বাবার হত্যার বিচার পেতে আইনজীবী মেয়ের ১৬ বছরের লড়াই
২০০৬ সালে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদকে। ওই সময় তার মেয়ে শেগুফ্তা তাবাসসুম আহমেদ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। তার বাবাই তাকে আইন বিভাগে ভর্তি করে দেন। আইন বিভাগে ভর্তি হলেও তিনি কখনোই ভাবেননি আইনজীবী হবেন কিংবা বাবার হত্যার বিচার পাওয়ার আশায় ১৬ বছর তাকে আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে।
২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তাহের আহমেদ নিখোঁজ হন। ৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসার বাইরে ম্যানহোলে তাহেরের লাশ পাওয়া যায়। লাশ উদ্ধারের পরদিন ড. তাহেরের ছেলে সানজিদ আলভী মতিহার থানায় মামলা করেন। তদন্ত কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন উপপরিদর্শক আহসানুল কবির ২০০৭ সালের ১৮ মার্চ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। এতে তাহেরের বিভাগীয় সহকর্মী মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী, তাহেরের বাসভবনের তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীর, জাহাঙ্গীরের ভাই ও ছাত্রশিবিরের কর্মী আবদুস সালাম, তাদের (জাহাঙ্গীর ও আবদুস সালাম) বাবা আজিমুদ্দীন ও সালামের আত্মীয় নাজমুলকে অভিযুক্ত করা হয়।
২০০৭ সালে তাহের হত্যা মামলার প্রধান আসামি একই বিভাগের সাবেক শিক্ষক মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন যখন জামিনে মুক্ত হন তখনই শেগুফ্তা তাবাসসুম আহমেদ সিদ্ধান্ত নেন আইনজীবী হবেন। তার পরিবার থেকেও তখন সেই সিদ্ধান্তই দেওয়া হয়।
শেগুফ্তা তাবাসসুম আহমেদ বৃহস্পতিবার বিকেলে মুঠোফোনে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, '২০০৬ সালে আমার বাবা আমাকে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি করে দেন। আমি তখন থেকেই আসলে আইনের ছাত্রী। তবে আমার প্র্যাকটিসিং 'লইয়্যার' হওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না। আইন বিষয়ে পড়ে তো অনেক বিষয়ে কাজ করা যায়। শিক্ষকতা করা যায়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করা যায়, আইনগত পরামর্শ দেওয়া যায়, অনেক কাজ করা যায়। আমার "আউট অব কোর্টে" কাজ করার ইচ্ছে ছিল সবসময়। কিন্তু বড় ধরনের অ্যাম্বিশন ছিল, অবশ্যই লিগ্যাল ফিল্ডে কাজ করব, রিমার্কেবল ফিল্ডে কাজ করব। কোর্টের বারান্দায় এভাবে ঘোরা, যে কষ্টটা আমাকে এই ১৬ বছর করতে হয়েছে, এই ধরনের কষ্টের কথা আমি চিন্তা করিনি। এই পেশায় প্র্যাকটিস করার কথা চিন্তায় ছিল না।'
শেগুফ্তা তাবাসসুম আহমেদ বলেন, 'দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আদালতে মামলাটি যাবার পর আমার মা, ভাইকে রাজশাহীতে কোর্টে যেতে হতো। আমার মা একজন সাধারণ গৃহিনী, কোর্ট-কাচারি যারা কখনো দেখেননি, কিন্তু কষ্টটা তো কম করেননি। সাক্ষ্যপ্রদান থেকে শুরু করে প্রসিডিয়াল যেসব স্টেপ রয়েছে সেসব করা, কথা বলা, নানা ধরনের বাধার সম্মুখীন হওয়া। আমি আইনের ছাত্রী হিসেবে সাহায্য করতাম, কিন্তু আমি তো তখন আইনজীবী ছিলাম না।
'এর মধ্যেই কিছুদিন পর জানতে পারলাম যে হাইকোর্ট থেকে প্রধান আসামি জামিনে মুক্তি পেয়েছে। আমার মা তখন আরও অসহায় হয়ে পড়লেন। এ ধরনের ঘটনা কীভাবে ঘটে।
'আর আমরা একটা সাধারণ পরিবার। আমাদের পরিবারের সবাই অন্যান্য পেশায় যুক্ত, কিন্তু কেউ আইনজীবী না। কোর্টের সাথে সম্পৃক্ত না থাকলে, ওই অ্যাকসেসটা না থাকলে, আমরা যে এই যুদ্ধটা যে চালিয়ে নিতে পারব না, আমরা তখন বুঝে ফেলেছি। এবং আমার মা, ভাই, আমি দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই যে আমার পেশাটা আইনজীবী হতে হবে। তা না হলে আমরা যোগাযোগ করতে পারব না। যদিও এটা ফৌজদারি মামলা। অর্থাৎ এই মামলা পরিচালনা করবে রাষ্ট্রপক্ষ। যদিও আমরা চাইলে অনেক লইয়্যার অ্যাপয়েন্ট করতে পারি। কিন্তু আমাদের তো সেই সামর্থ্য ছিল না। আসামিপক্ষ যেমন ১৫-২০ জনের মতো আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছিলেন। আমাদের হয়তো অনেক আইনজীবী স্বউদ্যোগে সাহায্য করেছেন।'
শেগুফ্তা তাবাসসুম আহমেদ জানান, তার বাবা হত্যা মামলার আসামি জামিনে মুক্ত হওয়ার পরই তিনি প্র্যাকটিসিং লইয়্যারর হিসেবে কাজ করার কথা ভাবেন। 'কারণ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর সাথে কথা বলতে হয়। সবসময় যোগাযোগ করতে হয়। কারণ প্র্যাকটিসিং লইয়্যার ছাড়া তো একটা অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে সাধারণ মানুষ হিসেবে ঢুকে কথা বলব, আমি তো এটা চিন্তা করতে পারি না। সেখানে একজন আইনজীবীর পক্ষে তা অনেক সহজ। এছাড়া আইনের ছাত্রী হওয়ায় তা আরও সহজ হয়েছে।'
শেগুফ্তা বলেন, 'আমি যেহেতু আইন পড়ছিলাম, আমার বাবার সন্তান হিসেবে এই পরিস্থিতিতে সেখানে আইনজীবী হওয়াই আমার একমাত্র পথ ছিল। আমরা সেই পথ অনুসরণ করলাম। আমরা যেহেতু সত্যের পথে ছিলাম, ফলে কেন পিছিয়ে যাব?
'দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মধ্যে এইরকম পরিস্থিতিতে অনেক কষ্টের মধ্যেও আমার মা ও ভাই চেয়েছে যে আমার যাতে পড়াশোনা ঠিকভাবে শেষ হয়। যাতে পরবর্তীতে মামলা দেখাশোনা করা ও রাষ্ট্রপক্ষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা সহজ হয়। কারণ মামলার আগে-পিছনে কত যে কাজ করতে হয়। আবার কোর্টে শত শত মামলা পড়ে থাকে। আমার বাবার জন্য আমার যে আবেগ সেটা তাদের না-ও থাকতে পারে। ফলে সব বিষয় বিবেচনা করেই আমার আইনজীবী হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না।'
২০১৩ সালে হাইকোর্টের রায়ের পরও আপীল বিভাগের রায় পেতে বিলম্ব হওয়ার কারণ জানতে গিয়ে শেগুফ্তা তাবাসসুম আহমেদ বলেন, 'কোর্টে শত শত মামলার চাপে আমাদের মামলার আসলে তেমন কোনো প্রায়োরিটি ছিল না হাইকোর্টে। এইজন্য বিলম্ব হয়েছে। তবে এই অ্যাটর্নি জেনারেল অনেক গুরুত্ব দিয়ে মামলার নিষ্পত্তি করতে সহায়তা করেছেন।'
শেগুফ্তা জানান, উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার পরও শুধু বাবার হত্যা মামলার কারণে তিনি অন্যদিকে তেমন একটা মনোযোগ দিতে পারেননি।
তিনি বলেন, 'রক্তে যেভাবে ওষুধ মিশে যায়, আমি এই মামলাটির সাথে ঠিক সেইভাবে মিশে গিয়েছিলাম। অনেক শিক্ষকদের সন্তানকেই বলেছি, যাদের বাবাকে হত্যা করা হয়েছে, তাদেরকে ডেকেছি কিন্তু তারা কোর্টে আসতে চায় না। আসলে এত বিড়ম্বনার কারণেই কোর্টে আসতে চায় না তারা।'
সর্বশেষ গত ৫ এপ্রিল অধ্যাপক এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলায় দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড ও দুজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল খারিজ করে এ রায় দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ।
এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে শেগুফ্তা তাবাসসুম আহমেদ বলেন, 'এই রায় হওয়াতে সন্তোষ প্রকাশ করছি।'
দ্রুত এই মামলার রায় কার্যকর করার দাবি জানান তিনি।