চট্টগ্রামে খালপাড়ের হাজারো অবৈধ স্থাপনা ঝুঁকির মুখে
চট্টগ্রাম নগরীর মাঝিরঘাট পার্বতী ফকিরপাড়া এলাকার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে গুলজার খাল। গত বছরের ২০ ডিসেম্বর রাতে খালপাড়ের দুটি ভবন হেলে পড়ে। এ ঘটনার সাত মাস আগে পাশের আরও একটি ভবন হেলে পড়েছিল। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের খাল খননের কাজ করতে গিয়ে এসব ঘটনা ঘটে।
শুধু গুলজার খাল নয়, চট্টগ্রামের ৫৭টি খালে সবকটির পাশে রয়েছে এমন হাজারো অবৈধ স্থাপনা। চট্টগ্রামের ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স কর্মকর্তারা বলছেন, খালপাড়ের অবৈধভাবে গড়ে ওঠা স্থাপনাগুলো নানামুখী ঝুঁকিতে রয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী, খাল থেকে ১২ ফুট দূরে স্থাপনা নির্মাণের বিধান রয়েছে। কিন্তু তদারকির অভাবে খালের পাড় দখল করে স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব স্থাপনার মধ্যে রয়েছে- মার্কেট, দোকান-পাট, মসজিদ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, আবাসিক ও বাণিজ্যিক বহুতল ভবন। নির্মাণে যথাযথ নকশা ও নিয়ম না মানায় ঝুঁকিতে আছে খালপাড়ের এসব স্থাপনা; যেখানে বসবাস করছেন কয়েক লাখ মানুষ।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক মো. ফারুক হোসেন সিকদার বলেন, "খালপাড়ের অবৈধ স্থাপনাগুলো নানামুখী ঝুঁকিতে রয়েছে। এতো ঘিঞ্জি পরিবেশ যে, কোনো দুর্ঘটনা হলে উদ্ধার অভিযান চালানোর মতোও অবস্থা নেই।"
সিডিএ জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের পরিচালক ও সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. শাহ আলী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "খালপাড়ের অবৈধ স্থাপনাগুলো সবার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। খাল খননের জন্য মাটি তুললে ভবন ধসে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে খাল খনন কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরাও ঝুঁকিতে পড়ছেন। সিডিএকে চিঠি দিয়ে বিষয়গুলো অবহিত করা হয়েছে।"
চট্টগ্রাম ওয়াসার ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, এই শহর ও আশপাশের ছোট-বড় মিলিয়ে ৫৭টি খাল রয়েছে। এসব খাল সংস্কার ও দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। ৪ বছর আগে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় ৩৬টি খাল খননের জন্য বুঝে নেয় সিডিএ। খননের সময় খালপাড়ের অবৈধ স্থাপনা কিছুটা উচ্ছেদ হচ্ছে। তবে বাকি ২১টি খাল সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। তবে খালপাড়ে কী পরিমাণ অবৈধ স্থাপনা রয়েছে এ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেনি সংস্থাগুলো।
চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, "ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয় সিডিএ। তাই অনুমোদনহীন ভবন উচ্ছেদের দায়িত্বও তাদের। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের জন্য ৩৬টি খাল সিডিএকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাকি ২১ খালের সংস্কারের জন্য ডিপিপি প্রণয়ন করা হচ্ছে। তবে সময় লাগবে। প্রকল্প অনুমোদন পেলে তখন অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হবে।"
গত সোমবার সরেজমিনে দেখা যায়, নগরীর ফিরিঙ্গিবাজার কাঁচাবাজার সংলগ্ন ফিরিঙ্গবাজার খাল দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে সানম্যান সরদার ভিলা নামে একটি ১০ তলা ভবন। ভবনটির বেজমেন্টসহ একটি পিলার পড়েছে খালের মধ্যেই। শুধু এ ভবন নয়, আশেপাশে কয়েকশ মিটার এলাকায় অন্তত অর্ধশতাধিক অবৈধ বসতি রয়েছে। সদরঘাট এলাকার সদরঘাট খালের পাড় দখল করে উঠেছে হোটেল আল হালিমের পাঁচতলা ভবন। এর অপর পাশেও রয়েছে কয়েকটি বহুতল ভবনসহ অন্তত ২০টি বসতি।
মাঝিরঘাট এলাকায় গুলজার খালের পাড় দখল করে একটি মন্দিরসহ অর্ধশতাধিক বসতি গড়ে উঠেছে। চাক্তাই খালের ফিশারিঘাট পয়েন্ট থেকে উজানে প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকায় ডজনখানেক বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। এর একটি ৯ তলা বিশিষ্ট মান্নান মার্কেট। পাশাপাশি গড়ে উঠেছে আরও অনেক অবৈধ স্থাপনা।
রাজাখালী খালের ওপর ছয়তলা ভবন করে পরিচালিত হচ্ছে জেপিআই গার্মেন্টস কারখানা। রাজখালী খালের ওই পয়েন্ট থেকে বাকলিয়া থানা পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মার্কেটসহ বেশ কয়েকটি বহুতল ভবন তৈরি হয়েছে। নগরীর প্রবর্ত্তক এলাকায় রয়েছে বেসরকারি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ভবন।
খুলশী এলাকায় গয়নাছড়া খালের ওপর ১৮ তলা একাডেমিক ভবন করেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউএসটিসি। যদিও এটি নিয়ে আদালতে মামলাও চলছে। হালিশহরের বসুন্ধরা আবাসিক এলাকাতে মহেশখালির ওপর রয়েছে বহুতল ভবন। অবৈধ এসব ভবনের কিছুর অনুমোদনই নেই। আবার অনুমোদিত নকশা পরিবর্তন করে হয়েছে কিছু ভবন। এখন এসব ভবন ভাঙতে গেলে কেউ কেউ যাচ্ছেন আদালতে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, "খালপাড়ের মাটি স্বাভাবিকভাবে নরম হয়। অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের সময় যথাযথভাবে মাটি পরীক্ষা এবং নকশা করা হয় না। এ দুই কারণেই ভবনগুলো ঝুঁকিতে থাকে। ভূমিকম্প হলে এসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ধসে পড়তে পারে।"
নগরীতে ভবন নির্মাণের যাবতীয় অনুমোদন দেয় নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। এজন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) আট ধাপের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। সেগুলো হলো- ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র, নির্মাণ অনুমোদন, নির্মাণকাজ শুরু অবহিতকরণ ও কারিগরি ব্যক্তিদের সম্মতিপত্র, ভবনের ভিত্তিস্তম্ভ পর্যন্ত কাজ সম্পর্কে কারিগরি ব্যক্তিদের প্রতিবেদন, ভবন নির্মাণকাজ সমাপ্তি অবহিতকরণপত্র, কারিগরি ব্যক্তিদের প্রত্যয়নপত্র ও ব্যবহার সনদপত্র।
এছাড়া ৫ বছর পরপর নবায়ন করতে হয় সিডিএ'র ব্যবহার সনদপত্র। এতোসব আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মধ্যেও অবৈধ ভবন গড়ে ওঠায় সিডিএ'র তদারকি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিডিএ'র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, "ভবন নির্মাণের আগে এক ধরনের নকশা অনুমোদন নেয়া হলেও নির্মাণ হয় অন্যভাবে। লোকবল সংকটের কারণে সবকিছু তদারকি করা সম্ভব না। তবুও খাল খননের সময় প্রায় ৩ হাজার ৬০০ এর মতো অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে।"