দেশে করোনার চেয়ে ‘১০ থেকে ২০ গুণ’ বেশি মৃত্যু হয় অসংক্রামক রোগে
অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে দেশে কোভিড-১৯ এর তুলনায় ১০ থেকে ২০ গুণেরও বেশি মৃত্যু হয় বলে দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাতীয় সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে এ দাবি করেন তারা।
দেশে মোট মৃত্যুর ৭০ শতাংশই হচ্ছে অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে। অথচ অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর হার অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও সংক্রামক রোগের প্রতিই গুরুত্ব দেওয়া হয় বেশি। তাই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গুরুত্ব না দিলে আগামী ২০৪০ সালে মৃত্যুর এই হার ৭০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮০ শতাংশে গিয়ে পৌঁছাতে পারে।
বৃহস্পতিবার (২৭ জানুয়ারি) ঢাকার প্যান প্যাসেফিক সোনারগাও হোটেলে প্রথম জাতীয় সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের প্রথম পর্বে যোগ দিয়ে বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন।
২৬ জানুয়ারি শুরু হওয়া তিনদিনের এ সম্মেলন শেষ হবে ২৮ জানুয়ারি। বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামসহ ৩০ টি দেশি বিদেশি প্রতিষ্ঠান এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে।
সম্মেলনের প্রথম পর্বে স্বাস্থ্য অর্থ ইউনিটের মহাপরিচালক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসাইন মাহমুদ বলেন, "কোভিডে সারাবিশ্ব এই মুর্হূতে এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। আমাদের দেশে কোভিডে যে পরিমাণ মৃত্যু হচ্ছে, অসংক্রামক কোনো কোনো রোগে তারচেয়েও ১০ থেকে ২০ গুণের বেশি মৃত্যু হচ্ছে।"
"শুধু ধুমপান জনিত কারণেই দেশে প্রতিদিন গড়ে মৃত্যু হচ্ছে সাড়ে তিনশ মানুষের। ক্যানসার, টিভি, হৃদরোগ এসবই অসংক্রামক রোগ। এগুলোতে আক্রান্ত হয়ে যে মৃত্যুহার দেখা যায়, তা কোভিডে আক্রান্ত মৃত্যুহারের থেকেও ৫ গুণ বেশি। কিন্তু কেন যেন আমরা শুধু সংক্রমক রোগের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি", আরও বলেন তিনি।
বিভিন্ন গবেষণায় প্রকাশিত তথ্যের উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশে এই মুহুর্তে ৮.৪ মিলিয়ন বা ৮৪ মানুষ ডায়বেটিসে আক্রান্ত। সবাইকে পরীক্ষা করলে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। তাদের শুধু ইনসুলিনের জন্য বছরে খরচ হচ্ছে ১৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। শুধু ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে অন্য বিভিন্ন অসংক্রামক রোগ থেকেও রক্ষা পাওয়া যেত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সরকারের স্বদিচ্ছার ঘাটতি নেই জানিয়ে শাহাদাত হোসাইন আরও বলেন, "করোনার টিকার জন্য এবার সরকারের ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর একটি তহবিল আছে, সেখান থেকেও বিভিন্ন সহযোগিতা দেওয়া হয়ে থাকে। সব মিলিয়ে আমরা যদি হিসাব করি তাহলে এটি ১০ ভাগের কাছাকাছি হবে।"
একটি গবেষণার বরাত দিয়ে তিনি আরও বলেন, "চিকিৎসার ক্ষেত্রে ৬৭.৫ ভাগ অর্থ জনগণের পকেট থেকে ব্যয় হয়। এটি নিসন্দেহে অনেক বেশি। এখানেও একটি হিসাব বারবার বাদ পড়ে যায়। যারা সরকারি কর্মচারী রয়েছেন তাদের জন্য সরকার প্রতিমাসে চিকিৎসা ভাতা দেয় দেড় হাজার থেকে আড়াই হাজার পর্যন্ত। এর মোট পরিমাণও ছয় হাজার কোটি টাকা। এটি কিন্তু এই টাকা হিসাবে আনা হয় না।"
"সবকিছু হিসাবে আনলে হয়তো সরকারের অংশগ্রহণ আরও বেশি হতো। থোক বরাদ্দ চলমান অর্থবছরে কোভিডের কারণে যা খচর হয়েছে, সেটি হিসাব করলে সরকারের অংশগ্রহণ অনেক বেশি হবে। অর্থাৎ সরকারের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেওয়ায় ক্ষেত্রে কোনো কার্পন্য নেই", তিনি আরও বলেন।
সরকার থেকে যে পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা সবসময় ঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় না বলেও জানান শাহাদাত হোসাইন। সমন্বিতভাবে পরিকল্পনা ও কাজ করতে পারলে অসংক্রামক রোগ থেকে অনেকাংশেই রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।
গবেষণার বরাত দিয়ে তিনি বলেন, "বাংলাদেশে যত মৃত্যু হয় তার ৭০ ভাগই অসংক্রমামক রোগে। এটা একটি বৈশ্বিক সমস্যা। ২০৪০ সালে এই হার হয়তো ৮০ শতাংশে উঠে যাবে।"
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস।
অনুষ্ঠানে বক্তব্যকালে তিনি বলেন, "বাংলাদেশে এনসিডি (অসংক্রামক রোগ) একটি নতুন ও চলমান বোঝা। ডায়বেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সার রোগী উদ্বেগজনকহারে বাড়ছে। বাংলাদেশ সরকার অসংক্রমণ রোগ নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশের আটটি বিভাগীয় শহরে ক্যান্সার হাসপাতাল হচ্ছে। হৃদরোগের চিকিৎসায় গত দুই দশকে দেশে অনেক উন্নতি হয়েছে। উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত সব হাসপাতালে এনসিডি কর্নারে ৫টি ওষুধ বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে। এছাড়া, ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত দেশ হতে কাজ করছে সরকার।"
মেয়র আরও বলেন, "সিটি কর্পোরেশন হিসেবে নগর স্বাস্থ্যের দায়িত্ব আমাদের। এনসিডি'র চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরাও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সহায়তা করার নিশ্চয়তা দিচ্ছি। নগরবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ঢাকা সিটিতে পার্ক ও ফুটপাত স্থাপন করা হচ্ছে। দুভার্গ্যবশত ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর; এ কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। আমরা আমাদের মাস্টারপ্ল্যান অনুসারে কাজ করছি। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতায় দুটি হাসপাতাল রয়েছে, সেগুলোর উন্নয়নে কাজ করা হচ্ছে।"
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন- সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, ইন্টান্যাশনাল সোসাইটি ফর আরবান হেলথ (আইএসইউএইচ)-এর প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক জো আইভি বাফর্ড, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এনসিডি টিম লিডার (বাংলাদেশ) সাধনা ভাগওয়াত, ওয়ার্ড ওরবেস্টি ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক জন উইলডিং, অরবিস ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্ট্রর ডা. মুনির আহমেদ, ইউনিভার্সেল মেডিকেল রিসার্স সেন্টারের গবেষণা প্রধান অধ্যাপক ডা. রেদওনুর রহমান, বিএসএমএমইউ'র পাবলিক হেলথ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. ফারিহা হোসেন।