কৃষিকাজ ব্যতীত অন্য কাজে কৃষিজমি ব্যবহারে তিন বছরের জেল
দেশের কৃষিজমিগুলো কৃষিকাজ ব্যতীত অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না উল্লেখ করে সংসদে একটি বেসরকারি বিল পেশ করা হয়েছে। কৃষিজমিতে অন্য কাজ করলে তিন বছরের জেল অথবা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিতর বিধানের প্রস্তাব দেওয়া হয় ওই বিলে।
বৃহস্পতিবার (৩১ মার্চ) জাতীয় পার্টির সাংসদ রওশন আরা মান্নান কৃষি জমি(যথাযথ ব্যবহার ও সংরক্ষণ) বিল-২০২২, উত্থাপন করেন।
পরে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী সেটি পরীক্ষা করে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বেসরকারি সদস্যদের বিল ও সিদ্ধান্ত প্রস্তাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠান।
বিলে বলা আছে, দেশের কৃষিজমিগুলো কৃষিকাজ ব্যতীত অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না এবং অন্য কোনো কাজের জন্য ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করা যাবে না।
তবে ব্যক্তিগতভাবে বসবাসের জন্য ঘর নির্মাণ, কবরস্থান, শ্মশান, অন্যান্য ধর্মীয় সৎকারের স্থান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য এ বিধান প্রযোজ্য হবে না।
শাস্তির বিধানে আছে, কোনো ব্যক্তি এ আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে তিন বছরের জেল অথবা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
কেউ কৃষিজমিতে শিল্পকারখানা, রাস্তা, আবাসন বা অন্য স্থাপনা নির্মাণ করলে তদারক কমিটি নোটিশ দিয়ে নির্মাণকাজ ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেবে।
অন্য আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, নির্মাণকাজ ভেঙে ফেলার জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না বলে উল্লেখ আছে প্রস্তাবিত বিলে।
প্রস্তাবিত আইনে অনুযায়ী, কৃষিজমির যথাযথ ব্যবহার ও সংরক্ষণের জন্য একটি তদারক কমিটি গঠন করার কথা বলা হয়েছে। তদারক কমিটির প্রধান হবেন- সংশ্লিষ্ট এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। এছাড়া উপজেলার কৃষি, ভূমি, মৎস্য, শিক্ষা, পরিসংখ্যান, সমবায়, যুবউন্নয়ন, সমাজসেবা, মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা এবং সব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এর সদস্য হবেন।
উল্লেখ্য, মন্ত্রী ছাড়া কোনো সংসদ সদস্যকে 'বেসরকারি সদস্য' বলা হয়। সপ্তাহের বৃহস্পতিবারকে বেসরকারি সদস্য দিবস বলা হয়। এর আগে নবম সংসদে বেসরকারি সদস্যদের দ্বারা উত্থাপিত ১৪টি বিলের মধ্যে তিনটি বিল পাস হয়েছিল।
বিল পাসের প্রতিবাদে বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশিদের সংসদ থেকে ওয়াকআউট
এদিকে সংসদে পৌরসভার নির্বাচিত পরিষদের মেয়াদ শেষ হলে প্রশাসক নিয়োগের বিধান যুক্ত করে পৌরসভা আইনের সংশোধনী 'স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) (সংশোধন) বিল-২০২২' পাশের প্রস্তাব করলে এর বিরোধিতা করেন বিরোধী দলের সাংসদরা।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম সংসদে বিলটি বিবেচনার জন্য প্রস্তাব করলে, এর বিরোধিতা করে বিলটির উপর জনমত যাচাইয়ের দাবি জানান বিরোধী দলের বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য। কিন্তু তারপরও সরকারি দলের সাংসদদের কন্ঠ ভোটে বিলটি পাশ হয়ে যায়।
প্রতিবাদে বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশিদ ওয়াকআউট করেন। এর আগেই বিল পাসের আলোচনায় হারুন বিলের একটি ধারার স্পষ্ট ব্যাখ্যা দাবি করেন এবং এসবের ব্যাখ্যা না পেলে ওয়াকআউট করবেন বলেও জানান। তবে তাকে সন্তুষজনক জবাব দিতে পারেনি স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম।
আলোচনায় হারুনুর রশীদ বলেছিলেন, "স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো ক্যান্সারে আক্রান্ত। স্থানীয় সরকারগুলোর একটি বিরাট অংশের প্রতিনিধি বিনাভোটে নির্বাচিত, বিরাট অংশ প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে নির্বাচিত। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর মানুষ এমন স্থানীয় সরকার আশা করেনি।"
তিনি বলেন, "সংবিধানে সকল পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কথা বলা আছে। নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করতে না পারলে সেটার জন্য সরকার দায়ী। প্রতিনিধিদের সরিয়ে দিয়ে সরকারদলীয় লোকদের বসানোর জন্য এটি করা হচ্ছে।"
একে 'বাকশালি পদ্ধতি' চালুর চেষ্টা উল্লেখ করে হারুন বলেন, "জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা এখন আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসূচি পালন করছে। জনগণকে সেখানে অংশ নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। ভিন্নমতের কেউ সেখানে না গেলে তাদের সরিয়ে দেওয়া হবে, এই উদ্দেশে এই আইন করা হচ্ছে।"
এছাড়া বিলটির উপর আলোচনায় অন্য সাংসদরা বিলটি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করেন।
জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, "সংবিধানে বলা হয়েছে নির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা স্থানীয় সরকার পরিচালিত হবে। প্রশাসক নিয়োগের বিধান সংবিধানের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। নতুন পৌরসভা গঠনের পর প্রথমবার নির্বাচনের আগে একজন প্রশাসক নিয়োগ করা যেতে পারে, সেটা জরুরি প্রয়োজনে। আমলাতন্ত্র দিয়েই যদি কাজ হতো তাহলে স্থানীয় সরকারের কোনও প্রয়োজন ছিল না।"
জাপার পীর ফজলুর রহমান বলেন, "যেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকার কথা সেখানে অনির্বাচিত কেউ বসতে পারবেন না। এটা সংবিধানের স্পিরিট। তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনির্বাচিত সরকার এ কারণে এটা রাখা হয়নি। সেখানে কেন স্থানীয় সরকারে অনির্বাচিত ব্যক্তিকে বসানো হবে—এটা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক।"
জবাবে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, "জনগণ, জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্নজনের মতামত নিয়ে আইনে সংশোধনী আনা হচ্ছে। প্রশাসক নিয়োগের বিধান রাখার বিষয়টি যৌক্তিক। বিভিন্ন কারণে অনেক সময় নির্বাচন করা নিয়ে আইনগত জটিলতা তৈরি হয়। অনেকে এর সুযোগ নিয়ে থাকেন।"
'সচিব' পদটিকে 'পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা' নামকরণের বিষয়ে তিনি বলেন, "মন্ত্রণালয়ে সচিব থাকেন। পদটি নিয়ে অনেক সময় সংশয় দেখা দেয়। কিছু ক্ষেত্রে এই পদের অপব্যবহারও দেখা গেছে।"
কী পরিবর্তন এসেছে নতুন বিলে
বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, পৌরসভা ঘোষণা করতে হলে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে গড়ে দেড় হাজার হতে হবে। এর কম হলে হবে না। সংশোধিত বিলে তা বাড়িয়ে দুই হাজার করা হয়েছে।
বিল পৌরসভার সচিবের পদের নাম বদলে 'পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা' করা হয়েছে।
বিদ্যমান আইনে মেয়র ও কাউন্সিলদের অপসারণ সংক্রান্ত ধারনায় নতুন একটি ধারা 'ঝ' যুক্ত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে—মেয়র অথবা কাউন্সিলর তার নিজ পদ হইতে অপসারণযোগ্য হবেন, যদি সরকার কর্তৃক সময় সময় প্রদত্ত নির্দেশ পালন করতে ব্যর্থ হন।
বিদ্যমান আইনের ৪২(১) ধারায় বলা হয়েছে, 'কোন শহর এলাকাকে পৌর এলাকা ঘোষণার পর পৌরসভার কার্যাবলী সম্পাদনের জন্য সরকার একজন উপযুক্ত কর্মকর্তাকে প্রশাসক নিয়োগ করবে এবং পৌরসভা গঠন না হওয়া পর্যন্ত উক্ত প্রশাসক প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করবেন'।
বিলে এই ধারায় পরিবর্তন করে বলা হয়েছে, পৌরসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নতুন পরিষদ গঠনের আগ পর্যন্ত কাজ চালানোর জন্য প্রশাসক নিয়োগ দেবে সরকার। সরকারি কোনও কর্মকর্তা বা সরকার উপযুক্ত মনে করে এমন কোনো ব্যক্তিকে প্রশাসক নিয়োগ দেবে। তবে প্রশাসক একাধিক বার বা ১৮০ দিনের বেশি পদে থাকতে পারবেন না।
বিলে পৌরসভার পরিষদ বাতিল সংক্রান্ত ধারায় নতুন বিধান যুক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাদিক্রমে ১২ মাস বেতন বকেয়া থাকলে পরিষদ বাতিল হবে।
নতুন পৌরসভা গঠন হলে বা কোনো ইউনিয়নের অংশবিশেষ পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত হলে বিলুপ্ত ইউনিয়ন বা বিলুপ্ত অংশে কর্মরতদের পৌরসভায় অন্তর্ভুক্তির সুযোগ রাখা হয়েছে বিলে।