দেশের প্রত্যেকটি ঘর আলোকিত করেছে সরকার: প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রায় দেশের সবচেয়ে বড় এবং অত্যাধুনিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধনের মাধ্যমে দেশকে শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় আনার সাফল্য তুলে ধরে বলেছেন, মুজিববর্ষে দেশের প্রত্যেকটি ঘর আলোকিত করেছে সরকার, এটাই সব থেকে বড় সাফল্য।
সোমবার (২১ মার্চ) প্রধানমন্ত্রী ১৩শ' ২০ মেগাওয়াট পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নামফলক উন্মোচনের মাধ্যমে পরিবেশ বান্ধব আল্ট্রা-সুপারক্রিটিকাল প্রযুক্তিসহ কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আজকে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং মুজিববর্ষে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে আমরা আলো জ্বালতে পারলাম এটাই হচ্ছে সব থেকে বড় কথা। আমরা আলোকিত করেছি এদেশের প্রত্যেকটি মানুষের ঘরকে।'
পরিবেশবান্ধব আল্ট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির সাহায্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করার মাধ্যমে, বাংলাদেশ 'মুজিব বর্ষে' দেশকে শতভাগ বিদ্যুৎ কভারেজের আওতায় আনার অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করে আরেকটি মাইলফলক অর্জন করেছে।
কোভিড-১৯ মহামারির প্রাদুর্ভাবে বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্ব থমকে যাওয়ার পর এটিই প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগতভাবে প্রথম কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে সশরীরে সফর।
'৭৫ পরবর্তী সরকারগুলোর এদেশকে এগিয়ে নেওয়ায় কোনো আন্তরিকতাই ছিল না উল্লেখ করে তিনি বলেন, '২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকে ২০২২ সাল এই দীর্ঘ সময় সরকারে থাকতে পেরেছি সেজন্য কৃতজ্ঞতা জানাই বাংলাদেশের জনগণের প্রতি। ভোট দিয়ে আমাদেরকে তারা নির্বাচিত করেছেন।'
শেখ হাসিনা বলেন, 'এই ১৩ বছর একটানা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অব্যাহত রয়েছে, এরমধ্যে ঝড় ঝঞ্ঝা অনেক এসেছে, বাধা অনেক এসেছে কিন্তু সেগুলো আমরা অতিক্রম করেছি। এগুলো অতিক্রম করেও আমরা গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে পেরেছি বলেই আজকে বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে।'
প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলে জাতির পিতা একে স্বল্পোন্নত দেশের পর্যায়ে রেখে গিয়েছিলেন, আজকে সেই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে।' তিনি বলেন, 'ওয়াদা করেছিলাম প্রতিটি মানুষের ঘর আলোকিত করব, প্রতিটি মানুষ আলোকিত হবে, সেই আলোর পথে আমরা যাত্রা শুরু করেছি। আজকের দিনটা সেই আলোর পথে যাত্রা শুরু যে সফল হয়েছে, সেই দিন।'
প্রধানমন্ত্রী রমজান ও ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে জাতির জন্য উপহার হিসেবে উল্লেখ করেন।
পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে সহযোগিতার জন্য চীনের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান শেখ হাসিনা।
পায়রা ১৩শ' ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি দক্ষিণ পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার অন্তর্গত রামনাবাদ নদীর পাশে ২ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে ১০০০ একর জমিতে নির্মিত হয়েছে এবং এই প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে আল্ট্রা সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশ্বের ১৩তম দেশে পরিণত হয়েছে।
পাওয়ার প্ল্যান্টের প্রথম ৬৬০ মেগাওয়াট ইউনিটটি ২০২০ সালের মে মাসে বাণিজ্যিকভাবে চালু হয়, ৪০০ কেভি পায়রা-গোপালগঞ্জ পাওয়ার ট্রান্সমিশন ব্যবহার করে এবং দ্বিতীয়টি গত বছরের ডিসেম্বরে উৎপাদন শুরু করে।
১৩শ' ২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়াও, আরেকটি পাওয়ার প্ল্যান্টের নির্মাণ কাজ চলছে এবং সরকারের আরও একটি ্৩২০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং এখানে পায়রায় একটি সোলার সিস্টেম পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
প্ল্যান্টটি তৈরি করছে বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি (বিসিপিসিএল), চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশন (সিএমসি) এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) এর মধ্যে একটি ৫০:৫০ যৌথ উদ্যোগ।
বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি (প্রা.) লিমিটেড এবং এনইপিসি এবং সিইসিসি-এর কনসোর্টিয়াম পায়রা ১,৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়নের জন্য ২৯ মার্চ ২০১৬ তারিখে ইপিসি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে জনসংখ্যার ৯৮ শতাংশ এবং ৭৪ শতাংশকে বিদ্যুৎ নেটওয়ার্কের আওতায় এনেছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ২৫,৫১৪ মেগাওয়াট হয়েছে যা ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ৪,৯৪২ মেগাওয়াট ছিল। এর মধ্যে ১,১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে এবং ১৯,৬২৬ মেগাওয়াট স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা হচ্ছে।
২০০৯ সালে, জনসংখ্যার মাত্র ৪৭ শতাংশের বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ ছিল। মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ২২০ কি:ও: থেকে ৫৬০ কি:ও:এ উন্নীত হয়েছে এবং বিদ্যুতের বিতরণ ক্ষতি ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে।
সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে স্থানীয় চর সোনারামপুর, আশুগঞ্জ, রাঙ্গাবালী, মনপুরা, সন্দ্বীপ, হাতিয়া, নিঝুম দ্বীপ ও কুতুবদিয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নামফলক উন্মোচন করেন, শান্তির প্রতীক ১,৩২০টি পায়রা অবমুক্ত করেন এবং প্ল্যান্টের সেন্ট্রাল কন্ট্রোল রুম ঘুরে দেখেন।
এর আগে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সংলগ্ন হেলিপ্যাডে প্রধানমন্ত্রী পৌঁছালে তাকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়।
পরে প্রধানমন্ত্রী কয়লা জেটিতে পৌঁছানোর সাথে সাথে বিভিন্ন রঙে সজ্জিত ২০০ জেলে নৌকা থেকে চলন্ত পতাকা ও গান বাজিয়ে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানানো হয়।
প্রধানমন্ত্রীকে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানে 'মেমেন্টো' উপহার দেয়া হয়। তাকে উৎসর্গ করে 'ও জোনাকি কি সুখে ঐ ডানা দুটি মেলেছ' শিরোনামে একটি গানও এ সময় পরিবেশিত হয়।
অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি এবং পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি অডিও-ভিডিও উপস্থাপনাও প্রদর্শিত হয়।
পর্যটন স্পট কুয়াকাটা থেকে পায়রা পাওয়ার প্লান্ট এবং এর আশপাশের এলাকাগুলোতে প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে কেন্দ্র করে উৎসবের আমেজ বিরাজমান ছিল।
প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মো. হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি (প্রা.) লিমিটেডের মহাপরিচালক (ডিজি) ইঞ্জিনিয়ার এ এম খুরশেদুল আলম।