ঢেলে সাজানো হচ্ছে কুমিল্লার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা
২০১০ সালের জুলাইয়ে সিটি করপোরেশনের স্বীকৃতি লাভ করে কুমিল্লা শহর। শহরটিতে অসংখ্য পুকুর-দিঘি ছিল। সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর নগরায়ণের প্রভাবে বড় বড় ভবন বাড়তে থাকে। আবাসিক ভবনের পাশাপাশি হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে যায়। সে সাথে বাড়ে যানবাহনও।
কিন্তু দীর্ঘ ১২ বছরেও নগরীর আয়তন বাড়েনি। শহর সম্প্রসারিত না হওয়ায় শিল্প ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতালগুলো শহরের গুটিকয়েক জায়গার মধ্যে গড়ে ওঠে। দিনদিন এসব এলাকায় যান চলাচল কয়েকগুণ বেড়ে যায়। অপরিকল্পিত ভবনের কারণে সড়ক সরু হয়ে আসে। এদিকে অনুমোদনহীন অটোরিকশা, রিকশা, সিএনজি অটোরিকশা, অ্যাম্বুলেন্স বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ও কুমিল্লার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস, বিসিকের পরিবহনের চাপ পড়ে নগরীর প্রধান প্রধান সড়কে।
নগরীর অন্যতম তিনটি বাস টার্মিনাল শাসনগাছা, জাঙ্গালিয়া ও চকবাজারের অবস্থান নগরমুখী। ভবন মালিকদের বেশিরভাগ বাড়তি জায়গা না রেখে সড়কের ওপরে ভবন, বাউন্ডারি ও পার্কিংয়ের জায়গা করেছেন। অনেক হাসপাতাল মালিক অ্যাম্বুলেন্স রাখার জন্য গ্যারেজের ব্যবস্থা করেননি। রাস্তার ধারে গড়ে উঠেছে অসংখ্য অপরিকল্পিত মার্কেট। ফুটপাতগুলো দখল হয়ে গেছে। যার কারণে স্বভাবতই রাস্তাঘাটগুলো ব্লক হয়ে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। নগরীর টমছমব্রিজ, চকবাজার ও শাসনগাছায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থেকে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
আশার কথা, সম্প্রতি নগরীর যানজট কমিয়ে আনতে ছয়টি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন। ২ ফেব্রুয়ারি থেকে পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছে তারা। উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে সমস্যার সামান্য উপশম হবে মনে করেন নগরবাসী।
উদ্যোগগুলো হলো: পুলিশ লাইন-ঝাউতলা বাদুড়তালা কান্দিরপাড়-রাজগঞ্জ-চকবাজার রোডে বা রোডের দুইপাশে ফুটপাতের সকল অবৈধ দোকান, যানবাহন, স্থাপনা ও অন্যান্য সামগ্রী উচ্ছেদ; পূবালী চত্বর থেকে সালাউদ্দিন মোড়, পূবালী চত্বর থেকে মডার্ন স্কুল, কান্দিড়পাড়-সার্কিট হাউজ-মোগলটুলি চৌমুহনী- রাজগঞ্জ রোডে রোডের দুইপাশে ফুটপাতের সকল অবৈধ দোকান, স্থাপনা ও অন্যান্য সামগ্রী উচ্ছেদ; তথা কান্দিরপাড় কেন্দ্রের আশপাশের সকল প্রধান সড়ক ও সড়কের দুইপাশে ফুটপাতের সকল অবৈধ দোকান, যানবাহন, স্থাপনা ও অন্যান্য সামগ্রী উচ্ছেদ।
সকল শপিং কমপ্লেক্স ও মার্কেটের নিচতলায় পার্কিং থাকতে হবে। অন্যথায় যেসব কমপ্লেক্স ও মার্কেটের নিচতলায় পার্কিং নেই বা নিচতলা অন্যকাজে ব্যবহার করা হয় সেসব কমপ্লেক্স ও মার্কেটের নিচতলার সকল মালামাল জব্দ করে পার্কিংয়ের জন্য উন্মুক্ত করার নিমিত্তে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন নিউমার্কেট ও সিটি মার্কেটের বারান্দা ও সামনের সকল দোকানসমূহও যানজট সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলো উচ্ছেদ করা হবে।
রাজগঞ্জ শাপলার মোড় থেকে কান্দিরপাড় মোড় পর্যন্ত একমুখী গাড়ি চলবে। কান্দিরপাড় থেকে কোনো গাড়ি সরাসরি রাজগঞ্জ শাপলার মোড় যেতে পারবে না।ইউনিভার্সিটি, স্কুল-কলেজ বা কোনো সংস্থার বড় বাসগুলো কান্দিরপাড় বা পূবালী চত্বর মোড় ক্রস করতে পারবে না। অন্যত্র পার্কিং করতে হবে যাতে করে ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি না হয়।
অটোরিকশা চলাচল সীমাবদ্ধ করতে হবে। অটোরিকশা কোথাও দাঁড়াতে পারবে না; স্থায়ীভাবে দাঁড়িয়ে থেকে কোনো ব্লক সৃষ্টি করতে পারবে না। কোনো সংগঠন বা সংস্থার পক্ষ কোনপ্রকার তোরণ নির্মাণ করা যাবে না। বিদ্যমান সকল তোরণ উচ্ছেদ করা হবে। সরকার নির্ধারিত ইজারাকৃত বাসস্ট্যান্ড ব্যতীত অন্য কোথাও থেকে সিএনজি অটোরিকশা ও অটোরিকশা থেকে কোনো প্রকার চাঁদা নেওয়া যাবে না। যদি কাউকে অবৈধ চাঁদা উত্তোলনে পাওয়া যায়, তাহলে চাঁদাবাজির মামলাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
গতবছর ভারি বৃষ্টিতে বেশ কয়েকদিনই ডুবে ছিল নগরীর অধিকাংশ এলাকা। ভবনের নিচতলা ও টিনশেড ভবনগুলোতে পানি ঢুকে পড়ে। অতিরিক্ত জলাবদ্ধতার কারণে মাঝেমধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগও বিচ্ছিন্ন রাখতে হয়েছে।
অন্যদিকে শহরে মানুষ বেড়েছে ঠিকই, তবে কর্মসংস্থান সে অনুপাতে বাড়েনি। প্রবাসীদের পরিবার, তাদের স্কুল-কলেজগামী সন্তান ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা ব্যতীত কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা একেবারেই কম কুমিল্লা শহরে। ইপিজেড ও বিসিক ছাড়া শহরে তেমন কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। কুমিল্লায় কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান থাকলেও তা নগর সীমানার বাইরে।
অনুমোদনহীন অবৈধ কিছু ভবন চিহ্নিত করা গেলেও তাদের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি সিটি করপোরেশন। শহরের বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থাপনাতেও তেমন গতি নেই। মানুষের সংখ্যা অনুপাতে পাবলিক টয়লেট নেই বললেই চলে। শহরের ফুটপাত ও রেলস্টেশনে বসবাস করা প্রচুর ভ্রাম্যমাণ মানুষ আছে। ব্যবহারের মতো তেমন শৌচাগার পাচ্ছে না তারা। যার কারণে পথেঘাটে মলমূত্র ত্যাগ করতে হচ্ছে তাদের।
সচেতন নাগরিক কমিটি কুমিল্লার সাবেক সভাপতি বদরুল হুদা জেনু জানান, "নগরীর ফুটপাতের দোকানগুলোকে তুলে দিয়ে সরকারি খাস জায়গায় তাদের জন্য দোকানপাট করে দিতে পারে সিটি করপোরেশন। অনেক শহর ও পৌরশহরে অডিটোরিয়াম আছে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে অডিটোরিয়াম সুবিধা পাচ্ছে না মানুষ। শহরে গাড়ি চলাচলের জন্য নির্দিষ্ট স্ট্যান্ড নেই। মানুষ যে যেভাবে পারছে, গাড়িতে উঠছে-নামছে। শহরের কোথাও জেব্রা ক্রসিং নেই, তাই চলাচলে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হচ্ছে।
আমার পরামর্শ, সিটি করপোরেশনের সদর দক্ষিণ অংশে অনেক খোলামেলা জায়গা আছে। সেখানে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে স্টেডিয়াম, অডিটোরিয়াম ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য মার্কেট গড়ে তোলা হোক। পুকুর-দিঘিগুলোকে ভরাট না করে সংরক্ষণ করা হোক। তাহলে বদলে যাবে শহরের চেহারা।"
এদিকে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুল হক সাক্কু বলেন, "কুমিল্লা সিটি করপোরেশন ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও কার্যক্রম শুরু হতে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময় লেগে যায়। আমি আমার সর্বোচ্চটা দিয়ে নগরবাসীর সমস্যা সমাধানে কাজ করেছি। কিছু ক্ষেত্রে সফল হয়েছি, কিছু ক্ষেত্রে হইনি। এছাড়াও নগরকে পাল্টে দেওয়ার মতো বড় কোনো বরাদ্দ কখনোই আসেনি। সর্বশেষ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের উন্নয়নে ১৫৩৮ কোটি টাকার বাজেট একনেকে পাস করেন। এ বাজেটের সদ্ব্যবহার করতে পারলে শহরের বেশ কিছু সমস্যা দূরীভূত হবে।"
মেয়র আরও জানান, প্রকল্পটির মাধ্যমে ১৫ তলাবিশিষ্ট আধুনিক সেবাসম্বলিত নগরভবন, ৬ তলা বিশিষ্ট দুটি সেবক কলোনি, আঞ্চলিক অফিসগুলোর উন্নয়ন করা হবে। প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য হচ্ছে নগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, যানজট নিরসন, রাস্তাঘাট উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বৃদ্ধিকরণ। পুরাতন গোমতী নদী এলাকাসহ নগরীর বিভিন্ন পুকুরের উন্নয়ন করে ঢাকার হাতিরঝিলের ন্যায় রূপদান করা হবে। দৃষ্টিনন্দন ব্রিজ, নদী শাসন, ড্রেন নির্মাণ, রাস্তাঘাটের আধুনিকায়ন ও আলোকসজ্জার মাধ্যমে নগরীর আধুনিকায়নে এক ধাপ এগিয়ে যাবে কুমিল্লা নগরী। তাছাড়া ১৪৬টি কবরস্থান উন্নয়ন, ৩০৫ কি.মি. রাস্তা নির্মাণ, ২০৩ কি.মি. বিস্তৃত ও প্রশস্ত ড্রেন নির্মাণ, ১৩ কি.মি. ফুটপাত নির্মাণ, ৭টি আধুনিক পাবলিক টয়লেট, ১টি ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ ও ১টি বাস টার্মিনাল উন্নয়ন করা হবে।