয়া হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রলীগ নেতা বলেন, উপাচার্যের কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি আসছে না। তিনি ছাত্রলীগকে কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত করে রেখেছেন। কমিটি দিলে ঝামেলা হবে, এমনটি বুঝিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের।
তার অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে। এসবে ব্যাপক লুটপাট হচ্ছে। লুটপাট অব্যাহত রাখা ও নিজের ক্ষমতা একচ্ছত্র করতে ছাত্রলীগের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করেছেন ফরিদ উদ্দিন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদেরও তিনটি গ্রুপ রয়েছে—আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের 'মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদ', আওয়ামী-বামপন্থী শিক্ষকদের প্যানেল 'মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তচিন্তা চর্চায় ঐক্যবদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ' ও বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের 'মহান মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় মূল্যবোধে শ্রদ্ধাশীল শিক্ষক ফোরাম'।
বর্তমান সঙ্কটের নেপথ্যে শিক্ষক রাজনীতিও ভুমিকা রয়েছে বলে জানা গেছে। একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, যার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন ছাত্রীরা, সেই হল প্রভোস্ট জাফরিন আহমদ আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের একটি গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ ও প্রক্টর আওয়ামীপন্থী আরেক গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত। এই দুই গ্রুপের রেষারেষির কারণে শিক্ষার্থীদের দাবি সত্ত্বেও প্রভোস্টের বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি উপাচার্য। যদিও রোববারের সংঘর্ষের পর রাতে পদত্যাগ করেন হল প্রভোস্ট জাফরিন আহমদ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের এক শিক্ষক বলেন, শিক্ষকদের গ্রুপিংয়ের কারণেও আজ উপাচার্যকে বিপদে পড়তে হয়েতে। তবে তিনিই এতদিন এই গ্রুপিংয়ের সুবিধা নিয়েছেন। নিজের ক্ষমতা একচ্ছত্র করতে গ্রুপিং জিইয়ে রেখেছেন।
অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে থাকাকালেই অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ রয়েছে ২০০৫ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি ঢাবির অর্থনীতি বিভাগে জিয়াউর রহমান চেয়ার চালু করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আর ২০১৭ সালে এসে আওয়ামী-বামপন্থী শিক্ষকদের প্যানেল নীল দল থেকে সভাপতি প্রার্থী হন।
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমদের সঙ্গে মঙ্গলবার মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। চলমান আন্দোলনের কারণে তার সঙ্গে দেখাও করা যায়নি।
যদিও সোমবার তিনি বলেছিলেন, 'এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান খুব ভালো। করোনাকালেও আমরা অনেক ভালো করেছি। এখন কিছু বহিরাগতের ইন্ধনে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে। বহিরাগতরাই এতে নেতৃত্ব দিচ্ছে।'
এ প্রসঙ্গে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. তুলসী কুমার দাস বলেন, 'প্রশাসন চালাতে গেলে কিছু অভিযোগ তো ওঠেই। তবে শিক্ষার্থীরা যে অভিযোগ তুলছে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান সম্ভব।'
আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে হয়েছিল মুসলেহ উদ্দিনকে
শাবিপ্রবিতে প্রথম উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন হয় ২০০৬ সালে। বিএনপি সরকারের আমলে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মোসলেহ উদ্দিনের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ওঠে। তার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে নামে সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
আন্দোলন চলাকালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। এতে আন্দোলন আরও তীব্র হয়। আন্দোলনকারীরা অচল করে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়। উপচার্যের বসভবনে আগুনও ধরিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। আন্দোলনের মুখে একপর্যায়ে পদত্যাগও করতে হয় উপাচার্যকে।
আন্দোলন সত্ত্বেও টিকে যান আমিনুল হক
ফরিদ উদ্দিন আহমদের আগে শাবিপ্রবির উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক ড. আমিনুল হক ভূঁইয়া। ২০১৫ সালে তার বিরুদ্ধে শিক্ষকদের সঙ্গে অসাদাচাণ ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলেন শিক্ষকরা। তার পদত্যাগ দাবিতে ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করে আন্দোলনে নামেন শিক্ষকরা। আন্দোলন চলাকালে ওই বছরের ৩০ আগস্ট অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হককে লাঞ্ছিত করে ছাত্রলীগ। এরপর আন্দোলন আরও তীব্র হয়। স্ত্রীকে লাঞ্ছিতের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন শিক্ষক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বৃষ্টিতে ভিজে প্রতিবাদ জানান, যা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
তবে শিক্ষকদের আন্দোলন সত্ত্বেও সে যাত্রায় টিকে যান আমিনুল হক। ২০১৭ সালে নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে দায়িত্ব ছাড়েন তিনি।