উপকূলীয় শহর মোংলা বাংলাদেশে জলবায়ু শরণার্থীদের আশ্রয় ও জীবিকার সুযোগ দিচ্ছে
মোংলা নদীর বুকে শীতের কুয়াশার অন্ধকার চিড়ে সূর্যের আলো উঁকি দেওয়ার সাথে সাথেই জলপথটিতে শোনা যায় মোটরচালিত নৌকার গুঞ্জন। ছোট বড় এসব নৌকায় চেপেই কাজে যোগ দিতে আসে হাজারো শ্রমিক।
মোংলা রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) এলাকা সংলগ্ন ছোট্ট ঘাটে নৌকা ভিড়তেই তারা তড়িঘড়ি করে নেমে আসে। কয়েক টাকার বিনিময়ে আলু সিঙ্গারা কিনে খেতে খেতেই কারখানার দিকে দ্রুতপদে পা চালায়।
জলবায়ু সংকটে বিপর্যস্ত বাংলাদেশে মোংলার ইপিজেড ছোট্ট এ বন্দরনগরীকে বিপদগ্রস্ত মানুষের কর্মসংস্থানের কেন্দ্র করে তুলেছে।
বঙ্গোপসাগর থেকে বাংলাদেশের স্থলভাগের ৫০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে অবস্থিত মোংলা ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত সুন্দরবনে প্রবেশের অন্যতম দুয়ার। বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় এ বাদাবনেই বাস করে বিপন্ন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার।
মোংলা বন্দর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫০ এর দশকে। শহরটি যেন জলবায়ু শরণার্থীদের স্বাদরে গ্রহণ করে; দশকব্যাপী সময় ধরে তেমনই এক প্রকল্প নিয়ে কাজ করছেন বিশ্বের শীর্ষ একজন জলবায়ু বিজ্ঞানী।
এই রূপান্তর চেষ্টাকে স্বচক্ষে দেখেছেন মোংলা নদীর মাঝি আবদুল জলিল। ৫২ বছরের এই পৌঢ় বলেন, "৩০ বছর ধরে এখানে (মোংলায়) আছি। দেখেছি অনেক কিছুই বদলেছে। এখানকার রাস্তা, ঘাট ও আগত লোকের সংখ্যা- সবকিছুতেই এসেছে পরিবর্তন। আগে অনেক সমস্যা ছিল; বৃষ্টি হলেই ডুবে যেত রাস্তাঘাট। অবকাঠামোও ছিল খুব সামান্য।"
আগে দাঁড় বেয়েই নৌকা চালাতেন জলিল। কিন্তু, এখন প্রায় সব নৌকাই ইঞ্জিনে চলে বলে জানান। প্রতিদিন নিজের নৌকায় ৭০০ জনকে পারাপার করান তিনি। বেশিরভাগ যাত্রীই ইপিজেডের শ্রমিক বা সুন্দরবন দেখতে আসা পর্যটক।
"যে যাত্রীরা ইপিজেড যেতে নদীপার হয়, তাদের বেশিরভাগই হলেন সুন্দরবনের কাছাকাছি বিভিন্ন গ্রামের মানুষ। চট্টগ্রামে না গিয়ে তারা এখানকার ইপিজেডের কারখানায় কাজ করেন। কারণ এখানেই তারা বেশি নিরাপদ অনুভব করেন। অপরাধের ঘটনাও বেশ কম। তাছাড়া, চাকরির সুযোগ আছে, জীবনযাপনের মানও তুলনামূলক ভালো।"
প্রভাবশালী ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান বলেছে, বাংলাদেশ যেন অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের প্রেশার কুকার হয়ে উঠেছে। দারিদ্র্য থেকে বাঁচতে কাজের সন্ধানে গ্রামের মানুষের শহরে ছুটে আসাও নতুন কিছু নয়। কিন্তু, ভয়াল সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই নগরমুখী জনস্রোতকে তীব্র করে তুলেছে।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) তথ্যমতে, শুধু ২০১৯ সাল নাগাদ জলবায়ু সংগঠিত দুর্যোগে বাংলাদেশে ৪১ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার ২.৫ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে আভাস দেওয়া হয়, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা বেড়ে এক কোটি ৯৯ লাখে উন্নীত হবে, যা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে যে সংখ্যা অনুমান করা হচ্ছে তার প্রায় অর্ধেক।
সহায়-সম্বল হারানো বেশিরভাগ মানুষ আসেন রাজধানীতে। ঢাকা বিশ্বের অন্যতম দ্রুত সম্প্রসারণশীল নগরী। দুই কোটির বেশি বাসিন্দার এই শহর বাসযোগ্যতার তালিকায় নিচের দিকে। অভ্যন্তরীণ শরণার্থীরা ঢাকায় এসে বস্তিতে বসবাসে বাধ্য হন। যেখানে নেই প্রাথমিক অবকাঠামোর কোনো সুবিধা, অস্বাস্থ্যকর ও জনকীর্ণ পরিবেশে তাদের গাদাগাদি করেই থাকতে হয়।
জনবহুল শহরে বাস্তুহারাদের প্রতিদিনের টিকে থাকার সংগ্রাম এবং আসন্ন বিপর্যয়ের এই ভয়াবহ পটভূমিতে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইসিসিসিএডি)- এর পরিচালক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সুপরিচিত জলবায়ু বিজ্ঞানী ড. সলিমুল হক ঢাকা এবং এর আশেপাশের এলাকার ওপর চাপ কমাতে "রূপান্তরমূলক অভিযোজন" এর একটি রূপকল্প প্রণয়ন করেছেন।
এর লক্ষ্য: দ্রুত বর্ধনশীল এই কর্মশক্তির জনতাকে ছোট শহুরের কেন্দ্রগুলিতে জীবিকার সুযোগ করে দেওয়া। অর্থাৎ, ছোট শহরগুলির সক্ষমতা এমনভাবে বৃদ্ধি করা যাতে সেখানে বাড়তি জনসংখ্যার আবাস ও টেকসই কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়।
দ্য গার্ডিয়ানকে ড. হক বলেন, "অভিবাসনের এই প্রবণতা দীর্ঘদিনের, এখানে নতুন কিছুই নেই- তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আরও বেশি মানুষকে তাদের চিরন্তন আবাস ত্যাগ করতে হচ্ছে। ফলে আমাদেরকেও আরও দ্রুত এসব সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে- সেই চিন্তা থেকেই আমরা এই আইডিয়া নিয়ে কাজ শুরু করি।"
জলবায়ু অভিবাসনের এই রূপান্তরমূলক অভিযোজন পরিকল্পনার আওতায় সমুদ্র ও নদী বন্দর তীরবর্তী এক ডজনের বেশি মফস্বল ও উপশহর বা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলকে সম্ভাব্য অভিবাসী জনগোষ্ঠী-বান্ধব স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ড. হক ব্যাখ্যা করেন, "সেকেন্ডারি এসব শহরের জনসংখ্যা কয়েক লাখ থেকে অর্ধ-মিলিয়নের (পাঁচ) মাঝামাঝি। এর প্রতিটি আরো পাঁচ লাখ করে জলবায়ু অভিবাসীকে গ্রহণ করতে পারবে।"
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অভিযোজনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নিয়ে এসব শহরের মধ্যেই ব্যতিক্রম হয়ে উঠেছে মোংলা। যার পেছনে বলিষ্ঠ অবদান রেখেছেন সাবেক স্থানীয় পৌর মেয়র জুলফিকার আলী। তার ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১০ বছরের দায়িত্ব পালনকালে নানান ধরনের অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে মোংলা একটি নিরাপদ ও জলবায়ু প্রভাব সহনশীল ছোট্ট শহরে পরিণত হয়েছে।
এসব অবকাঠামোর মধ্যে রয়েছে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস রোধে ৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বাঁধসহ নতুন তৈরি একটি মেরিন ড্রাইভ। পানি নিষ্কাশনের জন্য রয়েছে দুটি ফ্লাড কন্ট্রোল গেইট। ১০০ একর জমিতে নির্মিত দুটি জলাধার ও একটি মিঠাপানি শোধনাগার; যার কল্যাণে শহরে পানির সংযোগপ্রাপ্ত বাসাবাড়ির সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেকে উন্নীত হয়েছে।
২০২১ সালের জানুয়ারিতে মোংলার নতুন মেয়র হন শেখ আবদুর রহমান। তিনিও পূর্বসূরীর এসব উন্নয়ন কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, "এক সময় উচ্চ জোয়ারের সময় শহরটি নিয়মিত প্লাবিত হতো, কিন্তু জলবায়ুবান্ধব নগর পরিকল্পনার মাধ্যমে তা এখন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে।"
স্থানীয়দের আবহাওয়ার নিয়মিত পূর্বাভাস জানাতে চালু হয়েছে একটি গণ-ঘোষণা ব্যবস্থা।
বিজ্ঞানী সলিমুল হক জানান, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দরের সাথে নৈকট্য এবং এর রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে ইতোমধ্যেই ৮ হাজার মানুষ কর্মরত থাকার ঘটনা শহরটিকে অর্থনৈতিকভাবেও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
তিনি বলেন, জলবায়ু শরণার্থীদের এখানে আকর্ষণের প্রধান প্রণোদনা হলো চাকরির সুযোগ। কিন্তু, সেটা এই কাজের সহজতর অংশ। মূল চ্যালেঞ্জ কৌশলী নমনীয় পদক্ষেপের মাধ্যমে শহরের আদি বাসিন্দাদের সামাজিক চিন্তাধারা ও সংস্কৃতিতে এমন পরিবর্তন আনা- যাতে তারা নবাগতদের স্বাগত জানান।
ব্যাখ্যা দিয়ে সলিমুল হক বলেন, "স্থায়ী বাসিন্দা ও অভিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধের ঘটনা সবখানেই দেখা যায়। তবে বাংলাদেশে জলবায়ু শরণার্থীদের বিষয়ে কিছু সুবিধাও রয়েছে। যেমন আমরা সবাই দেখতে একইরকম, ভাষাও পৃথক নয়। সবাই বাংলায় কথা বলে। আর তৃতীয়ত, আমাদের ধর্ম বিশ্বাসও প্রায় অভিন্ন। প্রধান বাধা আর্থ-সামাজিক শ্রেণি বিভেদ। নবাগতরা দরিদ্র্য হওয়ায় সহজেই তাদের পৃথক করে চেনা যায়। আমরা সমাজের সম্পন্নদের অবহেলা ও পৃথক করে দেখার এই বিষয়টিকে মানবিক দৃষ্টিকোণে রূপান্তরের চেষ্টা করছি।"
এই নমনীয় হস্তক্ষেপের মধ্যে রয়েছে- জলবায়ু অভিবাসীদের সন্তানদের স্থানীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি ও সাবলীলভাবে অন্য শিক্ষার্থীদের সাথে মেলামেশার সুযোগ সৃষ্টি। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র ভাঙ্গতে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় যেতেও উৎসাহিত করা হচ্ছে। শুনতে সাদামাটা মনে হলেও এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজি করাতে হয়। সেজন্য ড. হক ও তার টিম স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে আলাপ-আলোচনা করে সমর্থন আদায়ে দীর্ঘসময় ব্যয় করেছেন।
তাতে যে তারা সফলও হচ্ছেন মোংলার জনসংখ্যা বৃদ্ধিই যেন তার সাক্ষী। ২০১১ সালের জরিপে মোংলার মাত্র ৪০ হাজার মানুষ বাস করছেন বলে জানানো হয়। এক দশক পর তা তিনগুণ বেড়েছে। শহরটিতে অভিবাসী জনসংখ্যা আরো বৃদ্ধির যে চেষ্টা ড. হক চালাচ্ছেন; তার ফলে এই জনসংখ্যা আগামীতে দশগুণ বা আরো কয়েক লাখ পর্যন্ত বাড়তে পারে।
সুপরিচিত এ জলবায়ু গবেষক বলেন, আইসিসিসিএডি'র সুপারিশ গ্রহণ করা প্রথম শহর হলো মোংলা। এরপর বাকিরাও এই উদাহরণ অনুসরণ করবে। "এটি ১০ বছর মেয়াদি অ্যাকশন প্রোগ্রাম; একে একে আমরা অন্যান্য শহর ও মেয়রদের কাছে যাচ্ছি।"
আগামীতে এসব শহর উপকুলীয় এলাকার গ্রামীণ জনপদের কাছাকাছি পর্যন্ত বিস্তার লাভ করবে, কারণ এই গ্রাম থেকেই বেশিরভাগ জলবায়ু শরণার্থী আসছে।
ড. হকের পরিকল্পনা অনুসারে, এসব উপকণ্ঠ (আউটপোস্ট) অভিবাসীদের জন্য ক্ষুদ্র তথ্যকেন্দ্র হয়ে উঠবে। এতে তারা ঢাকা বা অন্য বড় মহানগরে না এসে বাড়তি জনসংখ্যা ধারণে অধিক সক্ষম স্থানীয় শহরে যেতেই উৎসাহিত হবেন, যেখানে তারা কাজের সুবিধা যেমন পাবেন, তেমনি তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবেও লাঞ্ছনা-গঞ্জণার শিকার হতে হবে না।
দীর্ঘ এই প্রক্রিয়া এখনও প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছে। তবে এর অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করেছে কোভিড-১৯ মহামারি। তাছাড়া, গবেষণায় অর্থায়নকারী যুক্তরাজ্য সরকারও তহবিল বরাদ্দ কমিয়েছে। তারপরও সলিমুল হক আশাবাদী যে, মোংলার মতো মফস্বল শহরগুলো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু সহনশীলতা ও অভিযোজন তৈরির রোল মডেল হয়ে উঠবে।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান