'ধর্ম অবমাননা'র দায়ে গ্রেপ্তার হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের মুক্তি চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের বিবৃতি
সম্প্রতি মুন্সিগঞ্জের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে 'ধর্ম অবমাননার' অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের ৭২ জন শিক্ষক এক যৌথ বিবৃতিতে তাকে মুক্তি দেয়ার দাবি তুলেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক বিবৃতিতে বলেছে, "আমরা শ্রেণিকক্ষের ওই কথোপকথনের লিখিত রূপ পড়েছি, এবং ওই আলাপচারিতাকে স্বাভাবিক এক বিতর্ক বলেই মনে করছি। শিক্ষকের দিক থেকে ধর্মীয় অবমাননার কোনো প্রয়াস তো ছিলই না, বরং যুক্তি দিয়ে, একাডেমিক ভঙ্গিতে শিক্ষার্থীদের বোঝানোর ও ব্যাখ্যা করার একটি মনোভঙ্গি এতে স্পষ্ট ছিল। তার যুক্তি ও ব্যাখ্যার ধরন ও মান শিক্ষক। যদিও শিক্ষার্থীর দিক থেকে ছুঁড়ে দেয়া প্রশ্নগুলো উদ্দেশ্যমূলক ভাবার অবকাশ রয়েছে। বক্তব্য রেকর্ড করে ছড়িয়ে দেয়া, মামলা হওয়া ইত্যাদির পরে এ ধারণাটি স্পষ্ট হয়।"
সেখানে বলা হয়, "শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল বিজ্ঞানের চর্চায় নিবেদিতপ্রাণ একজন এবং তার একান্ত সত্তাটি আপাদমস্তক শিক্ষকতারই সত্তা। কারণ যতটা ধৈর্য্য ধরে তিনি তার শিক্ষার্থীদের উস্কানিমূলক অযাচিত প্রশ্নের বিন্দুমাত্র বিরক্তি প্রকাশ ব্যতীত উত্তর করে গেছেন তা তার বিনয় ও জ্ঞানেরই বহিঃপ্রকাশ। এমন মহান একজন শিক্ষককে যেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করা প্রয়োজন, সেখানে রাষ্ট্র তাকে কারাগারে বন্দী করেছে।"
"শিক্ষক ও নাগরিক হিসেবে আমরা মনে করি শিক্ষকের কাজই হলো শিক্ষার্থীদের চিন্তা-জগতকে প্রসারিত করতে সাহায্য করা, তাদের মধ্যে জানার কৌতূহল সৃষ্টি করা, প্রশ্ন করার সাহস সঞ্চার করা ও অনুসন্ধিৎসু মন তৈরি করা। হৃদয় এই চেষ্টাই করেছেন। কারও দ্বিমত থাকলে তর্ক-বিতর্ক হবে, সহনশীলতাসহ যুক্তি-পাল্টা যুক্তির মধ্য দিয়ে জ্ঞানের জগৎ সম্প্রসারিত হবে। কিন্তু মতামতের জন্য জোরজুলুম হবে কেন? একদিকে এক ধর্মীয় গোষ্ঠীর দাবির মুখে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনা হচ্ছে, পাশাপাশি অন্য কেউ ঠিক করে দিতে চাচ্ছে ক্লাসে কী পড়ানো যাবে, কী যাবে না? সমাজে এমন এক পরিবেশ তৈরী হয়েছে যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে মুখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে, পোশাক-পরিচ্ছদের স্বাভাবিক অংশ কপালের টিপের জন্য জনপরিসরে হেনস্থা হচ্ছে নারী, ছবি ছাড়াই পরিচয়পত্র তৈরীর দাবি উঠেছে।"
হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের মুক্তি দাবি করে বিবৃতি বলেছে, "অবিলম্বে হৃদয় মণ্ডলকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে এবং তাকে হেনস্থা করার জন্য দুঃখপ্রকাশ করতে হবে। আর যারা অসহিষ্ণুতা, প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে তদন্তের মাধ্যমে তাদের উন্মোচন করে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।"
বিবৃতিদাতাদের মধ্যে আছেন অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন, কাবেরী গায়েন, সহযোগী অধ্যাপক কাজলী সেহরীন ইসলাম ও খোরশেদ আলম, ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসনীম সিরাজ মাহবুব ও মোঃ তানভীর আহসান, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক স্বাধীন সেন ও মাসউদ ইমরান মান্নু, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক স্বপন আদনান, সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক মাইদুল ইসলাম, নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক কাজী শুসমিন আফসানা, নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নাসরিন খন্দকার, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের গৌতম রায়, যুক্তরাষ্ট্রের বার্ড কলেজের এক্সপেরিমেন্টাল হিউম্যানিটিজের ভিজিটিং প্রফেসর ফাহমিদুল হক প্রমুখ।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি সিনিয়র বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান ও ধর্ম নিয়ে বিতর্ক হয়। সেই স্বাভাবিক বিতর্ককে শিক্ষকের অজান্তে রেকর্ড করে ক্লাসের বাইরে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় ক্লাসেরই শিক্ষার্থীরা। ক্লাসের অভ্যন্তরীণ বিতর্ক এ থেকে ভিন্ন দিকে মোড় নেয়, শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা হয়, তিনি গ্রেপ্তার হন এবং তার জামিনও নামঞ্জুর হয়।