ঘোড়া হাঁকাও দুরন্ত অশ্বারোহী!
ঘৌড়দৌড় দেশের উত্তরবঙ্গে একটা প্রাচীন খেলা। বিশেষ করে নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ এলাকায় ঘোড়ার দৌড় অনেক জনপ্রিয় খেলা। পূর্বে ছোট পরিসরে ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলেও বর্তমানে বিশাল আয়োজনে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। উৎসবে পরিণত হয়েছে ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতা।
বড় পরিসরের উৎসবে লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি ঘটে। গ্রামের চাষাবাদের জমিতে শস্য কেটে নেওয়ার পর খোলা মাঠেই সাধারণত এসব খেলা অনুষ্ঠিত হয়। একেক জায়গায় একেক মাপের মাঠ তৈরি করা হয়। সাধারণত এক থেকে দেড় কিলোমিটারের মতো ঘৌড়দৌড়ের মাঠের পরিধি নির্ধারণ করা হয়। খেলাটি কোথাও বিনামূল্যে দর্শকরা দেখতে পারেন আবার কোথাও খেলা দেখতে টিকিটের ব্যবস্থা করা হয়। প্রধানত শীতকাল ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতার মৌসুম হলেও গ্রীষ্মকালেও এক মাসব্যাপী এ খেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
রাজশাহীর তানোর, মোহনপুর ও বাগমারা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর, নওগাঁর সাপাহার, ধামইরহাট ও মান্দায় ইদানীং বড় পরিসরে একদিনের ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। তবে বগুড়ার শেরপুরে তিন দিনব্যাপী সবচেয়ে বড় খেলা অনুষ্ঠিত হয়।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, যারা ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেন কিংবা খেলা দেখতে যান তাদের মধ্যে ব্যাপক যোগাযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের কবে, কোথায় খেলা হবে তারা সহজেই তা জানতে পারেন। বিশেষ করে আয়োজক কমিটিই তা জানিয়ে দেন। তারাই প্রতিযোগীদের আমন্ত্রণ করেন।
পূর্বপুরুষের হাত ধরেই বংশানুক্রমে এ খেলার বিস্তার ঘটছে। অনেকে নিজের ঘোড়া নিয়ে তো খেলায় অংশ নেনই আবার ঘোড়া ভাড়া নিয়ে এসেও প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। তবে যার ঘোড়া আছে সে খেলায় অংশ নিলেও ঘোড়সওয়ার ভাড়া করতে হয়। অল্পবয়সী শিশু-কিশোরাই প্রধানত ঘোড়সওয়ার হয়। কারণ যত কম ওজনের ঘোড়সওয়ার হবে ততই ঘোড়াটি বেশি দৌড়াতে পারবে। তাই শিশু-কিশোরদের প্রধানত ঘোড়সওয়ার করা হয়।
আয়োজক কমিটি জানান, এখন বড় ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতায় লক্ষাধিক টাকা মূল্যের পুরস্কার থাকে। এছাড়া যারা ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করে তাদেরকে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকের যাওয়া-আসার খরচ ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়।
গত ২০ ডিসেম্বর রাজশাহীর মোহনপুরে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বিশাল ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতা। সেখানে শতাধিক প্রতিযোগী ঘোড়া নিয়ে অংশ নেন। মোট তিনটি ক্যাটাগরিতে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এ ক্যাটাগরিতে ৩৪, বি ক্যাটাগরিতে ২৭ ও সি ক্যাটাগরিতে ৫৪ জন ঘোড়া নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। তিনটি গ্রুপে তিনজন করে মোট ৯টি পুরস্কার প্রদান করা হয়। পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয় একটি গরু ও আটটি ছাগল।
মোহনপুরের ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজক আব্দুল মান্নান জানান, "গতবছর থেকে আমরা এই ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করছি। উত্তরবঙ্গে একদিনের প্রতিযোগিতার মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতা এটি। এটা আয়োজন করতে আমাদের তিন লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। প্রত্যেক প্রতিযোগীসহ যারা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন তাদের সবার থাকা-খাওয়া ও যাওয়া-আসার টাকা দিতে হয়েছে। তবে টিকিট বিক্রি করে বেশিরভাগ টাকা উঠে গেছে। এছাড়া স্থানীয় সাংসদ ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা চাঁদা দেন। টিকিট হিসেবে চেয়ার ১০০ টাকা ও গ্যারেজ ৫০ টাকা করে বিক্রি হয়েছে।"
আব্দুল মান্নান বলেন, "এই প্রতিযোগিতায় আমার নিজস্ব দুইটি ঘোড়া নিয়ে অংশগ্রহণ করি। এছাড়া বগুড়া থেকে দুইটি ঘোড়া ভাড়া নিয়েও প্রতিযোগিতায় অংশ নিই। আমার মোট চারটি ঘোড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলো। এজন্য দুইজন ঘোড়সওয়ার ভাড়া করেছিলাম। তাদের নাম ডিজে মারুফ ও ডিজে সজীব। তাদেরকে একটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়।"
আব্দুল মান্নান আরও জানান, মোহনপুর ছাড়াও রাজশাহীর তানোর ও বাগমারায় প্রতিবছর ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় শীতকালীন মৌসুমে ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।
তিনি বলেন, "আমি উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিই। বাপ-দাদাদের আমল থেকেই আমাদের বাড়িতে ঘোড়া ছিলো। ছোটবেলা থেকেই আমি বাবার সাথে বিভিন্ন জেলায় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে যেতাম। তবে তখন ছোট পরিসরে, ২০ থেকে ৩০টি ঘোড়া নিয়ে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। বেশিরভাগ প্রতিযোগিতা হতো দিবসকেন্দ্রিক। এখন বড় পরিসরে এই ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।"
আব্দুস সালাম নামের ষাটোর্ধ্ব আরেক ঘৌড়দৌড় ভক্ত জানান, তিনি কোনো খেলায় অংশ না নিলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে খেলা দেখতে যান। তিনি এই খেলাটিকে দারুণভাবে উপভোগ করেন। সাধারণত শখের বসেই তিনি বিভিন্ন স্থানে খেলা দেখতে যান। বাবার আমল থেকেই তাদের বাড়িতেও ঘোড়া রয়েছে বলে জানান তিনি।
রাজশাহীর তানোরের দরগাডাঙ্গায় চার বছর ধরে ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করে এবার মেম্বার পদে নির্বাচিত হয়েছেন নজিম উদ্দীন। তার নির্বাচনী পোস্টারে লেখা ছিলো, 'নজিম উদ্দীন নাজিম ঘোড়াওয়ালা।'
তিনি জানান, "কয়েক বছরে ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আমি এ বছর মেম্বার পদে নির্বাচিত হয়েছি। এলাকার মানুষের ভালোবাসা আমাকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করেছে।"
তিনি জানান, "গত বছর ডিসেম্বরের ২২, ২৩ ও ২৪ তারিখ তিন দিনব্যাপী দরগাডাঙ্গায় এবং ২৬ ও ২৭ তারিখে কোয়েলহাটে ঘৌড়দৌড়ের আয়োজন করি। দরগাডাঙ্গায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার মানুষের উপস্থিতি ছিল। খেতের খোলা মাঠে এক কিলোমিটার জায়গায় এ খেলার আয়োজন করা হয়। ৮৫টি ঘোড়া তিনটি ক্যাটাগরিতে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। পুরো খেলাটি বিনামূল্যে দর্শকদের দেখানো হয়। তবে আয়োজন করতে যে টাকা খরচ হয় তার সিংহভাগ দেন স্থানীয় সাংসদ ওমর ফারুক চৌধুরী ও উপজেলা চেয়ারম্যান লুৎফর হায়দার রশীদ ময়না।"
বগুড়ার শেরপুরে তিন দিনব্যাপী যে ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় তার আয়োজক মামুন খান। তিনি জানান, তার প্রতিযোগিতায় কমপক্ষে ২০০ জন ঘোড়া নিয়ে অংশ নেয়। পয়েন্টের ভিত্তিতে খেলা হয়। প্রথম যিনি হন তাকে লক্ষাধিক টাকা মূল্যের পুরস্কার দেওয়া হয়। গ্রামের খোলা মাঠে এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সাধারণত রেসের দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করা হয় এক কিলোমিটার। তারা বিনামূল্যে দর্শকদের জন্য খেলাটি আয়োজন করে থাকেন। তবে প্রতিযোগীদের ঘোড়ার খাদ্য, তাদের যাওয়া-আসা ও থাকার খরচ আয়োজক কমিটিই প্রদান করে থাকে।
মামুন খান দাবি করেন, তার ঘোড়াটি বর্তমানে দেশের মধ্যে বলশালী ও স্বাস্থ্যবান ঘোড়া। তার ঘোড়াটির দাম ৮ লাখ টাকা। তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম পুরস্কার জিতে নিয়েছেন। দশবছর ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন তিনি। একাধিক ঘোড়সওয়ারও তৈরি করেছেন, যারা বিভিন্নস্থানে দৃষ্টিনন্দন খেলা উপহার দিয়েছেন।
শিশুদের জকি হিসেবে ব্যবহার
ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হন শিশু জকিরা। অথচ শিশুদের এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতায় জকি হিসেবে ব্যবহার রোধ করতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে। প্রশাসনের অনুমতি নেওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ আয়োজকরাই অনুমতি নেন না। প্রধানত স্থানীয় সাংসদ ও চেয়ারম্যানরা এসব ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতার প্রধান অতিথি থাকেন বলে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না আয়োজকরা। বরং সাংসদরা অতিথি হিসেবে থাকেন বলে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত থাকেন।
রাজশাহীর তানোর, মোহনপুর ও বাগমারায় বড় ঘৌড়দৌড়ের আয়োজন করা হয়। কিন্তু আয়োজকদের কেউ অনুমতি নেন না। রাজশাহীর তানোরের দুইটি স্থানে প্রতিবছর ঘৌড়দৌড় অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে পুরস্কার দেন সেই এলাকার স্থানীয় সাংসদ ওমর ফারুক চৌধুরী।
রাজশাহীর মোহনপুরেও বড় পরিসরে ঘৌড়দৌড়ের আয়োজন করা হয়। সেখানেও স্থানীয় সাংসদ ও চেয়ারম্যানেরা উপস্থিত থাকেন।
মোহনপুরের ঘৌড়দৌড়ের আয়োজক আব্দুল মান্নান জানান, "ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রায়ই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটে। গতবছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমার ঘোড়াই দুর্ঘটনার শিকার হয়। দুর্ঘটনায় ঘোড়সওয়ারের হাত ভেঙে যায়।"
তিনি আরও জানান, তবে অনেক ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতায় দুর্ঘটনার শিকার হলেও কেউ মারা যায়নি।
অনুমতি নেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জেলা প্রশাসকের অনুমতি নেওয়ার কথা থাকলেও যেহেতু প্রধান অতিথিই থাকেন স্থানীয় সাংসদ ও চেয়ারম্যানরা তাই অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। বরং সাংসদ থাকায় প্রশাসনের পক্ষ থেকেই নিরাপত্তার জন্য আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়।
একই কথা জানালেন দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া বগুড়ার মামুন খান। তার দুইটি ঘোড়ার জন্য ডিজে মারুফ ও ডিজে সজীব নামের দুইজন শিশু ঘোড়সওয়ার রয়েছে।
মামুন খান জানান, তার ঘোড়া শুধু গতবছর টাঙ্গাইলে দুর্ঘটনার শিকার হয়। তাতে তার ঘোড়সওয়ারের বুকে আঘাত লাগে। এছাড়া বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। তবে অন্যান্য ঘোড়সওয়ারের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানান তিনি।
রাজশাহী পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন জানান, ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতা আয়োজন করলে অবশ্যই অনুমতি নিতে হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হয় বলে আয়োজকরা অনুমতি নেন না।
ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতায় শিশুদের জকি হিসাবে ব্যবহারের প্রশ্নে তিনি বলেন, "আইনত আয়োজকরা শিশুদের ব্যবহার করতে পারেন না। কারণ আমাদের আইনে সুপষ্টভাবে রয়েছে শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। তারপরও তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা ঠিক না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের অজ্ঞাতে ঘৌড়দৌড়ের আয়োজন করা হয় বলে জানতেও পারি না।"
বর্তমানে বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলায় ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সিরাজগঞ্জের তিনটি স্থানে এখন খেলা চলছে। একাধিক স্থানে খেলা চললেও সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসন এ ব্যাপারে কিছুই জানে না। সিরাজগঞ্জ জেলার জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহাম্মদ বলেন, "আমরা এ বিষয়ে কিছুই জানি না। খোঁজ নিয়ে দেখি।"