অবৈধ জ্যামার, বুস্টারের কারণে ঢাকার ২১২টি স্থানে নেটওয়ার্ক সমস্যা
ঢাকার লালমাটিয়ার বাসিন্দা সজিব হোসেনকে (ছদ্মনাম) গত কয়েক বছর ধরেই তার বাসায় দুর্বল মোবাইল নেটওয়ার্ক ও সিগন্যালের সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। বাসায় থাকলে বেশিরভাগ সময়ই তার ফোনে কল যায় না, কল ড্রপও হয় অনেক বেশি। স্থিতিশীল নেটওয়ার্ক পেতে বাসা থেকে বের হয়ে কল করেন তিনি।
"আমার লালমাটিয়ার বি-ব্লকের বাসায় বেশিরভাগ সময়ই গ্রামীণফোন ও এয়ারটেলের নেটওয়ার্ক সিগন্যাল পাইনা। বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তা পার হলেই আবার পুরোপুরো সিগন্যাল পাওয়া যায়," বলেন সজিব।
মহাখালী ডিওএইচএসে'র বাসিন্দা তানভীর আহমেদের বাসায়ও ইনকামিং ও আউটগোয়িং কলের নেটওয়ার্ক সিগন্যাল থাকে না। কিন্তু, অন্যান্য জায়গায় আবার নেটওয়ার্ক ঠিকই থাকে।
দুর্বল মোবাইল নেটওয়ার্কের জন্য তাদের মোবাইল অপারেটরকে দায়ী করেছেন তানভীর ও সজিব। তবে, অবৈধ সিগন্যাল জ্যামার ও বুস্টারের কারণেও এমনটা হতে পারে।
সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, দেশজুড়ে ৩২৫টি স্থানে এধরনের অবৈধ ডিভাইসের কারণে মোবাইল নেটওয়ার্ক বাধাপ্রাপ্ত হয়। ঢাকাতেই এরকম স্থান আছে ২১২টি।
জরিপে দেখা গেছে, মসজিদ ও মন্দিরে জ্যামার বসিয়েছে। অনেকে আবার ভালো নেটওয়ার্ক পেতে নিজ বাড়িতে বুস্টার ও রিপিটার বসিয়েছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ওই এলাকার অন্যান্যদের নেটওয়ার্ক।
ব্যবহারকারীদের অভিযোগের পর এই জরিপ চালানো হয়।
অ্যাসোসিয়েশন অফ মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অফ বাংলাদেশ (অ্যামটব) এরপর তথ্য সংগ্রহ করে।
একারণে কল ড্রপ, সাইলেন্ট কল ও ধীরগতির ডেটার মতো নেটওয়ার্ক সমস্যায় পড়েন মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীরা।
গ্রামীণফোনের চিফ করপোরেয় এফেয়ার্স অফিসার হোসেন সাদাত বলেন, "জ্যামার, রিপিটার বা বুস্টারের অনুনমোদিত ব্যবহার কল ড্রপ বা ধীরগতির ইন্টারনেটের অন্যতম প্রধান কারণ। কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার এসব অনুনমোদিত ডিভাইস ব্যবহারের কারণে গ্রাহকরা সমস্যার মুখে পড়ছেন"।
"এ ধরনের অনুনোমদিত আমদানি করা ডিভাইসের ব্যবহার ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করছি আমরা," বলেন তিনি।
মোবাইল অপারেটগুলো বলছে মোবাইল নেটওয়ার্কের সমস্যা দূর করতে সব অবৈধ জ্যামার, বুস্টার এবং রিপিটার বন্ধ করতে হবে।
রবি আক্সিয়াটা লিমিটের কর্মকর্তারা বলছেন, কিছু জায়গায় এসব অবৈধ ডিভাইস ব্যবহারের কারণে নেটওয়ার্ক সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে না।
রবির চিফ করপোরেট ও রেগুলেটরি অফিসার শাহেদ আলম বলেন, "আমরা ইতোমধ্যে অবৈধ টেলিযোগাযোগ ডিভাইস ব্যবহারের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। এ সমস্যা নিরসনে কঠোর ব্যবস্থা নিতে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করব"।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) লিগাল ও মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিআরটিসি) নির্দেশনা অনুযায়ী অবৈধ ভিওআইপি ও ওয়াকি-টকির বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযান চালানো হয়েছে।
তবে, কতোটি স্থানে অবৈধ জ্যামার বসানো থাকতে পারে এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য নেই র্যাবের কাছে।
"বিটিআরসি'র সাহায্য লাগলে এ অভিযান চালাতে সাহায্য করবো আমরা," বলেন তিনি।
বিটিআরসি'র ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত কুমার মৈত্র বলেন, নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের অনুমোদন এ ধরনের টেলিযোগাযোগ ডিভাইস বসানো অবৈধ এবং শাতিযোগ্য অপরাধ।
"মোবাইল অপারেটরগুলো ইতোমধ্যে বিষয়টি আমাদের নজরে এনেছে। এ ধরনের ডিভাইস জব্দ করতে আমরা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কাজ করবো," বলেন তিনি।
আবাসিক এলাকায় সমস্যা বেশি
জরিপটিতে দেখা গেছে, মহাখালী ডিওএইচএস, মিরপুর ডিএইচএস, বনানী, নিকুঞ্জ, পুরান ঢাকাসহ ঢাকা শহরের ২১২টি এলাকায় অবৈধ জ্যামার ও বুস্টারের কারণে নেটওয়ার্ক সমস্যা দেখা যায়।
পুরানা পল্টন, বনশ্রী, ধানমন্ডি ও পল্লবীতেও এ ধরনের সমস্যা দিন দিন বাড়ছে।
একবার এ ধরনের ডিভাইস বসালে আশেপাশের মানুষ কল চলাকালীন সময় ব্যাকগ্রাউন্ডে হর্নের মতো আওয়াজ শুনতে পান।
বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রাহকদের মোবাইলে সিগন্যাল বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় কল ড্রপ হয়, ইন্টারনেটের গতি কমে যায় ও নেটওয়ার্ক বার কমে যায়।
নিরাপত্তা ঝুঁকি?
কিছু সিগন্যাল জ্যামার টেলিকম নেটওয়ার্ক ব্লক করে দেওয়ার মতো শক্তিশালী হওয়ায় এর ব্যবহারকারীদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শনাক্ত করতে পারে না।
এ কারণে, এ ধরনের ডিভাইস বসাতে বিটিআরসি'র অনুমোদন লাগে। প্রতিষ্ঠানটির এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, অনুমতি ছাড়া এ ধরনের ডিভাইস বসানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু, দারাজ থেকে শুরু করে গুলিস্তান স্টেডিয়াম মার্কেট পর্যন্ত এ ধরনের ডিভাইস বিক্রি হয়।
২০২০ সালে অ্যামটব বিটিআরসি'কে এ বিষয়টি জানিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানায়।
২০২০ সালের অক্টোবরে, অ্যামটবের সেক্রেটারি জেনারেল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফরহাদ (অবঃ) স্বাক্ষরিত চিঠি পাঠানো হয় বিটিআরসি'কে। মোবাইল পরিষেবার মান উন্নত করতে রেডিও নেটওয়ার্কের বাধার সমস্যা কমিয়ে আনার জন্য একটি পরিকল্পনার রূপরেখা দেওয়া হয় ওই চিঠিতে।
এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে, এ ধরনের সমস্যা হয় এমন এলাকার তালিকা দিয়ে বিটিআরসি'কে জরুরি ভিত্তিতে সেসব এলাকা পরিদর্শনের অনুরোধ করা হয়।
তবে, এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছুই করেনি বিটিআরসি।