বিস্ফোরণোন্মুখ তেল-বোমা
রাশিয়ার তেল আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। তার জেরে হু-হু করে বাড়ছে তেলের দাম। জুনে তেল আমদানি-সংক্রান্ত পুরোনো চুক্তিগুলোর মেয়াদ শেষ হবার পর স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে এর ধাক্কা এসে লাগবে বাংলাদেশেও।
এই নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেওয়ার পর বুধবার ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ১৩০ ডলারে উঠে গেছে, ২০০৮ সালের পর যা সর্বোচ্চ। ২০০৮ সালে ব্যারেলপ্রতি দাম উঠেছিল ১৪৭ ডলারে। তেলের এই আকাশছোঁয়া মূল্য মূল্যস্ফীতির ঝুঁকির পূর্বাভাস দিচ্ছে।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, আটলান্টিকের দুই পাড়েই মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। ফলে ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা যাবে কমে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে পোশাকের চাহিদার ওপর, যা বাংলাদেশের রপ্তানির মেরুদণ্ড।
বিশ্ববাজারে জ্বালানির অভূতপূর্ব মূল্যবৃদ্ধিতে ইতিমধ্যেই বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। বুধবার বিপিসি চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ জানান, প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিন প্রায় ৬৩ কোটি টাকা লোকসান গুনছে।
লোকসানের বোঝা আরও বাড়ালে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটির জন্য আমদানি ব্যয় এবং পরিচালন ব্যয় মেটানো আরও কঠিন হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তেলের ওপর বাংলাদেশের ভর্তুকির পরিমাণও যে বাড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অবশ্য ভর্তুকির বোঝা জনগণের ঘাড়ে চাপাতে চাইলে অন্য হিসাব। তবে দুটো সিদ্ধান্তেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে—প্রথমটির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আসবে আর্থিক দিক থেকে। দ্বিতীয় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ যাবে বেড়ে।
বিশেষজ্ঞরা 'স্ট্যাগফ্লেশনে'র আশঙ্কাও করছেন। যখন মূল্যস্ফীতি নাটকীয় হারে বাড়ে এবং সে তুলনায় প্রবৃদ্ধি ধীরগতির হয়, তখন স্ট্যাগফ্লেশন দেখা দেয়।
রাশিয়া অপরিশোধিত তেল ও তেলজাত পণ্যের শীর্ষ রপ্তানিকারক। প্রতিদিন ৭ মিলিয়ন ব্যারেল, অর্থাৎ মোট অপরিশোধিত তেল ও তেলজাত পণ্যের ৭ শতাংশ রপ্তানি করে দেশটি।
যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগান পূর্বাভাস দিয়েছে, রাশিয়ার তেল রপ্তানির ওপর এরকম বাধা অব্যাহত থাকলে ২০২২ সালের শেষ নাগাদ ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম রেকর্ড ১৮৫ ডলার ছুঁতে পারে।
তেলে বাংলাদেশের ভর্তুকিও বাড়তে পারে।
রাশিয়ান তেলের ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞার ফলে বিশ্ব যে গতিতে করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠছে, সেই গতি ধীর হয়ে যাবে।
ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকের (ইসিবি) প্রাথমিক হিসাব অনুসারে, পরিস্থিতি না বদলালে চলমান যুদ্ধের ফলে চলতি বছরে ইউরোজোনের প্রবৃদ্ধি ০.৩ থেকে ০.৪ শতাংশীয় পয়েন্ট কমবে। কিন্তু পরিস্থিতি যদি এরচেয়েও খারাপ হয়, তাহলে প্রবৃদ্ধি কমবে ১ শতাংশীয় পয়েন্ট।
ইউক্রেন সংকট ও ক্রমবর্ধমান তেলের মূল্যবৃদ্ধির মুখে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন ইরান ও ভেনেজুয়েলার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার সিদ্ধান্তের কথা ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। আমেরিকার উদ্দেশ্য, দেশ দুটি থেকে তেল আমদানি করা। তাছাড়া ওপেক প্লাসকেও সরবরাহ বাড়ানোর অনুরোধ করছে আমেরিকা। কিন্তু দুটি পথই পিচ্ছিল।
জো বাইডেনের সঙ্গে আলোচনার জন্য আমেরিকা সৌদির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানকে অনুরোধ করেছিল, কিন্তু দুজনেরই কেউই সাড়া দেননি।
মানবাধিকার, বিশেষ করে সৌদি রাজতন্ত্রের সমালোচক ও সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যার বিষয়ে বাইডেন প্রশাসন কঠোর অবস্থান নিয়েছিল। এখন রাশিয়ার তেল উৎপাদন ও সরবরাহ বন্ধের ধাক্কা সামলাতে আমেরিকা সৌদি আরবের সহায়তা চাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে বেকায়দায় পেয়ে গেছে সৌদি রাজতন্ত্র।
আর ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য জরুরি ভিত্তিতে পারমাণবিক চুক্তি করতে হবে। কাজেই নিষেধাজ্ঞার চাপে জেরবার ইরানের সামনেও এখন সুবর্ণ সুযোগ তেলের ওপর ভর করে অর্থনীতিকে চাঙা করে তোলার।
তবে ইইউ যেহেতু রাশিয়ার জ্বালানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল—এবং রাশিয়ার বৃহত্তম দুই তেলক্রেতা চীন ও ভারত নিষেধাজ্ঞার পথে হাঁটেনি—তাই আমেরিকার এই তেল-নিষেধাজ্ঞা এখনও সর্বব্যাপী হয়ে ওঠেনি।
আর বাংলাদেশ কাগজে-কলমে সম্ভবত এখনও রাশিয়ার কাছ থেকে বাজারদরের চেয়ে কম দামে তেল কিনতে পারবে—কিন্তু সেক্ষেত্রে পশ্চিমের রোষানলে পড়তে হতে পারে।
বিপিসির ওপর লোকসানের বোঝা বাড়ছে
বিপিসির সূত্র জানিয়েছে, এক লিটার ডিজেলের আমদানি ও সরবরাহ খরচ প্রায় ১১৮ টাকা, অথচ খুচরা মূল্য ৮০ টাকা।
এ কারণে স্থানীয় বাজারে এক লিটার ডিজেল খুচরা বিক্রির করে বিপিসির লোকসান হয় ৩৮ টাকা। আর বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেল খুচরা বিক্রি করে কর্পোরেশনের মোট লোকসানের পরিমাণ বর্তমানে দাঁড়ায় ৬৩ কোটি টাকা।
বিপিসি সর্বশেষ মূল্য সমন্বয় করে গত বছরের ৪ নভেম্বর। ওই সময় প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম প্রায় ২৩ শতাংশ বাড়িয়ে ৬৫ টাকা থেকে ৮০ টাকা করা হয়। ওই দিন ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি প্রায় ৮২ ডলার।
কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের জেরে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম বাড়তে থাকে এবং বুধবার দাম ব্যারেলপ্রতি ১২৪ দশমিক ২৩ ডলারে উঠে যায়।
পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে বলে বিপিসির জন্য এ দাম আরও বেশি পড়ে। বিপিসি সূত্র জানায়, মঙ্গলবার বুকিং দেয়া শেষ দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ১৬৬ দশমিক ৫৬ ডলার।
চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি, যুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই দিন আগে প্রতি ব্যারেল পরিশোধিত তেলের বুকিং দর ছিল ১১১ ডলার।
পরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম সাধারণত প্ল্যাটস রেট অনুযায়ী ঠিক করা হয়। প্ল্যাটস রেট বুকিং তারিখের আগের এবং পরের দুই দিনের দাম পর্যালোচনা করে।
রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালায় ২৪ ফেব্রুয়ারি। সেদিন থেকে থেকে এ পর্যন্ত বিপিসি দেড় লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি করেছে।