ইউক্রেনে নিহত নাবিক হাদিসের বাড়িতে এখন শোকের মাতম, ছিল বিয়ের প্রস্তুতি
প্রতিদিন হাদিসুরের বাড়িতে ঘটকরা আসতো কনের ছবি নিয়ে। হাদিসুরের বাবা-মা ঘটকের আনা ছবিগুলো দেখে ছেলের জন্য কনে খুঁজতেন। তাদের একান্ত ইচ্ছে ভালো পরিবারের মেয়ে দেখে ছেলের বিয়ে দেবেন। ছেলে বাড়িতে এলেই তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসাবেন। মনে তাদের আনন্দ-উচ্ছাস।
এমনসময়ে খবর পেলেন, ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে আটকে থাকা বাংলাদেশি পণ্যবাহী 'এমভি বাংলার সমৃদ্ধি' জাহাজে রকেট হামলায় আগুন ধরে একমাত্র ছেলে হাদিসুর রহমান (২৯) নিহত হয়েছেন। আকস্মিক এই দুঃসংবাদে ভেঙে পড়েছে পরিবারটির সুখস্বপ্ন। ভেঙে পড়েছেন হাদিসুরের মা-বাবা, ভাই-বোন। শোকে মুহ্যমান অন্য স্বজনেরা।
হাদিসুর রহমান বরগুনার বেতাগী উপজেলার হোসনাবাদ ইউনিয়নের কদমতলা গ্রামের বাসিন্দা আবদুর রাজ্জাক ছেলে। একটি বেসরকারি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন আবদুর রাজ্জাক, হাদিসুরের মা গৃহিনী। টানপোড়েনের সংসারে হলেও সন্তানদের শিক্ষিত করেছেন আবদুর রাজ্জাক। হাদিসুর তিন ভাই, এক বোনের মধ্যে দ্বিতীয়।
২০০৮ সালে বেতাগী পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ২০১০ সালে বেতাগী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন হাদিসুর। উচ্চ মাধ্যমিকের পর চট্রগ্রামের মেরিন একাডেমিতে ভর্তি হন। সেখান থেকে ২০১৪ সালে পাশ করে বের হন। হাদিসুরের বড় বোন সানজিদা আক্তার পটুয়াখালি হাসপাতালে নার্স হিসেবে কর্মরত। ছোট এক ভাই- তরিকুল ইসলাম তারেক পটুয়াখালী কলেজে মাষ্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র। আরেকজন- গোলাম মাওলা প্রিন্স ঢাকার কবি নজরুল ইসলাম কলেজের অর্নাস প্রথম বর্ষের ছাত্র।
তরিকুল ইসলাম বলেন, "ছোট থেকেই ভাইয়ার ইচ্ছা ছিল জাহাজের নাবিক হবে। স্কুল ও কলেজে পড়ার সময় সহপাঠীদের কাছে বলতেন, বড় হলে নাবিক হবেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই শান্ত স্বভাবের ছিলেন।"
হাদিসের স্বজনরা জানান, আট বছর ধরে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে বিভিন্ন জাহাজে চাকরি করেন হাদিসুর। সর্বশেষ বাড়িতে এসেছিলেন মাস ছয়েক আগে। তবে পরিবারের সঙ্গে নিয়মিতই যোগাযোগ ছিল।
গত মঙ্গলবার বাড়িতে স্বজনদের সঙ্গে ভিডিওকলে কথা বলেছেন। জানিয়েছিলেন, আটকে থাকা জাহাজ ছাড়া পেলেই বাড়ি ফিরবেন। বুধবার রাতে ছোট ভাই গোলাম মাওলা প্রিন্সকে ফোন করেন হাদিস। তবে বিকট শব্দের কারণে কিছুই শুনতে পারেননি তিনি।
বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে তাঁরা হাদিসুরের মৃত্যু সংবাদ জানতে পারেন।
হাদিসুর রহমানের মা আমেনা বেগম এখন ছেলে হারানোর শোকে মূর্ছা যাচ্ছেন। তিনি কান্নাভেজা কন্ঠে বলেন, গত বুধবার হাদিস আমাকে ফোন দিয়েছিলো। ডাক্তার দেখিয়েছি কিনা জানতে চেয়েছে। এর পর সবশেষে গতকাল ভিডিওকলে কথা হয়। তারপর তার রাতে তার মৃত্যুর খবর পাই।
তার চাচা ও বেতাগী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাকসুদুর রহমান বলেন, "হাদিস ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র ছিলো। সে চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমি থেকে পাস করার পর দেশে-বিদেশে বিভিন্ন জাহাজে চাকরি করেছে। ২০১৮ সাল থেকে ওই জাহাজে ছিল। ছেলেটা সর্বশেষ বাড়িতে আসে মাস ছয় আগে।"
একই এলাকার বাসিন্দা আলমগীর হোসেন বলেন, হাদিস এসএসসি ও এইচএসসি দুই পরীক্ষাতেই ভালো রেজাল্ট করেছে। ওর মতো নম্র-ভদ্র ছেলে আমাদের এলাকায় ছিল না। সে ছিল এলাকার ছোট-বড় সকলের কাছে প্রিয়।
হাদিসুর রহমানের ছোট ভাই গোলাম মাওলা প্রিন্স বলেন, মিসাইল আঘাত হানার সময় বড় ভাই বাইরে এসে মুঠোফোনে আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। তখনই হঠাৎ একটি গোলা এসে পড়ে জাহাজটিতে। বিকট শব্দের কারণে কিছুই শুনতে পাইনি।
বাংলাদেশে শিপিং কর্পোরেশনের জাহাজ বাংলার সমৃদ্ধি গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে পৌঁছায়। ওইদিনই দেশটিতে রাশিয়ার হামলা শুরু হলে বন্দরের সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। সেই সঙ্গে জাহাজে আটকা পড়েন ক্যাপ্টেন জি এম নূর ই আলম, চিফ ইঞ্জিনিয়ার ওমর ফারুকসহ ২৯ বাংলাদেশি নাবিক।