২০৩০ সালের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ স্যুয়ারেজ ব্যবস্থাপনার আওতায় আসছে চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম নগরীতে বর্তমানে দৈনিক প্রায় ৪০ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্য উৎপন্ন হয়। নালা-খাল গড়িয়ে এসব বর্জ্য যায় কর্ণফুলি ও হালদা নদীতে। জোয়ার-ভাটার টানে এর শেষ ঠিকানা হয় বঙ্গোপসাগর।
নগরী হিসেবে চট্টগ্রামেই প্রথম পূর্ণাঙ্গ ও কেন্দ্রীয় পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে পুরো শহরকে ছয় জোনে বিভক্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে একটি ক্যাচমেন্টের কাজ শুরু হয়েছে চলতি বছর। বাকি ৫টি ক্যাচমেন্টের অর্থায়ন করতে আগ্রহী হয়েছে ৪ টি বিদেশি সংস্থা। বর্তমান গতিতে কাজ চললে চট্টগ্রামকে ২০৩০ সালের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ও কেন্দ্রীয় পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার (স্যুয়ারেজ সিস্টেম) আওতায় আনা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশিষ্টরা।
চট্টগ্রাম ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যুয়ারেজ অথরিটির (সিডব্লিউএএসএ) নামে স্যুয়ারেজ থাকলেও দীর্ঘ ৫৮ বছরেও কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। বর্তমানে ৬০ লাখ মানুষের বসবাস এই নগরীতে। শহরের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার জন্য ২০১৭ সালে স্যুয়ারেজ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে ওয়াসা। এই মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন করা হলে ৮৯ লাখ মানুষকে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনায় যুক্ত সক্ষমতা অর্জন করবে চট্টগ্রাম ওয়াসা।
চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট-১ (এসটিপি-১) বাস্তবায়নে দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি তাইয়ু ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। সরকারি অর্থায়নে ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পে ২০ লাখ মানুষ সেবা পাবেন। নগরীর হালিশহর এলাকায় দৈনিক ১০ কোটি লিটার বর্জ্য পরিশোধন ক্ষমতাসম্পন্ন স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট এবং দৈনিক ৩০০ ঘনমিটার পরিশোধন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ফিক্যাল স্লাজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করা হচ্ছে।
বর্তমানে দৈনিক ৫৩৯ ঘনমিটার ফিক্যাল স্লাজ (মানব বর্জ্য) জমা হয় সেপটিক ট্যাংকে। এরমধ্যে ১৫ ঘনমিটার চসিকের এবং ২০ ঘনমিটার এনজিও ডিএসকের ব্যবস্থাপনায় পরিশোধনের ব্যবস্থা রয়েছে। বাকিগুলো নদী ও সাগরে গিয়ে পড়ে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার তথ্যমতে, হালিশহর স্যুয়ারেজ প্ল্যান্ট ছাড়াও বাকি ৫টি ক্যাচমেন্টের প্রকল্প গ্রহণের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। এসটিপি-২ অর্থাৎ কালুরঘাট ক্যাচমেন্ট এবং এসটিপি-৪ পূর্ব বাকলিয়া ক্যাচমেন্টে অর্থায়ন করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। সংস্থাটি প্রকল্পের বিস্তারিত পরিকল্পনা নিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের (ফিজিবিলিটি স্টাডিজ) কাজ করছে। কালুরঘাট ক্যাচমেন্টের জন্য প্রয়োজন প্রায় ৪ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। এর আওতায় ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে দৈনিক ৯০ মিলিয়ন লিটার বর্জ্য পরিশোধন করা যাবে। প্রায় ৭ লাখ মানুষ সেবার আওতায় আসবে। আর পূর্ব বাকলিয়া ক্যাচমেন্টের প্রাথমিক বাজেট ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ৮০ মিলিয়ন লিটার বর্জ্য পরিশোধন করা যাবে। আর সুবিধাভোগী হবেন ১৩ লাখ মানুষ।
ফতেয়াবাদ ক্যাচমেন্টের আওতায় দৈনিক ৬০ মিলিয়ন লিটার বর্জ্য পরিশোধন ক্ষমতাসম্পন্ন এসটিপি-৩ এর জন্য প্রয়োজন প্রায় ১ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা। এর আওতাভুক্ত হবে নগরী ও হাটহাজারী উপজেলার প্রায় ৩০ লাখ মানুষ। এই ক্যাচমেন্টে অর্থায়নের জন্য আগ্রহী দক্ষিণ কোরিয়ার এনভায়রনমেন্টাল ডিফেন্স ফান্ডও (ইডিএফ) সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করছে।
উত্তর কাট্টলি ক্যাচমেন্টের আওতায় দৈনিক ৬০ মিলিয়ন লিটার বর্জ্য পরিশোধন ক্ষমতাসম্পন্ন এসটিপি-৫ স্থাপনে প্রয়োজন ৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। এর আওতাভুক্ত হবেন প্রায় সাড়ে ৮ লাখ মানুষ। এতে অর্থায়নে আগ্রহী ফ্রান্সের ডি ডেভলপমেন্ট (এএফডি) সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করছে।
পতেঙ্গা ক্যাচমেন্টের আওতায় দৈনিক ১০০ মিলিয়ন লিটার বর্জ্য পরিশোধন ক্ষমতাসম্পন্ন এসটিপি-৬ স্থাপনের জন্য প্রয়োজন প্রায় ৪ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। এর আওতাভুক্ত হবে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ মানুষ। এতে অর্থায়নে আগ্রহী জাপানি সংস্থা জাইকা ও মারুবিনি নিপ্পন কিওআই সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, চট্টগ্রামের বয়স ৫০০ বছর। এখানকার সব বর্জ্য কর্ণফুলি ও হালদা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে। জোয়ার-ভাটার কারণে বর্জ্যগুলো সাগরে মিশে যায়। এটি পরিবেশের জন্য এবং মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। আমাদের স্যুয়ারেজ মাস্টারপ্ল্যানের প্রথম ক্যাচমেন্টের কাজ শুরু হয়েছে। বাকি ৫টির অর্থায়নের জন্যও দাতা সংস্থা আগ্রহী হয়ে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের (ফিজিবিলিটি স্টাডিজ) কাজ করছে। সংস্থাগুলো এজন্য পরামর্শকও নিয়োগ দিয়েছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার স্যুয়ারেজ মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, ২০৩০ সালে নগরীতে দৈনিক প্রায় ৫১৫ মিলিয়ন লিটার পয়ঃবর্জ্য উৎপন্ন হবে। আর ৭১৫ ঘনমিটার ফিক্যাল স্লাজ (মানব বর্জ্য) জমা হবে। এজন্য ছয়টি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট এবং ২টি ফিক্যাল স্লাজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করা হবে। নগরী ও আশপাশের ৫৯১ বর্গকিলোমিটার এলাকা ঘিরে মাটির গভীরে স্থাপন করা হবে ৬১৬ কিলোমিটার স্যুয়ারেজ পাইপ নেটওয়ার্ক। শহরের সব বসতবাড়ির সঙ্গে ৪ ইঞ্চি পাইপ স্থাপন করে পরে তা স্যুয়ারেজ ট্রাঙ্ক লাইনের সঙ্গে যুক্ত হবে। এর মাধ্যমে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে পৌঁছবে বর্জ্য।
এছাড়া অপ্রশস্ত ও সরু রাস্তার কারণে শহরের অনেক এলাকায় পাইপ লাইন স্থাপন করা যাবে না। তাই এসব এলাকার বাসাবাড়ির সেপটিক ট্যাংক থেকে ভ্যাকুয়াম ট্রাকের মাধ্যমে ফিক্যাল স্লাজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে নেয়া হবে বর্জ্য। পরিবেশ অধিদপ্তরের মান অনুযায়ী বর্জ্য থেকে সুপারনেটেড পানি আলাদা করে কর্ণফুলি নদী, হালদা নদী ও বঙ্গোপসাগরে ছেড়ে দেওয়া হবে। বাকি বর্জ্যগুলো দিয়ে কম্পোজ সার তৈরি করে বনায়ন ও চাষাবাদের কাজে ব্যবহারের কথাও উল্লেখ আছে মাস্টারপ্ল্যানে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, অর্থায়নে আগ্রহী সংস্থাগুলো এখন সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করছে। এ কাজ যদি এক বছরে শেষ হয় এরপর ডিপিপি প্রণয়নের কাজ হবে। সবমিলিয়ে ২০১৪ সালের জুন নাগাদ দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যাবে। আশা করা যায়, ২০৩০ সালের পূর্ণাঙ্গ স্যুয়ারেজ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা যাবে।
তিনি আরো বলেন, পুরো প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে স্যুয়ারেজ প্ল্যান্ট ট্রিটমেন্টের সঙ্গে প্রায় ৭৫ ভাগ বাড়িঘর যুক্ত করা যাবে। সরু ও অপ্রশস্ত রাস্তার কারণে বাকি ২৫ ভাগ স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট নেটওয়ার্কের বাইরে থাকবে। এজন্য দুটি ফিক্যাল স্লাজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করা হবে। বাসাবাড়ির সেপটিক ট্যাংক থেকে মানব বর্জ্য নেওয়া হবে এই প্ল্যান্টে।
১৮৬৩ সালে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল কমিটি গঠনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম পৌরসভা যাত্রা হয়। শহরে ড্রেনেজ ব্যবস্থা চালু হলেও পয়ঃনিষ্কাশনের বর্জ্য অপসারণের কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বর্তমানে বাড়িঘর থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করে মুনীর নগর ও জালালাবাদ ভাগাড়ে ফেলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)।