জিপিএইচ ইস্পাতে শ্রমিকের মৃত্যু: নিহত রনজিতের ১৫ দিন বয়সী সন্তান কোলে নিয়ে স্ত্রীর বিলাপ থামছে না
সদ্যোজাত পুত্রসন্তানের ভরণপোষনের জন্য দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরিতে জিপিএইচ ইস্পাত কারখানায় কাজ নিয়েছিলেন রনজিত দাশ। গত আট জানুয়ারি থেকে কার্টারম্যান হিসেবে কাজ শুরু করে স্বপ্ন দেখেছিলেন সুন্দর ভবিষ্যতের। কিন্তু জিপিএইচ ইস্পাত কারখানায় দুর্ঘটনায় অঙ্গার হয়ে ভেঙে গেছে তার সেই স্বপ্ন। সন্তানের জন্মের ১৪ দিনের মাথায় তিনি পাড়ি দিয়েছেন পরপারে।
বৃহস্পতিবার (২৭ জানুয়ারি) দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সুলতানা মন্দির এলাকায় জিপিএইচ ইস্পাত কারখানায় কাজ করতে গিয়ে বিস্ফোরণের ঘটনায় ঘটনাস্থলেই মারা যান রনজিত দাশ (৩০)। পরে লাশ উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে শুক্রবার দুপুরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কুমিরা ইউনিয়নের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য, স্বামীকে হারিয়ে শিশুসন্তানকে নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় রয়েছেন রনজিতের স্ত্রী রীমা রানী। কীভাবে তার সংসার চলবে, একমাত্র সন্তানের ভবিষ্যত কী হবে, এমন প্রশ্ন তাকে সান্ত্বনা দিতে আসা স্বজন প্রতিবেশীদের কাছে।
রনজিতের ষাটোর্ধ বাবা শ্রীদাম, মা লক্ষীরানী দাশও পুত্র হারানোর শোকে মুহ্যমান।
রনজিত দাশের পিতা শ্রীদাম বলেন, 'আমার চার মেয়ে এবং এক ছেলে। গত ৮ জানুয়ারি থেকে জিপিএইচ ইস্পাত কারখানায় দৈনিক আট ঘণ্টা ৬০০ টাকা মজুরিতে কার্টারম্যান হিসেবে চাকরি নেয়। নিয়তির নির্মম পরিহাস, চাকরির এক মাস যাওয়ার আগেই আমার ছেলে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেল।'
তিনি আরও বলেন, 'পরিবারের উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। কীভাবে পরিবারের খরচ চলবে আমার জানা নেই।'
রনজিত দাশ ২০২১ সালের মার্চে রীমা রানীকে বিয়ে করেন। গত ১৪ জানুয়ারি তাদের কোলজুড়ে আসে পুত্র সন্তান। জন্মের আট দিন পর ছেলের নাম রাখেন অয়ন দাশ।
রনজিত দাশের স্ত্রী রীমা রানী বলেন, 'সন্তানের বাবা ডাক শুনে যেতে পারল না আমার স্বামী । এখন এই সন্তানের ভবিষ্যত কী হবে আমার জানা নেই। এই সন্তানকে নিয়ে এখন আমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াব?'
নিহত রনজিতের লাশ ময়নাতদন্তের পর শুক্রবার দুপুরে নিয়ে যাওয়া হয় তার বাড়ির পাশের শ্মশানে। সেখানে রনজিতের লাশ ঘিরে তার মা, চার বোন এবং প্রতিবেশীদের বিলাপে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
এটি নতুন নয়, গত ছয় বছরে কারখানাটিতে ১৩ টি দুর্ঘটনায় ৮ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এই সময়ে আহত হয়েছে কমপক্ষে ৩৩ জন শ্রমিক ও কারখানার কর্মকর্তা।
এসব দুর্ঘটনায় মালিকপক্ষের গাফিলতি ও শ্রম আইন লঙ্ঘন পায় কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর।
এর আগের ঘটনাগুলোতে জিপিএচ ইস্পাতের শ্রম আইনের ৭টি ধারা লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া যায়। সেগুলো হচ্ছে, জিপিএইচ ইস্পাত কারখানায় লাইসেন্সবিহীন ঠিকাদার কর্তৃক শ্রমিক সরবরাহ করা হয়। কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের নিয়োগপত্র ও ছবিসহ পরিচয়পত্র সরবরাহ করা হয় না। কারখানায় লিফট, স্কেল, এক্সকেভেটর ক্রেন অদক্ষ চালক দ্বারা পরিচালনা করা হয়। বছরে কমপক্ষে একবার মেশিনগুলো পরীক্ষা করে দেখার নিয়মও মানা হয় না। নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরিতে বিধি মোতাবেক সেইফটি কমিটি গঠন ও কার্যকর করা হয়নি। বিপজ্জনক কাজে কর্মরত শ্রমিকদের দুই ঘণ্টা পরপর বিশ্রাম দেওয়া হয় না।
এসব নিয়ে মামলা হলেও মাত্র ৫০০ টাকা জরিমানা দিয়ে পার পায় প্রতিষ্ঠানটির মালিকপক্ষ। মামলা দায়ের করা হলেও একের পর এক দুর্ঘটনায় এই কারখানায় শ্রমিকের প্রণহানির ঘটনা ঘটছে।
এবারের দুর্ঘটনার বেলায়ও কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত না করার প্রমাণ পেয়েছে শ্রম অধিদপ্তর।
দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে এখনো অস্পষ্টতা
বৃহষ্পতিবার দুপুরে বিস্ফোরণে রনজিতের মৃত্যু হলেও কীসের বিস্ফোরণ হয়েছিল, তা এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি কারখানা মালিক, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। শুরুতে এটিকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা বলা হলেও এ বিষয়ে কোন সুষ্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়নি কোন পক্ষ থেকে। এই দুর্ঘটনা সম্পর্কে অবগত নয় ফায়ার সার্ভিসও ।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের উপ পরিচালক নিউটন দাস বলেন, 'এই দুর্ঘটনা সম্পর্কে আমরা অবহিত নই।'
অন্যদিকে কুমিরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনও অবগত নয় বলে জানিয়েছে স্টেশনটির ডিউটি অফিসার মো. তানজিদ মিয়া।
এ বিষয়ে শুক্রবার বিকেলে জিপিএইচ ইস্পাতের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমাস শিমুলের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে আমরা ৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করেছি।'
জিপিএইচ ইস্পাত কারখানায় দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী লক্ষণ বলেন, 'ড্রামের ভেতর লোহাজাতীয় একটি বল ছিলো। এটি বোমা হতে পারে। রনজিত যখন এটি কাটা শুরু করে তখন আগুনের তাপে এটি বিস্ফোরিত হয়। ড্রামের ভিতরে কী ছিলো আমরা নিশ্চিত নই। বিস্ফোরণের পর রনজিত উডে গিয়ে প্রায় ১০ হাত দূরে পড়ে। কারণ বিদেশ থেকে আসা স্ক্র্যাপে প্রায় সময় বোমাজাতীয় বস্তু পওেয়া যায়।'
লক্ষণ আরও জানান, 'জিপিএইচ ইস্পাত কারখানায় শ্রমিকের সেইফটি নিশ্চিত করা হয় না। তার সাথে যদি একজন হেলপার থাকত, তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটত না।'
এদিকে ২০১৪ সালে জিপিএইচ ইস্পাত কারখানায় আমদানিকৃত স্ক্র্যাপে তাজা গ্রেনেড পাওয়া যায়।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপমহাপরিদর্শক আবদুল্লাহ আল সাকিব বলেন, এই ঘটনায় রবিবার জিপিএইইচ ইস্পাতকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে।