ঐতিহ্য সংরক্ষণ করেই পুরান ঢাকার পুনঃউন্নয়ন সম্ভব: বিশেষজ্ঞ
পুরান ঢাকার ঐতিহ্য সংরক্ষণ করেই এলাকাটির পুনঃউন্নয়ন সম্ভব বলে জানিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদগণ ও বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেন, পুরান ঢাকার সকল স্থাপনাই ঐতিহাসিক স্থাপনা নয়, তাই ঐতিহাসিক স্থাপনাসহ ঐতিহ্যগুলো সংরক্ষণ করেই পুনঃউন্নয়ন সম্ভব। এতে যেমন পুরান ঢাকার জরাজীর্ণ স্থাপনাগুলোর মালিকরা আগের থেকে বড় পরিসরে ফ্ল্যাট পাবেন, তেমনি নাগরিক সুবিধা সম্বলিত পাবলিক প্লেসও গড়ে তোলা সম্ভব।
শনিবার রাজধানীর সিরডাপ ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টারে অনুষ্ঠিত 'পুরান ঢাকার ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও পুনঃউন্নয়নঃ কর্তৃপক্ষের করণীয় ও বিশেষজ্ঞ ভাবনা' শীর্ষক একটি সেমিনারে বক্তারা একথা জানান।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) (২০১৬-২০৩৫) প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম।
তিনি বলেন, "ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো সংরক্ষণ করে অন্যসব জরাজীর্ণ স্থাপনার মালিকদের একত্রিত করে পুনঃউন্নয়নের দিকে এগোতে হবে আমাদের। পুরান ঢাকার বিভিন্ন ঐতিহ্য সমৃদ্ধ স্থাপনা ও স্থান যদি আমরা সংরক্ষণ করতে পারি এবং সবার সাথে সমন্বয় করে পুনঃউন্নয়ন করতে পারি, তবে উন্নত শহরগুলোর মতো উন্নয়ন পুরান ঢাকাতেও করা সম্ভব।"
তিনি বলেন, "জাপান পুনঃউন্নয়ন করে তাদের পাবলিক প্লেস বৃদ্ধি করেছে। সাথে তারা আগের থেকে বড় স্পেসের এপার্টমেন্টও এবং খোলা স্থানসহ অন্য সুবিধাও পেয়েছে। আগে পুরান ঢাকায় ৮ ফুট রাস্তার অনুমোদন দেওয়া হতো কারণ তখন মানুষ পায়ে হেঁটে চলাচল করতো কিন্তু এখন তো সেই প্রস্থের রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচল সম্ভব নয়।"
তিনি আরও বলেন, পুরান ঢাকার আর একটি বড় সমস্যা হচ্ছে অনেক জমিরই মালিক নেই। অনেকেই খাস জমিতে বসবাস করে আসছেন। এসব জমিতে উন্নয়ন করার আগে মালিকানা নির্ধারণ করা জরুরি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, "পুরান ঢাকায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ট্রাফিক সিস্টেম। রাস্তার পরিধি বাড়ানো যদি না যায় তবে বিভিন্ন দেশের শহরগুলোর মতো সরু রাস্তার জন্য সে অনুযায়ী যান তৈরী করতে হবে। ঢাকায় নতুন নতুন প্রকল্প নিয়ে যেমন সরকার ভাবছে তেমনি পুরান ঢাকার ঐতিহ্য রক্ষার ক্ষেত্রেও ভাবতে হবে।"
ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য যে নীতিমালা প্রয়োজন সেগুলো সংশোধন করে বাস্তবায়নের আহবান জানান এ স্থপতি।
বিআইপির সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, "আমাদের প্রথমে ঐতিহ্য সমৃদ্ধ ভবনগুলোর সংখ্যা নিশ্চিত করে সেগুলো সংরক্ষণ করে বাকি উন্নয়ন করতে হবে। সিটি কর্পোরেশন, রাজউকসহ প্রতিটি সেক্টরে নগর পরিকল্পনাবিদ থাকা দরকার। কিন্তু আমাদের নামেমাত্র নগর পরিকল্পনাবিদ রয়েছে। যে ধরনের প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুরকে গঠন করেছে, সেই ধরনের প্রতিষ্ঠান কি আমাদের আছে? কোনো ইউটিলিটি সেক্টরের নগর পরিকল্পনাবিদরা কাজ করছে না।"
তিনি আরও বলেন, পুরান ঢাকার বিজনেস সেক্টরগুলোকে অর্গানাইজড করতে হবে।
আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম বলেন, "একদিকে ঐতিহ্যের কথা বলা হচ্ছে, আরেক দিকে জরাজীর্ণ ভবনের কথা বলা হচ্ছে। জরাজীর্ণ ভবনের কথা বলে করোনার সময় অনেক ভবন ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ২০০৯ সালে সরকারের তালিকা অনুযায়ী, ঐতিহ্যবাহী ভবন ৯৪টি। আবার ২০১৭ সালের তালিকা অনুযায়ী ভবন ৭৫টি, কিন্তু ভবন রয়েছে ১ হাজার ৮৩১টি। তাই সেই তালিকা ঠিক করা উচিত।"
ভবন না ভেঙেও সংরক্ষণ করা যায় জানিয়ে তাইমুর ইসলাম বলেন, "সমন্বিতভাবে কাজ না করলে এই ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা যাবে না। রাজউক তার মতো ভাবছে, সিটি করপোরেশন তার মতো ভাবছে এবং প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ তার মতো ভাবছে। প্যারিস, লন্ডনের মতো অনেক শহর আছে, যেখানে আধুনিকতার সব আছে পুরাতন কাঠামোকে রেখে।"
হেরিটেজ বিশেষজ্ঞ স্থপতি মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেন, "বিভিন্ন উন্নত দেশে সরু রাস্তার ক্ষেত্রে কাস্টমাইজড সার্ভিস চালু করেছে। আমাদের পুরান ঢাকা সংরক্ষণে কাস্টমাইজড ভেহিক্যালস তৈরি করা যেতে পারে।"
সেন্টার ফর হাউজিং অ্যান্ড রিসার্চের (এইচবিআরসি) নির্বাহী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবু সাদেক বলেন, "পুরান ঢাকার নদী, খাল, পুকুর অনেক কিছুই ঐতিহ্য। মূল প্রক্রিয়ায় প্রধান বাধা হচ্ছে সরকারের সদিচ্ছা। পুরান ঢাকার ঐতিহ্য সম্বলিত স্থাপনা রেখেই উন্নয়ন সম্ভব।"