নানা জটিলতায় থমকে যাচ্ছে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রকল্প
বন্দর নগর চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা সংকট নিরসনে ১০ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকার চার মেগাপ্রকল্প হাঁটে নিলেও মুক্তি মিলছে না এই শহরের মানুষের। ভূমি অধিগ্রহণ ও নকশার জটিলতা, সমন্বয়হীনতা এবং কাজের ধীর গতির কারণে সুফল মিলছে না সহসা।
দীর্ঘদিনের এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে তিন মেগাপ্রকল্পের অধীনে নগরীর ৪০টি খালের মুখে রেগুলেটর স্থাপনের কাজ চলছে। খালগুলো মধ্যে ২৩টির প্রবাহ হয় কর্ণফুলী নদীতে ও ৩টির হালদা নদীতে এবং ১৪টির প্রবাহ বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। রেগুলেটরের ভৌত কাজের জন্য এসব খালের মুখে বাধ দেওয়া হয়েছে। চলতি বর্ষা মৌসুমের আগে মাত্র ৫টি রেগুলেটর কার্যকর করা সম্ভব হবে বলে জানা গেছে।
এছাড়া বর্ষা ও জোয়ারের পানির প্রবাহ ঠিক রাখতে নগরীর ৩৬টি খাল খনন, সংস্কারের কাজ চলছে। ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতায় ১৮টি খালের কাজ শেষ হচ্ছে না।
ভূমি অধিগ্রহণে আটকে আছে ১৮ খালের কাজ
২০১৭ সালের আগস্টে পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে 'চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন' প্রকল্পের অনুমোদন দেয় একনেক।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। ২০১৮ সালের এপ্রিলে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের বড় বাধা ভূমি অধিগ্রহণ। অনুমোদনের সময় ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ ছিল দেড়গুণ। আইন সংশোধন করে তা তিন গুণ নির্ধারণ করা হয়। তাই প্রকল্পের নির্ধারতি ৬ হাজার ৫১৬ কাঠা ভূমির মধ্যে মাত্র ৩০০ কাঠা অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
এই জটিলতায় নগরীর মির্জাখাল, ত্রিপুরাখাল, গয়নাছড়া খাল, ডোমখালী খাল, মহেশখাল, চাক্তাইখাল, চাক্তাই ডাইমেনশন খাল, হিজড়া খাল, বদরখাল, নোয়াখাল, শিতলঝর্ণা খাল, চশমাখালসহ ১৮টি খালের খনন, সম্প্রসারণ ও সংস্কারের কাজ সম্পন্ন হয়নি। ফলে সহজেই শহর থেকে পানি নামবে না এবারও। খালের পাড়ের মোট ৮৫ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে ১৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার সম্পন্ন হয়েছে। পাহাড়ি বালু আটকানোর জন্য ৪২টি সিলট্র্যাপের মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে ১৫টির।
প্রকল্পটির পরিচালক সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. শাহ আলী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "প্রকল্পের আওতায় মরিয়মবিবি, কলাবাগিচা, টেকপাড়া, ফিরিঙ্গিবাজার ও মহেশখালের মুখের রেগুলেটর চলতি বর্ষা মৌসুমের আগেই কার্যকর করা যাবে।"
"এজন্য যুক্তরাজ্য থেকে রেগুলেটর এবং নেদারল্যান্ড থেকে গেট আনা হয়েছে। এছাড়া বর্ষার আগেই সবকটি খাল থেকে মাটি অপসারণ করা হবে। যেন পানি প্রবাহে সমস্যা না হয়।"
আটকে আছে ১২ রেগুলেটর স্থাপন
২০১৭ সালের ২৫ এপ্রিল দুই হাজার ৩১০ কোটি টাকা ব্যয়ে 'কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ' প্রকল্পের অনুমোদন দেয় একনেক। সিডিএর প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের ৬ নভেম্বর। দেশের অন্যতম ভোগ্যপণ্যের বাজার চাক্তাই, খাতুনগঞ্জসহ নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকার জলবদ্ধতা নিরসনে ১২টি খালের মুখে রেগুলেটর ও পাম্প হাউজ স্থাপনের কথা রয়েছে প্রকল্পের অধীনে। এরমধ্যে ১০টি খালের কাজ চলছে। তবে অর্থ সংকটে চলতি বর্ষা মৌসুমের আগে রেগুলেটর এবং খালগুলো কার্যকর করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
চলতি অর্থ বছরে ৫০০ কোটি টাকা চাহিদা থাকলেও মাত্র ২১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ আসে। প্রকল্পের আওতায় ৮ দশমিক ৫৫ কিলোমিটার সড়কসহ বেড়িবাঁধ নির্মাণের কথা রয়েছে। বাস্তবায়নে তিন দফা মেয়াদ বাড়িয়ে চলতি বছরের জুনে কাজ শেষ করার কথা।
প্রকল্প পরিচালক ও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী রাজীব দাস দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কোভিড পরিস্থিতির কারণে কাজ ব্যহত হচ্ছে। করোনার প্রথম বছর ১০০ কোটি টাকা পেয়েছি। এমন মেগাপ্রকল্পের জন্য এই টাকা কিছুই না। ঢাকায় অনুষ্ঠিত সমন্বয় সভায় বিষয়গুলো জানানো হয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকার বিষয়গুলো গুরুত্ব দিচ্ছে।"
বন্দরের আপত্তিতে বন্যা প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণ প্রকল্পে ভাটা
২০১৯ সালে একনেকে অনুমোদন পাওয়া ১৬২০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনী। ২৩টি খালের মুখে রেগুলেটর বসানোর পাশাপাশি কর্ণফুলীর তীরে ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ বন্যা প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণের কথা ছিল।
এরমধ্যে মাত্র ২টি রেগুলেটরে ভৌত কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং ৪টির কাজ চলছে। তবে চলতি বর্ষা মৌসুমের আগে একটিও কার্যকরের সম্ভবনা নেই বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। অর্থ সংকট, বন্দরের আপত্তি এবং রেগুলেটরের নকশাগত জটিলতার; এই তিন কারণে প্রকল্পটি প্রায় থমকে গেছে। প্রকল্পটির জন্য ১০০ কোটি টাকাও ছাড় হয়নি এ পর্যন্ত।
অথচ চলতি বছরের জুন মাসে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। মেয়াদ আরো এক বছর বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে। তবে এক বছরে বিশাল অংকের অর্থের সংস্থান হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে কেউ কথা বলতে চাননি।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চীফ হাইডোগ্রাফার কমান্ডার এম আরিফুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "প্রকল্পের সাম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষায়ই বন্দর এলাকা বাদ দিয়ে দেয়াল নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তারা বন্দর এলাকা বলতে শুধুমাত্র জেটিকে বুঝেছেন। নদীতীরে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ওয়েল থেকে শুরু করে ১৫ নম্বর ঘাট পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় যেসব জেটি রয়েছে, সেখানে যদি দেয়াল নির্মাণ করা হয়, তাহলে জাহাজ ভিরাবে কোথায়! আমরা জাহাজ চলাচলের সব জেটি বাদ দিতে বলেছি।"
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তয়ন কুমার ত্রিপুরা বলেন, "বন্দরের আপত্তির কারণে ১৫ নম্বর ঘাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত ১২ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার দেয়াল নির্মাণ হবে না। তবে কালুরঘাট থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার বন্যা প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণের কাজ চলছে। প্রকল্পটিতে সংশোধন আনা হচ্ছে। ভূমি অধিগ্রহণও বেশি করা লাগবে না। তাই প্রকল্প ব্যয় ও সময় অনেক কমে আসবে।"
৭ বছরেও শুরু হয়নি বাড়ইপাড়া খাল খননের কাজ
২০১৪ সালের ২৪ জুন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ১ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়। প্রায় সাত বছর ধরে ঝুলে থাকা প্রকল্পটি গত বছরের ২৭ নভেম্বর উদ্বোধন করা হয়। ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো হলেও ভূমি অধিগ্রহণ না হওয়ায় ভৌত কাজ শুরুই হয়নি।
ভূমি অধিগ্রহণে ব্যয় হয়েছে ৯১৪ কোটি টাকা। ২৫ একর জমির মধ্যে জেলা প্রশাসন এখন পর্যন্ত ১০ একর বুঝিয়ে দিয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক চসিক নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফরহাদুল আলম বলেন, জমি বুঝে পেতে আরো মাস ছয়েক লাগবে। এরপর খাল খননের কাজ শুরু হবে।