কবুতর গাইবান্ধার যে গ্রামের মানুষকে বদলে দিচ্ছে
গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে ৮ /১০ কিলোমিটার উত্তরপুর্বের গ্রামের অধিকাংশ মানুষের কাজ ছিলো অন্যের জমিতে কাজ করা । কিন্তু এ চিত্র এখন বদলে গেছে।
এসব গ্রামে এখন ভোর হতে না হতেই শুরু হয় বাকবাকুম বাকবাকুম ডাকাডাকি। খাবার দিলেই ঘর ছেড়ে দল বেঁধে উড়ে আসে রঙ-বেরঙের বাহারি কবুতর। তখন তাদের মিষ্টি ডাকে বাড়ির উঠান গমগম করে। ঘরে চালা, আঙ্গিনা, টিনের ছাপড়া আর বাড়ির উঠান জুড়ে চলে কবুতরের ডাক।
গাইবান্ধার কয়েক ইউনিয়নের বাড়িতে এমন দৃশ্য চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে ঘাগোয়া ও গিদারী ইউনিয়নের প্রায় সব গ্রামের চিত্রই এমন। বিভিন্ন জাতের কবুতর খামার আকারে পালন করে এসব গ্রামের অবস্থা পাল্টে গেছে। সাবলম্বী হতে শুরু করেছেন অধিকাংশ গ্রামবাসীই। এতে তাদের সংসারে সুখ শান্তি আর সচ্ছলতা ফিরে এসেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জাতের কবুতরের খামার গড়েছেন গাইবান্ধা সদর উপজেলার উত্তর ঘাগোয়া, দক্ষিণ ঘাগোয়া, মালিবাড়ি, গিদারী, দাড়িয়াপুর, রুপার বাজারসহ অন্তত ৮টি গ্রামের বাসিন্দারা। আগে শখ করে বাড়িতে দু-চার জোড়া কবুতর পালন করা হতো। কিন্তু এখন লাভের আশায় এসব গ্রামের বাসিন্দারা খামার আকারে কবুতর পালনের দিকে ঝুঁকছেন।
গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ছোট বা বড় আকারের কবুতর খামার রয়েছে। আর এসব খামারে সাধারণ কবুতরের পাশাপাশি ঝর্ণা সেটিং, বুলু সেটিং, গিরিবাজ, হলুদ মুক্কি, লাল মুক্তি, লাল মুক্তি, লাক্কা, রাহুল, নান, লোটন নামের কবুতর পালন করা হচ্ছে।
খোলাহাটির রাজু আহম্মেদ, জয়; রুপার বাজারের আতোয়ার রহমান, সোহেল মিয়া; দাড়িয়াপুরের সালাম মিয়া, মজিবর রহমান ও মর্জিনাসহ শতাধিক নারী-পুরুষ কবুতর পালনকে এখন পেশা হিসেবে নিয়েছেন।
প্রথম প্রথম তারা শখের বশে কবুতর পালন করতেন। বর্তমানে এই কবুতর পালনই তাদেরকে সফলতা এনে দিয়েছে। তাদের এই সাফল্য দেখে এলাকার আরও অনেক বেকার যুবক কবুতরের খামার তৈরিতে আগ্রহী হয়েছেন।
আনালেরতাড়ি গ্রামের হাবিবুর রহমান বলেন, "আগে অন্যের জমিতে কাজ করেছি। কিন্তু পাশের গ্রামের একজনের বাড়িতে কবুতর পালন করা দেখে আগ্রহ জাগে আমার। তার বাড়িতে কবুতর পালন শিখি আমি।"
"এরপর হাট থেকে ২ জোড়া কবুতর কিনে খামার শুরু করি আমি। ১ হাজার টাকা দিয়ে ২ জোড়া কবুতর ৭ মাসে ২শ জোড়া হয়েছে। খাবারের জন্য যা খরচ হয় তা বাদ দিয়ে আমি অন্তত লাখ টাকার কবুতর বিক্রি করেছি। এই টাকা দিয়েই আমার সংসার চলে," বলেন তিনি।
একই গল্প আনালেরতাড়ি গ্রামের খোকা মিয়ার।
নিজে শ্বশুর বাড়িতে থাকতেন আর শ্বশুর মোখলেস মিয়ার সাথে কাজে যেতেন চট্টগ্রাম। কিন্তু কবুতর কেনার পর বদলে যায় তার জীবন।
প্রথমে এক প্রতিবেশীর খামারে কাজ করা শুরু করেন তিনি। দুবেলা খাবার আর ২০০ টাকার বিনিময়ে কাজ করতেন তিনি।
এর এক বছর পর নিজেই বাড়িতে গড়ে তুলেন কবুতরের খামার।
"প্রথমে ৪ জোড়া দিয়ে শুরু। এখন আমার খামারে শুধু কবুতর আর কবুতর । নিজে খাই, সাথে বাজারেও বিক্রি করি। দূরদুরান্ত থেকে লোক এসে কবুতর কিনে নিয়ে যায়। তাতে কবুতরের খাবার খরচ বাদ দিয়ে আমার মাসে রোজগার আসে ১২ থেকে ১৬ হাজার টাকা।"
অন্যদিকে খামারি মজিবর রহমান বলেন, "অল্প পুঁজিতে কবুতর পালন করে ভালো লাভ করা যায়। বাড়িতে বসে এখন প্রতিমাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার কবুতর বিক্রি করি। এতে লাভ আসে অন্তত ১৮ হাজার টাকা।"
এ বিষয়ে গিদারী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান ইদু সরকার বলেন, "গাইবান্ধা শহর থেকে ঘাগোয়া ও গিদারী ইউনিয়নের গ্রামের দিকে তাকালে ভিন্ন এক চিত্র নজরে পড়ে। গবাদী পশুর পাশাপাশি এখানকার মানুষ কবুতর পালনে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।"
চেয়ারম্যান আরও বলেন, "কম খরচে ভালো লাভ হওয়ায় কবুতর পালনে একজনকে দেখে অন্যরা উৎসাহিত হয়েছেন। কবুতরের খামার গড়তে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে কবুতর পালনে আরও অনেকেই আগ্রহী হবেন। তাই, এই বিষয়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।"
জানতে চাইলে ঘাগোয়া ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুজ্জামান রিংকু বলেন, "দিন দিন এই এলাকায় যে হারে কবুতরের খামার বাড়ছে, তা খুবই আশার খবর। এই বিষয়ে উপজেলা কৃষি অফিস থেকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে এলাকার মানুষ আরও বেশি উপকৃত হবেন। এছাড়া, এখানকার খামারের পালিত কবুতরের একটা বাজার তৈরি করতে পারলে খামারিরা আরও লাভবান হবেন।"
এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার জন্য তিনি উপজেলা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।