আকাশপথে ভ্রমণ চাহিদা বাড়লেও অব্যবহৃত পড়ে আছে দেশের ৬টি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর
বাণিজ্যিকভাবে সফল বিমানবন্দরের জন্য চাই দুটি জিনিস: পর্যাপ্ত যাত্রী এবং উড়োজাহাজ ওঠানামার জন্য দরকারি অবকাঠামো। দ্বিতীয়টির অভাবেই দেশের ১১টি আঞ্চলিক বিমানবন্দরের মধ্যে ৬টিতেই বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি এয়ারলাইনারগুলো।
ব্রিটিশ আমলে নির্মিত দেশের পশ্চিম-মধ্যাঞ্চলীয় জেলা পাবনার ঈশ্বরদী বিমানবন্দরের কথাই বলা যাক প্রথমে। ১৯৬২ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এখানে থেকে ঢাকায় ফ্লাইটের আসা-যাওয়া ছিল। এরপর ১৭ বছর বন্ধ থাকার পর ২০১৩ সালে কার্যক্রম শুরু করলেও, আবারো বন্ধ হয়ে যায় ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে।
অথচ এই উপজেলায় নির্মিত হচ্ছে দেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র, রয়েছে একটি সক্রিয় রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড)। এই বাস্তবতায় বিমানে ভ্রমণের সুবিধা না থাকা এখানে ক্রমবর্ধমান আকাশপথে ভ্রমণ চাহিদার সাথে সাংঘর্ষিক।
এখনও কেন শিল্প শহরটিতে আকাশপথে ভ্রমণ করা যায় না- সে বিষয়ে বাংলাদেশ বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) এবং ২০১৪ সালে যে বেসরকারি এয়ারলাইনারটি ঈশ্বরদী বিমানবন্দরে ফ্লাইট কার্যক্রম বন্ধ করে- উভয়ের বক্তব্য ভিন্ন ভিন্ন।
বেবিচক যাত্রী সংকটের কথা উল্লেখ করলেও, বেসরকারি এয়ারলাইনারটি দোষ দিয়েছে স্বল্প-দৈর্ঘ্যের রানওয়ে, অপর্যাপ্ত অগ্নি-নির্বাপক ব্যবস্থা এবং দুর্বল এয়ার ট্র্যাফিক ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থাকে।
বহু বছর ধরে বন্ধ থাকা ঠাকুরগাঁও, বগুড়া, লালমনিরহাট, কুমিল্লা এবং শমশেরনগর বিমানবন্দরের জন্যও প্রযোজ্য- এই দুর্বল অবকাঠামো বনাম যাত্রী সংকট বিতর্ক। বেশিরভাগ অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এবং পাকিস্তান আমলে সেগুলোয় বাণিজ্যিকভাবে বিমান চলাচল কার্যক্রম শুরু হয়।
বর্তমানে কক্সবাজার, রাজশাহী, যশোর, সৈয়দপুর ও বরিশালের বিমানবন্দরে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বাণিজ্যিকভাবে চালু রয়েছে। বেসরকারি বিমান সংস্থা- নভোএয়ার, ইউএস বাংলা এবং জাতীয় পতাকাবাহী বাংলাদেশ বিমান অন্যত্র থেকে ঢাকায় এবং ঢাকা থেকে এসব গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করে।
এছাড়া চলতি বছরেই অভ্যন্তরীণ এভিয়েশন মার্কেটে প্রবেশ করবে দুটি নতুন বেসরকারি এয়ারলাইনার- এয়ার অ্যাস্ট্রা এবং ফ্লাই ঢাকা।
ব্যস্ত ফ্লাইট লগ যাত্রী সংকটের দাবিকে ভুল প্রমাণিত করছে:
বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলোর মতে, গত কয়েক বছরে ঢাকা থেকে পাঁচ জেলায় অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তারা বলছে, যাত্রী সংকটের কারণে ২০১৩-১৪ সালে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা সৈয়দপুরে সপ্তাহে তিনটি ফ্লাইট পরিচালনা করাও কঠিন ছিল। কিন্তু এ রুটে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট এখন প্রতিদিন ১৫টিতে (রাউন্ড ট্রিপ বা ফিরতি যাত্রা ধরলে ৩০টি) পৌঁছেছে।
বরিশালে আগে সপ্তাহে দুটি ঢাকা-বরিশাল ফ্লাইট ছিল, যেখানে এখন অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের সংখ্যা দিনে ৫-৬টি।
নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মফিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে ঈশ্বরদী বিমানবন্দর চালুর প্রস্তাব দিয়েছি। এর প্রয়োজনীয়তা শুধুমাত্র রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যই নয়, কৃষি ভিত্তিক কিছু শিল্পও সেখানে রয়েছে। আমরা মনে করি- এটা একটা ভায়েবল অপারেশন (বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক) হবে। একইভাবে পর্যটন বাড়ায় শমশেরনগরেও প্রচুর সম্ভাবনা আছে।"
শমশেরনগর বিমানবন্দরটি ১৯৯৫ সালে বাণিজ্যিকভাবে চালু হয়। বেবিচক-এর মতে, পরবর্তীতে যাত্রী সংকটের কারণে ঢাকা-শমশেরনগর রুট স্থগিত করা হয়।
বর্তমানে বিমান বাহিনী প্রশিক্ষণের জন্য সিলেট শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বিমানবন্দরটি ব্যবহার করছে।
গত এক দশকে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পর্যটকদের জন্য দ্য প্যালেস লাক্সারি রিসোর্ট, গ্র্যান্ড সুলতান এবং দুসাই রিসোর্ট অ্যান্ড স্পাসহ অনেক হোটেল এবং রিসোর্ট নির্মাণ করা হয়েছে।
ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম মিডিয়া মিক্স কমিউনিকেশন এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আব্দুল্লাহ হাসান টিবিএসকে বলেন, "পাশের উপজেলা শ্রীমঙ্গলে চা বাগানে সবুজের সমারোহ দেখতে আসা পর্যটকদের কারণে এটি বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন গন্তব্যে রূপ নিয়েছে। অভিজাত হোটেল ও রিসোর্টের গ্রাহকদের অর্থের ভাবনা নেই- তাই তারা আকাশপথে ভ্রমণই পছন্দ করেন।"
তিনি বলেন, শমশেরনগর বিমানবন্দর আবার চালু হলে- এটি পুরো পর্যটন অঞ্চলে সেবা দিতে পারবে। বর্তমানে, ঢাকা থেকে শমশেরনগরে সড়ক ভ্রমণে ন্যূনতম পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগে।
সৈয়দপুরে ফ্লাইটের ব্যস্ত লগের কথা উল্লেখ করে নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমানও ঠাকুরগাঁও বিমানবন্দর পুনরায় চালুর পক্ষে মত দেন।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম মনে করেন, সড়কে যানবাহনের চাপ প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। একারণে বন্ধ থাকা অভ্যন্তরীণ/আঞ্চলিক বিমানবন্দরগুলো আবার চালু করা গেলে বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলো অবশ্যই ফ্লাইট পরিচালনা করবে।
তিনি বলেন, "যাত্রী আছে, এবং তারা বিমান ভ্রমণের জন্য খরচ করতেও প্রস্তুত। আমাদের প্রথম কাজই হবে এয়ারফিল্ডগুলিকে ব্যবসায় ফিরিয়ে আনা।"
সড়কপথে দীর্ঘযাত্রা দেশে দ্রুত শিল্পায়নের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়:
কুমিল্লা বিমানবন্দর ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত বাণিজ্যিকভাবে চালু ছিল। ১৯৯৪ সালে এটি পুনরায় চালু করা হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত যাত্রী না থাকায় দুই সপ্তাহের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়।
তবে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ অঞ্চলে দ্রুত শিল্পায়নের ফলে বিমান চলাচলের চাহিদা বদলেছে। তাছাড়া এ জেলায় একটি ইপিজেড থাকলেও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা রাজধানী থেকে সহজে সেখানে যেতে পারেন না।
ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের জেনারেল ম্যানেজার (জনসংযোগ) কামরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "৯০ এর দশকে যখন কুমিল্লা বিমানবন্দর ফ্লাইট স্থগিত করেছিল, তখন যানজট বলতে কিছুই ছিল না। কিন্তু এখন তিন ঘণ্টা সময়েও ঢাকা থেকে সড়কপথে কুমিল্লা পৌঁছানো যায় না। অথচ ফ্লাইটে করে মাত্র ২৫ মিনিটে কুমিল্লা যাতায়াতের সুবিধা মিলবে।"
বিমানবন্দরটি পুনরায় চালু হলে চাঁদপুর ও ফেনী অঞ্চলের সাথে ঢাকার আরও ভালো সংযোগ তৈরি হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি জানান, ১৭-১৮ আসন বিশিষ্ট বিমানগুলো ঢাকা-বগুড়া এবং ঢাকা-ঠাকুরগাঁও রুটে বাণিজ্যিকভাবে চালু করা যেতে পারে। এতে করে ১০-১১ জন যাত্রী নিয়েও একটি ফ্লাইট কোনোরকম লোকসান ছাড়াই চলাচল পারবে।
তিনি বলেন, "শমশেরনগর এয়ারস্ট্রিপও প্রস্তুত। সুযোগ-সুবিধার সামান্য উন্নয়নের পর, আমি মনে করি এখানেও বাণিজ্যিক ফ্লাইট আবার চালু করা যেতে পারে।
ইউএস বাংলার কর্মকর্তা এ বলেন, ঈশ্বরদী বিমানবন্দর অবিলম্বে পুনরায় চালু করা উচিত, কারণ সেখানকার ইপিজেড এরমধ্যেই ১৭ কোটি ডলার বিনিয়োগ পেয়েছে।
পাবনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক এবিএম ফজলুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "বিদেশি ক্রেতারা ঘন ঘন ইপিজেডে আসছেন। এছাড়াও, পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পকে কেন্দ্র করে ঈশ্বরদীতে অন্যান্য শিল্প ও পর্যটন বিকাশ লাভ করছে। বিমানবন্দর বন্ধ থাকায় মানুষ (যাতায়াত) সমস্যায় পড়েছে।"
সরকারের পুনরায় বিমানবন্দর চালুর পরিকল্পনায় সময় লাগতে পারে:
এদিকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী গত বছরের নভেম্বরে সংসদে বলেছিলেন, ঈশ্বরদী বিমানবন্দর মেরামত ও সংস্কারের পর পুনরায় চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। একাজের ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়ে সংসদকে অবহিত করেন তিনি।
যোগাযোগ করা হলে, বেবিচক-এর সদস্য (অপারেশনস অ্যান্ড প্ল্যানিং) এয়ার কমোডর সাদিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, বগুড়া বিমানবন্দরের বর্তমান এয়ারস্ট্রিপটি বড় বিমানের জন্য উপযুক্ত নয়, অন্যদিকে লালমনিরহাট বিমানবন্দরটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন এবং অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটির জন্য ব্যবহার করা হবে।
"বড় বিমানের ফ্লাইট পরিচালনার জন্য ঈশ্বরদী বিমানবন্দরের একটি সম্পূর্ণ পরিবর্তন প্রয়োজন। এয়ারফিল্ডটি পারমাণবিক প্ল্যান্ট থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দূরে, যার মানে বিমানগুলিকে নো-ফ্লাই বিধিনিষেধের মুখোমুখি হবে।"
"শমশেরনগরেরও অবস্থান পরিবর্তনের প্রয়োজন, যার অর্থ জমি অধিগ্রহণে বিপুল বিনিয়োগ দরকার হবে। এর কার্যকারিতা মূল্যায়নে আমাদের আগে একটি বাজার গবেষণা করা উচিত"- যোগ করেন তিনি।