নোয়াখালীর হাতিয়ায় এবার প্রায় ৩০০ কোটি টাকার চেউয়া শুঁটকি উৎপাদন
নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ-উপজেলা হাতিয়া। এ দ্বীপের চারপাশে রয়েছে মেঘনা নদী, তার পাশে বঙ্গোপসাগর। মৌসুমে দ্বীপে জেলেদের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ে বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ, তবে অন্য মাছের তুলনায় এবার প্রচুর পরিমাণে চেউয়া মাছ ধরা পড়েছে, যা গত ৮-১০ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। চলতি মৌসুমে উপজেলার ১৫টি ঘাটে চেউয়া শুঁটকি উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৩৬ হাজার টন, যার বাজারমূল্য প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। চেউয়া মাছের সাইজ ও আকার বড় হওয়ায় এর চাহিদাও বেড়েছে। দেশে চেউয়া মাছের অর্ধেক চাহিদা মেটায় এ জনপদের মৎস্যজীবিরা। শুধু চেউয়া মাছ আর শুঁটকি নয়, মৌসুমে ইলিশের জন্যও বিখ্যাত হাতিয়ার বিভিন্ন ঘাট। বছরজুড়েই এখানে সাগরের নানান প্রজাতির মাছ ও শুঁটকি উৎপাদন হয়।
এতকিছুর পরও যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত হওয়ায় প্রতিনিয়ত দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে স্থানীয় মৎস্যজীবিদের। তাদের দাবি, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে বর্তমানের চেয়ে আরও কয়েক গুণ বাড়বে তাদের শুঁটকির উৎপাদন। প্রধান ঘাট জঙ্গলিয়ায় একটি রাডার লাইট স্থাপনের দাবি করেছে সংশ্লিষ্টরা। তবে চেউয়া মাছ ধরা, শুঁটকি উৎপাদন ও কাজের সাথে জড়িত শ্রমিক এবং শুঁটকি উৎপাদনের সঠিক কোন তথ্য নেই উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তরের কাছে।
যেভাবে তৈরি হয় চেউয়া শুঁটকি
নদী থেকে মাছ ধরার পর তা সঠিক সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকলে মাছ সহজেই পচে যায়। মাছ সংরক্ষণের প্রাচীন পদ্ধতি হলো আগে তা রোদে শুকানো। রোদে শুকিয়ে নিলে মাছ থেকে পানি ও বিভিন্ন অণুজীব, যা মাছ পচতে সহায়তা করে তা নষ্ট হয়ে যায়। পরে তা অন্তত ৩-৪ দিন খোলা মাঠে বাতাস ও রোদে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতে সবচেয়ে সহজে এবং কম খরচে শুঁটকি উৎপাদন করা যায়। তবে মাঝে মাঝে লবণেরও ব্যবহার করতে হয় শুঁটকিতে। আর এভাবেই হাতিয়া উপকূলে প্রতি মৌসুমে হাজার হাজার টন চেউয়া শুঁটকি উৎপাদিত হচ্ছে।
স্থানীয়দের তথ্যমতে, গত বছরের তুলনায় মাছের পাশাপাশি চেউয়া শুঁটকি উৎপাদনের কাজে জেলে, শ্রমিক বেড়েছে। উপজেলার বিভিন্ন ঘাট সংলগ্ন চরে প্রায় ৫ হাজার একর জমির ওপর চলে এ চেউয়া শুকানো ও শুঁটকি উৎপাদনের কাজ। নদী থেকে মাছ তোলার পর রোদে শুকিয়ে শুঁটকি উৎপাদন করতে সময় লাগে তিন থেকে চার দিন। শুটকি উৎপাদনের পর তা প্রথমে বড়-বড় স্তুপ করে ঢেকে রাখা হয়। পরবর্তীতে তা ওজন করে বিভিন্ন সাইজের বস্তায় সংরক্ষণ করে পাইকারি বিক্রি করা হয়।
চেউয়া শুঁটকি উৎপাদনের সাথে জড়িতদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চলতি মৌসুমের শুরু থেকে মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগরে প্রচুর পরিমাণ চেউয়া মাছ ধরা পড়ে। উপজেলার জঙ্গলিয়া ঘাট, জাহাজমারা ঘাট, কাদিরিয়া ঘাট, বুড়িরদোনা ঘাট, সূর্যমুখী ঘাট, দানারদোন ঘাট, কাজীরঘাট, আমতলী ঘাট, কাটাখালি ঘাট, রহমত বাজার ঘাট, নামার বাজার, চেউয়াখালি ঘাট, বাজার খাল, ডুবাই খাল ও মুক্তারিয়া ঘাট থেকে প্রতিদিন মাছ ধরতে গভীর সমুদ্রে যেতো ইঞ্জিনচালিত প্রায় ৩৫০ নৌকা। প্রতিটি নৌকায় ২জন মাঝি, ২৫ জন নাইয়া ও জেলে থাকেন। নৌকায় মাছ ধরার কাজে জড়িত অন্তত সাড়ে ৯ হাজার মানুষ। শুঁটকি তৈরির জন্য ছোটশ-বড় মাছ বাছাই করে রোদে শুকানোর কাজ করেন বিভিন্ন বয়সের আরও ১০০০ জন শ্রমিক। এর বাইরে মৌসুমি জেলেদের পাশাপাশি এ কাজে জড়িত আছেন যানবাহন মালিক-শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। ঘাটগুলোতে শুঁটকির ৮৫ জন পাইকারের পাশাপাশি খুচরা বিক্রেতা আছেন অন্তত ৩ শতাধিক। এছাড়াও ময়মনসিংহ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, চাঁদপুর, মুক্তাগাছা, ত্রিশাল, ভৈরব, বরিশাল, ভোলা, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অন্তত অর্ধশতাধিক পাইকার আসেন শুঁটকি ক্রয়ের জন্য।
তারা অভিযোগ করে বলেন, এ দ্বীপে হাজার হাজার টন শুঁটকি উৎপাদন হলেও উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তরের কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী আমাদের খবর রাখেন না। ঘাট ও সড়কের সমস্যা নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে মৎস্য অফিসে জানানো হলেও বছরের পর বছর গেলেও এসব সমস্যার কোন সমাধান হচ্ছে না।
জেলেরা জানান, হাতিয়ায় চেউয়া শুঁটকি উৎপাদনের সাথে জড়িত সকল বেপারীদের ৫-১০টি করে মাছ ধরার নৌকা রয়েছে। চলতি মৌসুমে প্রতি মণ কাঁচা মাছের মূল্য পড়ছে ১ হাজার টাকা করে। পরবর্তীতে শ্রমিক দিয়ে তা থেকে শুঁটকি উৎপাদনে প্রতি কেজিতে খরচ পড়ে ৩ টাকা করে। শুঁটকি উৎপাদনে কাজ করা প্রতি শ্রমিককে ৪৫০ টাকা করে দিনের মজুরি দিতে হয়। মাছ ক্রয় করে শুঁটকি উৎপাদনে লাভ কিছুটা কম হয়। নদীতে মাছ শিকারে যারা নিয়োজিত, তাদের মৌসুমভিত্তিক হিসেব করে সর্বমোট আয়ের একটি অংশ দেওয়া হয়। প্রতি বছরের বাংলা পৌষমাসে শুরু হওয়া এ চেউয়া মাছের মৌসুম চলে চৈত্র মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত। হাতিয়া অঞ্চলের জেলেদের হাত ধরে পূরণ হচ্ছে দেশের অর্ধেক চেউয়া মাছের চাহিদা। এ দ্বীপের চেউয়া শুঁটকি মাছ ও মুরগির খাদ্য (ফিড) উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়।
জঙ্গলিয়া ঘাটের কয়েকজন বিক্রেতা জানান, মৌসুমে মেঘনার এ ঘাট থেকে হাজার হাজার মণ কাঁচা মাছ বাজারজাত করা হয়। এর একটা অংশ জেলার বিভিন্ন বাজারে খুচরা হিসেবে তাজা বিক্রি করা হয়। তবে এর বড় একটি অংশ দিয়ে উৎপাদন করা হয় শুঁটকি। চলতি মৌসুমে ৬টি ধাপে শুঁটকি বিক্রি করা হয়েছে। প্রথম দিকে প্রতি মণ শুঁটকি ২৬০০ টাকা করে বিক্রি করলেও পরবর্তী ধাপগুলোতে ২৮০০-২৯০০টাকা করে বিক্রি করা হয়েছে। চৈত্র মাস পর্যন্ত আরও ১-২ ধাপ বিক্রি করার আশা করছেন তারা।
জেলেরা বলছেন, প্রতি মৌসুমে কোটি কোটি টাকার চেউয়া মাছ ও শুঁটকি উৎপাদন হলেও এ অঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থার ও পারাপারের অতিরিক্ত খরচের কারণে আয়ের অংকটা কমে যায়। মূল ঘাটটি মোহাম্মদপুর বাজার সংলগ্ন পূর্ব পাশে। কিন্তু বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার সাথে সাথে চর পড়ে যাওয়ায় নৌকাগুলোকে চলে যেতে হয় ওইঘাটের তিন থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে। ফলে এ পুরো পথ জেলেদের মাথায় কিংবা কাঁধে বোঝা করে এসব মাছ নিতে হয় জঙ্গলিয়া ঘাটের বেড়িতে। ফলে নদীপথেই কাঁচা মাছ বাজারজাত করতে গিয়ে আয় কমে যাচ্ছে জেলেদের। আবার শুঁটকির জন্য যেসব মাছ শুকানোর উদ্দেশ্যে আনা হচ্ছে সেখানেও শ্রমিক খরচ বেশি যাচ্ছে। মেঘনার সঙ্গে সংযুক্ত শাখা খালটি (জঙ্গলিয়া খাল) ৩০-৪০ ফুট গভীর ও দুই পাশ সংস্কারের মাধ্যমে চওড়া করে পশ্চিম পাড়ে বেড়ি বাঁধ তথা সড়ক নির্মাণ এবং সরকারীভাবে একটি লেন্ডিং ব্যবস্থা করা হলে শুধু চেউয়া নয়, সব মৌসুমে মাছ ও শুঁটকি উৎপাদন করে লাভবান হবে এ অঞ্চলের জেলেরা। প্রতি বছর এ আয়ের একটি অংশ সরকারের রাজস্বে যোগ হলেও যাতায়াত ব্যবস্থার বিষয়ে নজর নেই কর্তৃপক্ষের।
জঙ্গলিয়া ঘাটের কয়েকজন স্থানীয় পাইকার বলেন, এ মৌসুমে চেউয়া মাছ ও শুঁটকির বাজার বেশ ভালো। কিন্তু ভালো যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকার কারণে বাজারজাত করা কষ্টকর। শুষ্ক মৌসুমে মেঘনা নদী থেকে মাছের নৌকা ঘাটে আনা সম্ভব হয় না। নির্বিঘ্নে এ অঞ্চলের উৎপাদিত মাছ ও শুঁটকি দ্রুত দেশের বিভিন্ন বাজারে পৌঁছে দিতে হলে যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। এতে জেলে, মাঝি ও শ্রমিকদের পাশাপাশি পুরো জনপদের মানুষ আর্থিকভাবে লাভবান হবে।
জাহাজমারা ঘাটের শুঁটকি উৎপাদনকারী আবদুর রহিম মাঝি বলেন, চলতি মৌসুমে যে পরিমাণ চেউয়া মাছ পাওয়া গেছে তা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়েছে। কাঁচা মাছের তুলনায় বাজারে শুঁটকির ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে। ইলিশসহ মাছের মৌসুমে যে ক্ষতি হয়েছে চেউয়া দিয়ে আমরা তা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। এতকিছুর পরও আমাদের যাতায়াত-যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় দিন শেষে হাতাশ হতে হচ্ছে। বিশেষ করে জঙ্গলিয়া ঘাটে একটি 'রাডার লাইট' স্থাপন অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। রাতে নদী-সমুদ্র থেকে জেলেরা মাছ ধরে ফেরার সময় রাডার লাইট না থাকায় ঘাট খুঁজে পেতে সমস্যা হচ্ছে। প্রায়সময় মাছ নিয়ে তারা ভুল পথে গিয়ে ভাটায় আটকা পড়ে, যার ফলে নৌকায় থাকা মাছগুলো পচে যায়। পচা মাছগুলো না কাঁচা বিক্রি করা যায়, না শুঁটকি তৈরি করা যায়; পরে বাধ্য হয়ে তা নদীতে ফেলে দিতে হয়। তাই এ অঞ্চলের মৎস্যজীবিদের স্বার্থে মৎস্য বিভাগ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জঙ্গলিয়া ঘাটে একটি রাডার লাইট স্থাপনের দাবি জানান তিনি।
হাতিয়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অনিল চন্দ্র দাস জানান, চলতি মৌসুমে চেউয়া শুঁটকি উৎপাদনের কোন বিবরণ এখনও তৈরি হয়নি। জেলেদের কাছ থেকে উৎপাদনের তথ্য নেওয়ার পর বলা যাবে। তাদের সমস্যাগুলোর বিষয় লিখিত পেলে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ পেশার সাথে কতগুলো পরিবার বা মানুষ জড়িত এবং তাদের কোনোপ্রকার সরকারি সহযোগিতা করা হচ্ছে নাকি- এমন প্রশ্নের জবাবে এ কর্মকর্তা বলেন, চেউয়া মাছ শিকার এবং শুঁটকি উৎপাদনে যারা জড়িত তাদের কোন পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। আর তাদের জন্য সরকারি কোন বরাদ্দ না থাকায় সহযোগিতা করা সম্ভব হয় না।