আইনপ্রয়োগকারীরাই যখন আইন ভেঙে নিজের মৃত্যু ডেকে আনেন
বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, সড়কে সবচেয়ে বেশি আইন ভাঙেন খোদ আইনপ্রয়োগকারী পুলিশ সদস্যরাই। এমনকি আইন ভঙ্গ করে তারা নিজের জীবনই ফেলে দেন ঝুঁকির মধ্যে।
খোদ বাংলাদেশ পুলিশের তথ্যই বলছে, পুলিশ সদস্যদের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু সাধারণ মানুষের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেশি। বাংলাদেশ পুলিশের একটি সমীক্ষা অনুসারে, প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩.২ জন সাধারণ মানুষ মারা যান, অথচ পুলিশ সদস্য মারা যান ৩০ জন।
সমীক্ষায় বলা হয়েছে পুলিশের মধ্যে উচ্চ মৃত্যুর অন্যতম কারণ, মোটরবাইক চালানোর সময় পুলিশ সদস্যরা নিজেদেরকে অন্যদের চেয়ে বেশি ক্ষমতাধর মনে করেন, ট্রাফিক নিয়ম উপেক্ষা করেন, যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা করেন না বা ড্রাইভিং-সংক্রান্ত কাগজপত্র ঠিকমতো রাখেন না।
গবেষণায় আরো বলা হয়েছে, 'রাস্তায় চলাচলের সময় পুলিশ সদস্যরা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েন। সহকর্মীদের কাছ থেকে আইনি সহায়তা পাওয়ার চিন্তায় তারা রাস্তায় আরও ঝুঁকি নিতে উৎসাহী হয়ে ওঠেন।'
সমীক্ষা পরিচালনাকারী দলটি ৫২৯টি সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, পুলিশ সদস্যদের এরকম দুর্ঘটনার কারণ খুঁজে বের করা এবং সড়কে ঝুঁকি কমানোর ও দক্ষতা বাড়ানোর উপায় সুপারিশ করা।
সমীক্ষা দলটিতে ছিলেন বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) মো. আব্দুর রাজ্জাক, বাংলাদেশ পুলিশের এআইজি (ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা) একেএম মোশাররফ হোসেন মিয়াজী এবং পুলিশ সদর দপ্তরের উপপরিদর্শক (পরিকল্পনা ও গবেষণা-২) মো. হাসানুল বাশার।
অতি-আত্মবিশ্বাস ডেকে আনছে সর্বনাশ
নিজেদের যানবাহন—বেশিরভাগ সময় মোটরসাইকেল—নিয়ে সড়কে চলাচল করার সময় পুলিশ সদস্যরা খুব কম সময়ই লাইসেন্স ও অন্যান্য কাগজপত্র সঙ্গে রাখেন। কারণ তারা মনে করেন, ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গ করলেও তাদের কিছুই হবে না। সমীক্ষাটি বলছে, পুলিশ সদস্যরা যেসব যানবাহনে চড়ে, সেগুলোর ফিটনেস পরীক্ষা করা হয় না।
এছাড়া অনেক সময় পুলিশ সদস্যরা মানসিক চাপ ও অস্থিরতা নিয়ে যানবাহন চালান, যা অনেক সময় সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। সমীক্ষা বলছে, আরেকটি চমকপ্রদ বিষয় হলো, পুলিশ সদস্যরা ৩২ শতাংশ ক্ষেত্রে অন্য যানবাহনের সঙ্গে সংঘর্ষ না করেই সড়ক দুর্ঘটনায় পড়েন।
তারা মূলত বেপরোয়া ও অসতর্ক অবস্থায় গাড়ি চালানোর কারণে এরকম দুর্ঘটনার শিকার হয়। বেপরোয়াভাবে যানবাহন ধাওয়া করতে গিয়েও দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার নজির রয়েছে।
বাংলাদেশ পুলিশের মুখপত্র দ্য ডিটেকটিভ-এর মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত সমীক্ষার তথ্য বলছে, ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্বে জড়িত থাকার কারণে সড়ক দুর্ঘটনার শিকারদের ৯৯ শতাংশই পুরুষ।
তাদের মধ্যে ৬৬ শতাংশের বয়স ২১-৪০ এর মধ্যে। কারণ এই বয়সের সদস্যরাই ফ্রন্টলাইন দায়িত্ব পালন করছেন। ফলে তাদেরই সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ার সম্ভাবনা বেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছে সমীক্ষায়।
বাহিনীর এসআই, এএসআই ও সার্জেন্ট পর্যায়ের সদস্যদের সঙ্গে কনস্টেবলদের সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ার ঝুঁকি বেশি। ৬৪.৮ শতাংশ ক্ষেত্রে তারা দিনের বেলায় সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সঙ্গী নিয়ে যানবাহন চালানো পুলিশ সদস্যরা সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন।
বাংলাদেশ পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক ও মুখপাত্র মো. কামরুজ্জামান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য আমরা সবসময়ই আমাদের কর্মীদের আইন মেনে চলানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করি।
পুলিশ সদস্যদের মধ্যে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমানো যায় যেভাবে
বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে গবেষণায় বলা হয়েছে, পুলিশ সদস্যদের নিয়োগের সময় যথাযথভাবে যানবাহন চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত।
এছাড়া পুলিশ সদস্যদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও ব্রিফিংয়ের ব্যবস্থা করার ওপরও জোর দেয়া হয়েছে সমীক্ষায়। এছাড়া মোটরসাইকেল চালানোর সময় পুলিশ সদস্যদের আরও সতর্ক থাকার প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করা হয় গবেষণায়।
সমীক্ষায় আরও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যথাযথ প্রশিক্ষণ শেষ করার পর সমস্ত পুলিশ কর্মীকে যেন ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া হয়। তাদের ড্রাইভিং দক্ষতা নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত বলেও মন্তব্য করা হয় এতে।
গবেষণা দলটি চাকরিতে নিয়োগের সময় দক্ষ চালকদের অগ্রাধিকার দেওয়ারও প্রস্তাব করেছে। প্রয়োজনে তাদের জন্য কোটা ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করেছে গবেষণা দল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে যে কারণগুলো গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, দ্রুত সেগুলোর সুরাহা করা দরকার।
সড়কে পুলিশের বেপরোয়া আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়
—মুহাম্মদ নুরুল হুদা, বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক আইজিপি
রাস্তায় চলাচলের সময় বাংলাদেশে পুলিশ সদস্যরা নিজেদেরকে অন্যদের চেয়ে বেশি ক্ষমতাধর মনে করেন। এটা ভালো না। এটি সমাজে ভালো বার্তা দেয় না। পুলিশ সদস্যরা আইন প্রয়োগের জন্য কাজ করেন। তাদের বেপরোয়া আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
তত্ত্বাবধায়ক কর্মকর্তাদের উচিত মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের পর্যবেক্ষণে রাখা। কোনো গাফিলতি পেলে প্রয়োজনে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
এমনকি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ট্রাফিক নিয়ম না মানলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। সড়ক দুর্ঘটনায় পুলিশের কোনো অন্যায় আচরণ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ পুলিশকে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে হবে।
[সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা ফোনে টিবিএস প্রতিবেদক আসাদুল্লা লায়নের সঙ্গে কথা বলেছেন]
পুলিশের আচরণ সংশোধনে শিগগিরই কর্মসূচি আসছে
—মো. কামরুজ্জামান, সহকারী মহাপরিদর্শক ও বাংলাদেশ পুলিশের মুখপাত্র
আমরা সবসময় আমাদের মাঠ পর্যায়ের যেসব কর্মী মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন, তাদেরকে নিরাপত্তার বিষয়ে পরামর্শ দিই। হেলমেট এবং অন্যান্য সুরক্ষামূলক গিয়ার পরতে ও সঠিকভাবে গাড়ি চালাতে বলা হয় তাদের। এছাড়াও তাদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে ড্রাইভিং লাইসেন্স রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তত্ত্বাবধান একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। তবে দুর্ঘটনা মোটেই প্রত্যাশিত নয়। অবহেলাজনিত দুর্ঘটনা এড়াতে আমরা সবসমই আমাদের কর্মীদের আইন মেনে চলানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করি।
এছাড়া রাতে, কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া বা বৃষ্টিতে গাড়ি চালাতেও নিষেধ করি তাদের।
পুলিশ সদস্যদের সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার হার বাড়ার কারণ ও কার্যকর সমাধান বের করতে বেশ কিছু গবেষণা করা হচ্ছে। গবেষণার পর অচিরেই কিছু প্রোগ্রাম (উদ্যোগ) চালু করা হতে পারে।
পুলিশের মৃত্যুর কারণগুলোর দ্রুত সমাধান করা প্রয়োজন
—শাহদীন মালিক, আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট
পুলিশদের মধ্যে সড়কে প্রাণহানির যত তথ্য পেয়েছে পুলিশ, তা নতুন কিছু নয়, বরং এটা ওপেন সিক্রেট।
পুলিশের গবেষণায় সড়ক দুর্ঘটনার যেসব কারণ উঠে এসেছে, সেগুলোকে খুবই যৌক্তিক মনে হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ পুলিশই সম্ভবত প্রথম, যারা এই করুণ সত্য প্রকাশ করেছে।
দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ও সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করার দায়িত্ব পুলিশের। কিন্তু বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার বলে এসেছে, বাংলাদেশ পুলিশ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। তারা শুধু ট্রাফিক শৃঙ্খলা আনতেই ব্যর্থ হয়নি, ব্যর্থ হয়েছে নিজেদের জীবন বাঁচাতেও।
সড়ক দুর্ঘটনার যেসব কারণ গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, অবিলম্বে সেগুলোর সমাধান করা প্রয়োজন। আর চাকরিরত পুলিশ সদস্যদের প্রতি সরকারকে আরও আন্তরিক হতে হবে।
এছাড়া এরকম দুর্ঘটনা রোধে পুলিশ সদর দপ্তরকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
[বুধবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সিনিয়র রিপোর্টার রেজাউল করিমের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন শাহদীন মালিক]
পুলিশ সদস্যদের বেপরোয়া ড্রাইভিংয়ে অন্যরাও উৎসাহী হয়
—অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান, পরিচালক, দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউট (এআরআই), বুয়েট
পুলিশ সদস্যরা সমাজ ও সাধারণ মানুষের রোল মডেল। কাজেই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও ক্ষমতাধর হওয়ার অনুভূতির দ্বারা প্ররোচিত হয়ে তাদের ফিটনেস ও লাইসেন্সবিহীন মোটরসাইকেল ও অন্যান্য যানবাহন চালানো এবং ওভারটেকিং করা অনাকাঙ্ক্ষিত।
সাধারণ প্রাইভেট কার চালক বা রাইড শেয়ারিং চালকরাও পুলিশ সদস্যদের অনুসরণ করেন। এমন অবস্থায় পুলিশ সদস্যরা ট্রাফিক নিয়ম না মানলে তা সমাজে ভালো বার্তা দেয় না।
এছাড়া আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি সরকারি ড্রাইভার ও সিটি কর্পোরেশনের ড্রাইভাররা সড়কে বেপরোয়া আচরণ করেন। এবং তাদের অনেকের ড্রাইভিং লাইসেন্স পর্যন্ত নেই।
আমরা দীর্ঘদিন ধরে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। কিন্তু এ ধরনের আচরণ সেই প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং অন্যদের আইন মানতে নিরুৎসাহিত করছে। সবার ডোপ টেস্ট করার ভালো উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ বিভাগ। আমি একে সমর্থন করি।
এছাড়া পুলিশবাহিনীর একটি বড় অংশকে মাঠ পর্যায়ের দায়িত্ব পালনে দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হয় বলে আমি মনে করি। ট্রাফিক ব্যবস্থার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তারা প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই আইনের প্রয়োগ প্রায় অসম্ভব।
কিন্তু দায়িত্ব পালনের সময় তাদের কীভাবে শান্তি দেওয়া যায়, কীভাবে তাদের বসার ব্যবস্থা, পুষ্টিকর খাবার ও শৌচাগারের ব্যবস্থা করা যায় সেদিকেও নজর দিতে হবে। প্রখর রোদে ও বৃষ্টিতে এই মানুষগুলো তাদের দায়িত্ব পালন করেন।
ডিউটি থেকে বাড়ি ফেরার পথে ক্লান্ত শরীরে মোটরসাইকেল চালাতে হলে দুর্ঘটনায় পড়ার সম্ভাবনা থাকে।
এছাড়া তাদের ডিউটির সময়ও নির্ধারণ করা উচিত। যাতে ক্লান্ত হয়ে না পড়েন, সেজন্য তাদেরকে মানসিক চাপ থেকে দূরে রাখতে হবে। আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, ট্রাফিক পুলিশরা যেন আন্তঃজেলা ভ্রমণের সময় কোনোভাবেই মোটরসাইকেল ব্যবহার না করেন।
[টিবিএসের স্টাফ রিপোর্টার জিয়া চৌধুরীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন অধ্যাপক এম হাদিউজ্জামান।]