কাজ শেষ পর্যায়ে, তবু ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে কারওয়ান বাজার পার্ক
তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ছোট পার্কটির কাজ আজও শেষ করে শিশুদের খেলার উপযোগী করতে পারেনি উত্তর সিটি কর্পোরেশন। প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকায় উন্নয়ন কাজের শেষ পর্যায়ে এসেও পার্কটি ফেলে রাখা হয়েছে প্রায় ৬ মাস ধরে। একদিকে পার্কটি সাধারণের ব্যবহার উপযোগী করে না দেওয়া, অপরদিকে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকায় এটি এখন পরিণত হয়েছে ময়লার ভাগাড় আর ভবঘুরেদের আবাসস্থলে।
স্থানীয়দের দাবি, পার্কটির কাজ দ্রুত শেষ করে খুলে দিলে তাদের জন্য কিছুটা স্বস্তির জায়গা মিলবে। অপরদিকে উত্তর সিটি বলছে, নতুন করে পার্ক সংলগ্ন পাবলিক টয়লেটের কাজ শুরু হওয়ায় তা শেষ করেই পার্কটি খুলে দেওয়া হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি জনগণের জীবনমান উন্নয়ন ও মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশের জন্য 'ডিএনসিসির উন্মুক্ত স্থানগুলো আধুনিকায়ন, উন্নয়ন ও সবুজায়ন' শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় উত্তরের ২২টি পার্ক ও চারটি খেলার মাঠ দখলমুক্ত করে ব্যবহারোপযোগী করার কাজ শুরু করে ২০১৭ সালে। এ প্রকল্পের আওতায় বেশ কয়েকটি পার্ক ও খেলার মাঠের কাজ শেষ করে সাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দিলেও কারওয়ানবাজারের এ পার্কটি যেন এ এলাকার মানুষের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পার্কটিকে নতুনভাবে সাজিয়ে সবুজায়ন করার পাশাপাশি অবকাঠামো উন্নয়ন করে নিরাপত্তা বাড়ানোর ব্যবস্থার কথা থাকলেও এটি পড়ে আছে ভাগাড় অবস্থায়। সিটি কর্পোরেশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ছয় মাস আগে পার্কের ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হলেও বাকি ৫ শতাংশ নির্মাণকাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি।
সরেজমিনে দেখা যায়, পার্কটির প্রবেশমুখেই রাখা আছে নির্মাণ সামগ্রী। ভিতরে পার্কের বিভিন্ন স্থানে রাখা আছে নানা ধরনের কাঠের তৈরী আসবাব, ব্যবহৃত ও ভাঙ্গা খাট, ভ্যান গাড়ি, নির্মাণ সামগ্রীসহ নানা ধরনের জিনিসপত্র। পার্কের চারিদিকে বসার স্থান, সিঁড়ি করা হলেও সেগুলো কাদা আর ময়লায় জরাজীর্ণ। পার্কের মধ্যে ছোট মাঠটিতে গরুও চরাতে দেখা যায়। এছাড়া পার্কের দক্ষিণ পাশে একটি পাবলিক টয়লেটের কাজ চলছে। তার পাশেই রয়েছে অর্ধ উন্মুক্ত ক্ষতিগ্রস্ত একটি সেকেন্ডারি বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র (এসটিএস)।
এছাড়া পার্কটির ভিতরে তৈরী করা আছে দুটি কাঠের ঘর। কয়েকজন ভবঘুরেকে পার্কের মধ্যে অবস্থান করতেও দেখা যায়। বসার স্থানগুলোও ভরে আছে ময়লা, আবর্জনায়। পার্কের মধ্যে ল্যাম্পপোস্টগুলোও খালি। রাতে এর মধ্যে বসে মাদকসেবীদের আসর। কাজ শেষ না হতেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বসার স্থান, সিঁড়ি, ল্যাম্পপোস্ট।
স্থানীয়রা জানান, পার্কটি অনেকদিন ধরে এভাবে পড়ে থাকায় এর মধ্যে কারওয়ানবাজারের কয়েকজন দোকানী তাদের দোকানের জিনিসপত্র রাখেন। এছাড়া এর মধ্যে পানির পাইপ দিয়ে বিভিন্ন ধোয়ামোছার কাজও করা হয়, মাঠে লাগানো ঘাস খাওয়ানো হয় গরু বেঁধে।
পার্কটির কাছেই বাসা সিরাজুল ইসলামের। তিনি মাঝে মাঝে তার ছোট মেয়ে সিমলাকে (৮) নিয়ে হাঁটতে বের হন। বাসার কাছে পার্ক থাকা সত্ত্বেও এখানে হাঁটা কিংবা একটু সময় কাটানোর সুযোগ নেই সিরাজের।
সিরাজ টিবিএসকে বলেন, "প্রায় ৫ বছর আগেই পার্কটিতে কাজ শুরু করা হয় কিন্তু কাজ আর শেষ হয় না। এতোটুকু পার্কের মধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ভবন একটা, পাশেই একটা এসটিএস। আবার পাবলিক টয়লেট হচ্ছে এর মধ্যে, আসলে এভাবে সংকুচিত করে এতোকিছু একসাথে করলে কোনো কিছুই শেষ পর্যন্ত কাজে আসবে বলে মনে হয় না।"
স্বল্প পরিসরে হলেও পার্কটির কাজ যেন দ্রুত শেষ করে শিশুদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় তার আহবান জানান তিনি।
পার্কটির কেয়ারটেকারের দায়িত্বে থাকা মোক্তার হোসেন টিবিএসকে বলেন, "এখানকার কাজ শেষ হয়নি বলে অনেকে জিনিসপত্র রাখছে। তাদের আমি বাধা দিলেও শোনে না। আমায় বেতন দিবে বলছিল কিন্তু এখনও দেয়নি তাই আমিও আছি আমার মতো।"
কাঁচামালের আড়তের ব্যবসায়ী মো. সাগর টিবিএসকে বলেন, "পার্কটি চালু হলে আমরাও এসে একটু বসতে পারতাম, আশপাশে তো কোনো পার্ক নেই। একজনের দেখাদেখি অন্যরাও পার্কটিকে নষ্ট করছে।"
পার্কটি তৈরির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান 'বেলাল এন্ড ব্রাদার্স' এর সাইড কন্ট্রাক্টর মো. আব্বাস টিবিএসকে বলেন, "এই পার্ক, এসটিএস ও পার্কের পাশে ১৬টি দোকানের কাজের জন্য সাড়ে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। পার্কের কাজ অল্প কিছু বাকি আছে আর দোকান ও এসটিএসের কাজ হবে কিনা এখনও নিশ্চিত না।"
পার্কটির কাজ শেষ পর্যায়ে থাকলেও প্রায় দেড় মাস আগে শুরু হওয়া পাবলিক টয়লেটের কাজ শেষ হতে আরও ৪/৫ মাসের মতো লাগতে পারে জানিয়ে টয়লেট তৈরীর প্রকল্পটির প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার সামিউল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "আমরা একসাথে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৫০টি পাবলিক টয়লেটের কাজ করছি। ২৫টির মতো শেষ হয়েছে, এখন বাকিগুলো চলছে। এ পার্কের কাজটি শুরু করতে একটু সময় লেগেছে। অনেক আগে কাজের পরিকল্পনা হলেও জানুয়ারির ৪ তারিখ থেকে কাজ শুরু হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "এখানে কাজ করতে গিয়ে আমাদের নিয়মিত নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। আমাদের কাজের রড, কাঠ, ইট চুরি হয়ে যায়। পার্কের মধ্যে ভবঘুরে, নেশাখোরদের আবাসস্থল। পুরো অনিরাপদ একটি স্থান।"
এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবুল কাশেম টিবিএসকে বলেন, "পার্কটির ৯৫ শতাংশ কাজ কয়েকমাস আগেই শেষ হয়েছে তবে এর দক্ষিণ পাশে একটি পাবলিক টয়লেট এবং সেকেন্ডারি বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্রের (এসটিএস) কাজ চলমান থাকায় পার্কটি চালু করা যাচ্ছে না। সব কাজ শেষ করে একবারে পার্কটি উদ্বোধন করা হবে।"