আইসিটি প্রকল্পে শামুকের গতিতে এগোচ্ছে বাংলা
বাংলা কম্পিউটিং চালুর মাধ্যমে বৈশ্বিক কম্পিউটিং ল্যাঙ্গুয়েজ প্লাটফর্মে বাংলা ভাষাকে অন্যতম সেরার পর্যায়ে নিয়ে যেতে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) গৃহীত ১৫৯ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চলছে ২০১৬ সাল থেকে। তিন বছরে ১৬টি সফটওয়্যার উন্নয়নের কথা থাকলেও আইপিএ কনভার্টার তথা ধ্বনি থেকে শব্দে রূপান্তরের মাত্র একটি সফটওয়্যার চালু করতেই চলে গেছে সাত বছর।
এর বাইরে ১০টি সফটওয়্যার উন্নয়নের কাজ বিভিন্ন পর্যায়ে চলমান থাকলেও পাঁচটির টেন্ডার প্রক্রিয়াই শেষ করতে পারেনি বিসিসি। এর ফলে প্রকল্পের কাজ কবে শেষ হবে, বা আদৌ শেষ হবে কি না এ নিয়ে সংশয় দেখা দিচ্ছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, আইপিএ কনভার্টার, অপটিক্যাল ক্যারেক্টার রিকগনিশন (ওসিআর), সেন্টিমেন্ট এনালাইসিস ও স্পেল চেকার, টেক্সট টু স্পিচ (টিটিএস), স্পিচ টু টেক্সট (এসটিটি), মেশিন ট্রান্সলেশান, স্টাইলগাইড, স্কিন রিডার, কমন ডেটা রিপোসিটরি (সিএলডিআর), নতুন ফন্ট, ফন্ট কনভার্টার, সাইন রিকগনিশান ও নতুন কি-বোর্ড প্রণয়নের মতো বহুল প্রচলিত সফটওয়্যারের কাজ ২০১৯ সালের মধ্যেই শেষ করার কথা ছিল।
নির্ধারিত সময়ে কোন কাজ শুরু না হওয়ায় প্রথম দফায় দুই বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এতে গতি না আসলে আরও তিন বছর বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পের আওতায় সফটওয়্যার উন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে বরাদ্দ কমানোর পাশাপাশি পরিচালন খাতে ব্যয় বাড়াতে সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠিয়েছে আইসিটি মন্ত্রণালয়।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য বলছে, "গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে আইসিটিতে বাংলা ভাষার প্রবর্ধন" শীর্ষক প্রকল্পে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে মাত্র ১৪.৯৩ কোটি টাকা। ১৫৯ কোটি টাকার প্রকল্পে আর্থিক অগ্রগতি ১০.৬৫%। আর প্রকল্পটির বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৪০%।
প্রকল্পটির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, বাংলা কম্পিউটিং ল্যাঙ্গুয়েজ চালু করে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাই প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য। এর কাজ শেষ হলে বাংলা ভাষায় কম্পিউটার পরিচালনা অনেক সহজ হবে। এর ফলে তুলনামূলক স্বল্প শিক্ষিত লোকজন তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে সরকারের দেয়া সেবা গ্রহণ করতে পারবে।
এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিশেষ করে অন্ধরাও কম্পিউটারে প্রযুক্তি সেবা গ্রহণ করতে পারবেন বলে প্রকল্পের প্রস্তাবে দাবি করা হয়েছে।
প্রকল্পে ধীরগতির জন্য বিভিন্ন ধরনের জটিলতা ও চ্যালেঞ্জকে দায়ী করছে কম্পিউটার কাউন্সিল। প্রকল্পের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, বাংলা ভাষা কম্পিউটিংয়ের জন্য একেবারেই নতুন ও জটিল। এ কারণে বাস্তবায়ন পর্যায়ে প্রচুর চ্যালেঞ্জ দেখা দিচ্ছে। পরামর্শকরা কাজ করতে না পারায় বেশ কিছু কাজের একাধিকবার টেন্ডার করতে হয়েছে বলেও দাবি করছে বিসিসি।
কোভিড মহামারিতে অর্থসঙ্কটেও কাজ বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে অগ্রাধিকার তালিকায় তৃতীয় ক্যাটাগরিতে থাকায় এর বরাদ্দ কেটে নেয়া হয়েছিল। এ কারণে পরামর্শকের বিল, সফটওয়্যার উন্নয়ন ও টেস্টিয় বিল পরিশোধে বাড়তি সময় লেগেছে।
এতে আরও বলা হয় সফটওয়্যারের সফল প্রয়োগ গবেষণা, মেশিন লার্নিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মতো জটিল বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। এসব কারণে কাজ সময়ে শেষ হয়নি।
প্রস্তাবনা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে বেতন ও ভাতায় ৫৩ লাখ, বিদ্যুৎ বিলে ৪৫ লাখ, প্রিন্ট, স্টেশনারি ও সম্মানী খাতে ব্যয় বাড়বে। এছাড়া বিভিন্ন সভার সম্মানী বাবদ ২৩ লাখ টাকা, প্রচারণায় ২.৯১ কোটি টাকা, ক্লাউড স্টোরেজ বাবদ ২.৫৩ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ছে।
প্রকল্পের মূল কাজ সফটওয়্যার উন্নয়ন খাত থেকে কেটে নিয়ে এ অর্থের সংস্থান করা হবে।
প্রকল্পের সফটওয়্যার উন্নয়ন খাতে ১৪৮.৩২ কোটি টাকার বরাদ্দ কাটছাঁট করে প্রথম সংশোধনীতে ধরা হয়েছিল ১৩২.৭৩ কোটি টাকা। আরও ১৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকা কেটে তা ১১৯.১২ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।
বাংলা ভাষার মর্যাদা উন্নয়নে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটির মেয়াদ দফায় দফায় বাড়লেও বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবেই দেখছেন প্রকল্পটির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মোহাম্মদ মাহবুব করিম। তিনি বলেন, প্রকল্পের সবগুলো কাজই গবেষণাধর্মী। আর গবেষণার কাজ কখন শেষ হবে তা বলা কঠিন।
তিনি বলেন, "প্রকল্পের আওতায় এমন কিছু সফটওয়্যার রয়েছে, যেগুলো শুধু গুগলের মতো জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলোরই রয়েছে। এসব কাজ করতে অনেক সময় লাগে।"
ফন্ট কনভার্টার, স্ক্রিন রিডারের মতো বেশ কিছু সফটওয়্যার অনলাইনে বিনামূল্যেই পাওয়া যায়। এমন সফটওয়্যার তৈরিই বা কেন করা হচ্ছে, আর সময় কেন বেশি লাগছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "বিনামূল্যের সফটওয়্যারে অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি থাকে। তাছাড়া প্রকল্পে এ ধরনের সফটওয়্যার কম।"