সৌরবিদ্যুৎ যেভাবে বদলে দিয়েছে মেঘনার জেলেদের জীবন
লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডার সেন্টার খাল মাছ ঘাট। এ ঘাটের তিন দিকে নদী ও খালে রাতের বেলায় যেন জোনাকির ন্যায় আলো জ্বলছে। মনে হয় পুরো এলাকা একটি বিয়েবাড়ি। ঘাটে মাছ বিক্রি করতে আসা জেলেদের নৌকার আলো দূর থেকে দেখতে বিয়েবাড়ি কিংবা জোনাকির মতো লাগে।
লক্ষ্মীপুরের প্রধান নদী মেঘনার বুকে বছরের বেশিরভাগ সময়ই সারি সারি নৌকাতে এমন আলো চোখে পড়ে। শুধু আলোই না, নদীতে ভেসে বেড়ানো সব নৌকাতে রয়েছে ডিজিটাল সামগ্রী। এসব পণ্য সামগ্রী ব্যবহারে জেলেদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি হয়েছে। বেড়েছে নানা সুযোগ, জ্বালানি হিসেবে কেরোসিন ব্যবহার বন্ধ হওয়ার কারণে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন জেলেরা। বিগত কয়েক বছরে জেলেদের জীবনে এমন ব্যতিক্রমী পরিবর্তন এসেছে বলে জানান স্থানীয় জেলেরা।
গত ৬-৭ বছর ধরে জেলেদের নৌকাসহ নদীতে ভাসমান নৌযান আলোকিত করতে বছরে কোটি টাকার ইলেকট্রিক পণ্য বিক্রির বাজার গড়ে ওঠেছে লক্ষ্মীপুরের পুরো মেঘনাপাড় জুড়ে। স্থানীয় জেলে, ব্যবসায়ী এবং নদী এলাকার বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
মেঘনা নদীর লক্ষ্মীপুর অংশে চর রমনীমোহন এলাকায় দেখা যায়, ইলিশের জাল ফেলে কয়েকজন জেলে নৌকা নিয়ে মাছ উঠানোর জন্য অপেক্ষা করছে। তাদের নৌকার কাছে যেতেই চোখে পড়লো জেলেদের কয়েকজন স্মার্টফোনে গান শুনছে, ২/৩ জন ছবি দেখছে। মাঝনদীতে ফোন চার্জ দেয়া হয় কিভাবে, কাছে গিয়ে এমন প্রশ্ন রাখতেই একজন নৌকার উপরে থাকা সৌর বিদ্যুতের প্যানেলের দিকে ইশারা করে দেখালো। পরে মুখে বলল, সৌর বিদ্যুতেই তাদের সব কাজ হয়।
নৌকার মাঝি ইব্রাহীম জানায়, মোবাইল ফোন চার্জ দেয়া, রাতে অন্য নৌযান থেকে নিজেদের জাল রক্ষার জন্য জালের মাথায় নিশানা বাতি, অন্য নৌযানের সাথে নিজেদের নৌকার সংঘর্ষ এড়াতে নৌকাতে নিশানা বাতি, ভেতরের আলো এবং সংকেত বাতি ইত্যাদি সব কাজেই এখন তারা সৌর বিদ্যুৎ ও আধুনিক ইলেকট্রিক পণ্য ব্যবহার করেন।
নৌকায় থাকায় ইউছুফ মাঝি জানায়, ৬-৭ বছর আগেও নদীতে মাছ ধরার সময় রাতের বেলায় অন্য নৌকা ও ফিশিংবোড প্রায়ই ধাক্কা দিত। এতে নদীতে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটত। এখন আর তা হয় না। এখন নৌকায় নিশানা বাতি ও ভেতরে আলো থাকার কারণে দূর থেকে যে কোন নৌযান চোখে পড়ে। মূলত নৌকায় বিদ্যুৎ ব্যবহারে এমন সুযোগ ও নিরাপত্তা তৈরি হয়েছে।
এ প্রতিবেদকদের বহনকারী নৌকার মাঝি আলমগীর জানান, পাঁচ বছর আগে ৫০ ওয়াটের একটি সৌর বিদ্যুতের চ্যানেল লাগিয়েছেন তিনি। এতে ৩টি বাতি ও একটি ছোট পাখা চলে। তিনি আরো জানান, আগে নৌকার বাতি জ্বালাতে মাসে প্রায় দেড় হাজার টাকার কেরোসিন ব্যবহার করতেন। তাছাড়া বৈরী আবহাওয়া ও ঝড়ের সময় কেরোসিন বাতি নিভে যেতো। এখন সে সমস্যা নেই। মাসে সাশ্রয় হচ্ছে দেড় হাজার টাকার মতো।
রামগতি উপজেলার টাংকি বাজার মাছঘাটের সভাপতি মোঃ আবদুর রব জানান, গত ১০-১২ বছর থেকেই নদীর জেলেরা সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন। এর ফলে তাদেরকে আগের মতো ঝামেলা পোহাতে হয় না। আধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন সামগ্রী আর সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করে জেলেরা রাতে মাছ শিকার করে, জাল মেরামত করে, নদীতে জাল ফেলে, জাল উঠায়, মাছ সংগ্রহ করে, ফোন চার্জ দেয়, রান্নাবান্নাসহ সব কাজ করে। এখন সৌর বিদ্যুৎ ছাড়া জেলেদের জীবন একদিনও চলে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
রামগতির আলেকজান্ডার ঘাটের মাছ ব্যবসায়ী হারুণ মিয়া বলেন, "এখন মেঘনা তীরের আকাশে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে নৌকার আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে পড়ে নদীর স্বচ্ছ জলে। জেলেরা রাতের প্রয়োজনীয় সব কাজ সারেন সৌর শক্তির আলোয়। এখন আর বাতাসে বাতি নিভে যাওয়ার ভয় নেই।"
মতিরহাট বাজারের ইলেকট্রিক ব্যবসায়ী ও লক্ষ্মীপুর জেলা টেলিকম অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা জসিম হাওলাদার জানান, ৬-৭ বছর আগে সর্বপ্রথম নৌকায় বিদ্যুতের সংযোগ দেয় বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। তাদের হাত ধরে জেলেরা নৌকায় বৈদ্যুতিক বাতি ব্যবহার শুরু করে। এখন রীতিমতো বিপ্লব ঘটেছে। বর্তমানে এনজিও নেই। এখন স্থান দখল করেছে বিভিন্ন কোম্পানী।
তিনি জানান, মেঘনা নদীর মজুচৌরীরহাট ঘাট থেকে রামগতির টাংকি বাজার পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার নদীপাড়ে ২৭০টি টেলিকম ও ইলেকট্রিক দোকান গড়ে ওঠেছে যারা মূলত নৌকার জেলেদের নিকট ইলেকট্রিক পণ্য বিক্রি করে।
জসিম হাওলাদার আরো জানায়, এসব দোকানদারের প্রতিজন জেলেদের নিকট ৫ থেকে ৫০ হাজার টাকার ইলেকট্রিক পণ্য বিক্রি করে থাকে।
চর কালকিনি এলাকার জেলে কালাম জানায়, একটি নৌকায় আলোকসজ্জার জন্য সৌর প্যানেল, ব্যাটারি, চার্জার, চার্জ কন্ট্রোলার, ফিশিং লাইট, জব লাইট, ওয়াচ লাইট এবং সাধারণ বাতিসহ ১০-১৫ রকমের বৈদ্যুতিক সরাঞ্জাম বিক্রি হয়ে থাকে। তার ভাষ্যমতে, প্রতিদিনই বিভিন্ন নৌকায় এ সকল বৈদ্যুতিক সামগ্রীর দরকার হয়।
অন্যদিকে স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা কোডেকের তথ্যমতে, লক্ষ্মীপুরের মেঘনায় ভাসমান নৌকায় বসবাস করছে প্রায় ৩ হাজার বেদে জেলে পরিবার। সাধারণ জেলে ছাড়াও নদীতে বসবাসকারী ভাসমান বেদে জেলেরাও সৌর বিদ্যুৎ কাজে লাগিয়ে তাদের সংসারকে সাজিয়ে তুলছেন। ফলে তাদের জীবনযাত্রার চিত্রও বদলে গেছে। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে তাদের পরিবারেও।
এ ব্যাপারে গ্রামীণ শক্তির লক্ষ্মীপুর শাখার সাবেক কর্মকর্তা দুলাল সুত্রধর জানান, মূলত গ্রামীণ শক্তি সোলারের মাধ্যমে নদীর জেলেরা বৈদ্যুতিক বাতি ব্যবহারের প্রথম সুযোগ পায়। একটি বিশেষ প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ শক্তি লক্ষ্মীপুরসহ উপকূলীয় জেলার বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চল ও গ্রামীণ জনপদের অজপাড়াগাঁ এবং জেলেদের নৌকায় বিদ্যুৎ সেবা পৌঁছে দেয়।
এদিকে লক্ষ্মীপুর জেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তার দপ্তর ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, লক্ষ্মীপুর জেলায় মেঘনা নদীর সীমানা রয়েছে ৮৮ কিলোমিটার। সেখানে প্রায় ১ লাখ অধিবাসী মৎস্য শিকারের সাথে জড়িত। মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে, লক্ষ্মীপুরে নিবন্ধিত মৎস্যজীবির সংখ্যা ৫০ হাজার ২৫২ জন। লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীতে প্রায় ৩ হাজার অনুমোদিত ফিশিং ট্রলার ও কয়েক হাজার ছোট নৌকা রয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা মৎস্য বিভাগ।