‘কাঁচা দুধের মহিষা দই’ ছাড়া লক্ষ্মীপুরে কোনো বিয়ে হয় না!
বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে মহিষের কাঁচা দুধের টক দই খুবই জনপ্রিয়। এই দই সুস্বাদু এবং ঐতিহ্যবাহী স্থানীয় খাদ্য হিসেবে স্বীকৃত। উপকূলীয় অঞ্চলে এ দই ছাড়া সামাজিক কোনো অনুষ্ঠান একেবারেই হয় না। উপকূলীয় অঞ্চলে মানুষের দৈনন্দিন আতিথেয়তার সঙ্গেও মহিষের দুধের টক দই জড়িয়ে রয়েছে যুগ যুগ ধরে। যত দিন গেছে এর সমাদর ও চাহিদা দুটোই বেড়েছে। কিন্তু ব্যাপক চাহিদার বিপরীতে নানা কারণে উৎপাদন কমছে। এই অভিমত তিন যুগ ধরে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল ঘুরে কাজ করা সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম মন্টুর।
উপকূলীয় লক্ষ্মীপুর জেলায় দৈনিক ১০ টনের বেশি এবং বছরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার টন মহিষা দই উৎপাদিত হয়। আর এ বিপুল পরিমাণ দই প্রস্তুতে বছরে প্রায় চার হাজার টন মহিষের কাঁচা দুধ প্রয়োজন হয়।
দই তৈরির দুধ আসে জেলার পশ্চিম ও দক্ষিণের মেঘনা নদীর দ্বীপ ও চর সমূহের মহিষের বাথান থেকে। বর্তমানে মহিষা দইয়ের চাহিদা অত্যন্ত বেশি, কিন্ত মহিষের সংখ্যা দিন দিন কমছে ফলে দুধের উৎপাদনও কমে গেছে। স্থানীয় দই বিক্রেতা, দুধ ব্যবসায়ী, মহিষের বাথান মালিক এবং পশু সম্পদ কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেও এমন তথ্য জানা গেছে।
জেলাজুড়ে দধি বিক্রেতা সুমন ও পাইকারি দুধ বিক্রেতা কাশেমের কাছ থেকে পাওয়া হিসেবে দেখা যায়, জেলার প্রায় ৪০টি ছোট-বড় হাটে দেড় শতাধিক দই বিক্রির দোকান রয়েছে। অনেকে যুগ যুগ ধরে দই বিক্রি করে আসছেন। এর মধ্যে রামগতি উপজেলা মহিষা দইয়ের জন্য পুরো জেলায় সুখ্যাত। বর্তমানে এ অঞ্চলে প্রতি কেজি দই বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৫০ টাকা কেজি দরে, তাতে দৈনিক প্রায় ১০ টন দই বিক্রি হয়। যার বাজারমূল্য কমপক্ষে ১৩ লাখ টাকা। এ হিসেবে বছরে ৫০ কোটি টাকার বেশি আসে দই বেচাকেনা থেকে।
লক্ষ্মীপুর জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্যমতে, জেলার ১২টি দ্বীপ চর ও মূল ভূখন্ডের চরে প্রায় ২০ হাজার মহিষ পালন করা হয়। কিন্ত মহিষের বাথান মালিকদের দেয়া তথ্যে দ্বীপ, চর ও মূল ভূখন্ড সংশ্লিষ্ট চরসমূহে মহিষের সংখ্যা হবে প্রায় ৪০ হাজার।
স্থানীয়রা জানায়, মহিষের দধি স্থানীয়ভাবে 'মহিষা দই' নামে পরিচিত। লক্ষ্মীপুরের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের ৪ উপজেলার অধিবাসীদের যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান মহিষা দই ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। সারা বছর সমানতালে মহিষা দই বিক্রি হয়। তবে বিভিন্ন উৎসব এলে এর চাহিদা আরও বেড়ে যায়।
জানুয়ারি মাসের শেষ বুধবার জেলার তোরাবগঞ্জ বাজারের ইসমাঈল দধি বিতানে এসে মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানের অতিথিদের জন্য ৫০ কেজি দধির অগ্রিম অর্ডার করেন মো. ওলি উল্লাহ নামের এক ব্যক্তি। ওলি উল্লাহ জানান, দু'শ অতিথি তার বাড়িতে আসবেন। সেজন্য অনুষ্ঠানের দুই দিন আগে এসে ৫০ কেজি মহিষা দই অর্ডার করেছেন।
এসময় দধি বিক্রেতা ইসমাঈল জানান, এ অঞ্চলে যে কোন দাওয়াতে মেহমানের জন্য জনপ্রতি কমপক্ষে ২৫০ গ্রাম দধি বরাদ্দ থাকে এবং সেটা বাধ্যতামূলক। সে হিসেব করে তিনি ক্রেতাদের কাছ থেকে দইয়ের অর্ডার নেন। মহিষা দধি না দেওয়ার কারণে কয়েকটি বিয়েতে মারপিটের ঘটনার কথাও জানান ইসমাঈল। ইসমাঈল জোর দিয়ে বলেন, অনুষ্ঠানে মহিষা দই লক্ষ্মীপুরের কিছু এলাকার মানুষের রক্তে মিশে গেছে।
ইসমাঈলের মাঝারি আকারের একটি দোকানে দৈনিক গড়ে ১২০-১৫০ টাকা দরে ২০০-২৫০ কেজি দধি বিক্রি হয়। দুধের দাম ওঠানামার সাথে দইয়ের দামও কমবেশি হয়। অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে দই বিক্রি হলেও, দইয়ের সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য। ইসমাঈল মাসে কমপক্ষে ২০-২৫টি বিয়েতে দই সরবরাহ করেন। গত ১৭ বছর যাবত তিনি এ ব্যবসার সাথে জড়িত। এর আগে তার বাবা ৫০ বছর দইয়ের ব্যবসা করে গেছেন বলেও জানান তিনি।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মতিন ডেকোরেটরের প্রধান বাবুর্চি মোঃ আবদুল মতিনের সাথে কথা হয় সামাজিক অনুষ্ঠানে দধির উপস্থিতি নিয়ে। তিনি জানান, মাসে প্রায় শতাধিক অনুষ্ঠানে তিনি সার্ভিস দেন। লক্ষ্মীপুরে দইবিহীন কোন অনুষ্ঠান হয় বলে তার জানা নেই। এ প্রসঙ্গে মতিন জানান, জেলার উত্তরাঞ্চলে চলে পাউডার দুধের মিষ্টি দই। কিন্ত দক্ষিণাঞ্চলের রামগতি, কমলনগর, সদর ও রায়পুর উপজেলার পশ্চিমাঞ্চলে বিয়ের অনুষ্ঠানে মেহমানদের জন্য টক দই বাধ্যতামূলক থাকতেই হবে। সে অঞ্চলে পাউডার দুধের দই একেবারেই চলে না এবং এমন দই পরিবেশন করাটাও অপমানজনক।
রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডার বাজারে কাশেম দধি বিতানে ২ কেজি ওজনের এক হাঁড়ি দই কিনছিলেন নাসরিন নামের এক গৃহবধূ। কি জন্য দই কিনেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রবাসী বড় দুলাভাইকে নিজেদের বাড়িতে দাওয়াত করেছেন। দুলাভাইয়ের মেহমানদারির জন্য দই কিনেছেন। ওই গৃহবধূ আরো জানান দধি ছাড়া মেহমানদারি অপূর্ণ থাকে।
স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চর আবদুল্লাহ, তেলিরচর, মৌলভীর চর, চর মুজাম, চর আলেকজান্ডার, চর বাদাম, কমলনগর উপজেলার চর কাকঁড়া, মাইজের চর, চর শামছুদ্দিন, সদর উপজেলার চর রমণীমোহন, মেঘারচর, রায়পুর উপজেলার হাজীগঞ্জ, টুনির চর, সাওয়ার চর এলাকা বাথানে মহিষ পালনের জন্য পরিচিত।
জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জানানো হয়, রামগতি উপজেলার বিভিন্ন দ্বীপ ও চরে ৬ হাজার ৩০০, কমলনগরে ৬ হাজার, সদর উপজেলায় ৫ হাজার ৭০০ এবং রায়পুরে ১২০০ সহ জেলায় মোট ২০ হাজার মহিষ পালন করা হয়। তবে স্থানীয় কয়েকজন বাথান মালিক জানান, প্রকৃতপক্ষে সরকারি হিসেবের দ্বিগুণ মহিষ পালন করা হয়। কাদের নামে একজন বাথানি জানান, প্রাণী সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তাদের তারা সঠিক হিসেব দেন না।
মহিষের বাথানের মালিক ও রামগতি উপজেলা যুবলীগের সভাপতি মেজবাহ উদ্দিন ভিপি হেলাল বলেন, রামগতি উপজেলার চর আবদুল্লাহ ইউনিয়নের বিভিন্ন চরের বাথানে তাদের পরিবারের প্রায় দুইশ মহিষ রয়েছে। কয়েক বছর আগে এর দ্বিগুণ মহিষ ছিল। সেখানকার শতাধিক মহিষ দুধ দেয়। বর্তমানে প্রতি কেজি দুধ তিনি ৮০-১০০ টাকায় দই বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছেন।
দুধের পাইকারি ক্রেতা ও বিক্রেতা সুমনের সাথে কথা হয়। তিনি জানান, প্রায় জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপ চরগুলোতে রয়েছে একের পর এক মহিষের বাথান। একেকটি বাথানে কয়েকজন মালিকের শতশত মহিষ যারা দেখাশোনা করে তাদেরকে স্থানীয়রা 'বাতাইন্না' বলে। ঘাস খাওয়ানোর পর বাতাইন্নারা চরের মধ্যে উঁচু মাচান কিংবা টংঘরের কাছাকাছি মহিষ জড়ো করে রাখে। যে মহিষ দুধ দেয় সেগুলোর দুধ দোহন করে জমা করে রাখে বাতাইন্নারা। প্রতিটি মহিষ কমপক্ষে ২ থেকে ৩ লিটার দুধ দেয়। নদীর জোয়ার-ভাটা অনুসরণ করে দুধ ক্রেতারা সে দুধ চর থেকে নৌকায় করে নিয়ে এসে দধি উৎপাদনকারীদের কাছে বিক্রি করে।
বাথানের মালিক রামগতি উপজেলার শাখাওয়াত হোসেন মিয়া জানান, 'চরাঞ্চলে মানুষের বসত বাড়ার কারণে মহিষের চারণভূমি কমছে। ঠিকমতো ঘাস পাচ্ছে না, ফলে দুধ কমে যাচ্ছে। সে কারণে অনেকে মহিষ পালন ছেড়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে দুধের জোগানের চেয়ে দধির চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে।'
দুধ থেকে কিভাবে দধি তৈরি হয় তা জানাতে গিয়ে দই বিক্রেতা সেলিম জানান, চর থেকে দুধ আনার পর কাঁচা দুধ সরাসরি ১ থেকে ২ কেজি সাইজের এক ধরনের পাত্রে ঢালা হয়। এ পাত্রগুলোকে টালি বলে। টালিতে কাঁচা দুধ রাখার ১৫-১৬ ঘণ্টা পর দুধ জমে দই হয়। প্রতি লিটার দুধে ৯৫০ গ্রাম দই হয়। এ দই ফ্রিজিং ছাড়া এক সপ্তাহ পর্যন্ত ভালো থাকে। দই বসানোর টালিগুলো আসে পটুয়াখালী, বরগুনা ও পিরোজপুর থেকে। বর্তমানে সাইজ ভেদে প্রতিটি টালির দাম ১৬-২০ টাকা। মহিষা দধি থেকে মাখন, ঘি ও ঘোল বানানো গেলেও লক্ষ্মীপুরে তা তৈরি হয় না।
মহিষের টক দই সর্ম্পকে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডাঃ জোবায়ের হোসেন বলেন, অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু মহিষা দই লক্ষ্মীপুর জেলার একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। খাওয়ার পর মহিষা দই পরিবেশন করা এখানকার বহুদিনের রেওয়াজ। শত বছরের রীতি বলা যায়। জেলায় প্রতিদিন ১০ টনের বেশি মহিষের দই উৎপাদন হচ্ছে। মহিষের দইয়ের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় মহিষ ও দুধের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য জেলা প্রাণীসম্পদ বিভাগ খামারি ও বাথান মালিকদের নানাভাবে সহযোগিতা করার চেষ্টা করছে। ভবিষ্যতে মহিষ পালন বাড়ানোর মাধ্যমে দইয়ের বিপুল চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে বলে তিনি আশাবাদী।