আগের পরিকল্পিত ২০০’র পরিবর্তে ঈদে ১০০টি অতিরিক্ত কোচ যুক্ত করবে রেলওয়ে
প্রতি বছর ঈদকে সামনে রেখে রেলওয়ে স্পেশাল সার্ভিস ছাড়াও নিয়মিত ট্রেনে অতিরিক্ত কোচ সংযোজন করে। করোনাকালীন গত দুই বছর ঈদের ট্রেন যাত্রায় অতটা চাপ না থাকলেও এ বছর চিত্রটা ভিন্ন। তবে বাড়তি চাহিদা পূরণে আগের অন্যান্য বছরের চেয়ে এবারে কোচ সংযোজন অর্ধেকে নেমে এসেছে। এতে ঈদের বাড়তি চাহিদাসম্পন্ন ট্রেনগুলোতে টিকিট বিক্রি করতে হিমশিম খেতে হবে রেলওয়ের বাণিজ্যিক বিভাগকে। মূলত রেলওয়ের কোচ মেরামত কারখানায় লোকবল ও বাজেট সংকটে আসন্ন ঈদে অতিরিক্ত কোচ সরবরাহ কার্যক্রম কাঙ্খিত হচ্ছে না।
আগে প্রতিবছর ১০০টি করে উভয় অঞ্চলে গড়ে ২০০ মেরামত হওয়া নতুন কোচ ঈদের জন্য সরবরাহ করতো। ২০২০ সালের শুরুতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে টানা দুই বছর ঈদযাত্রায় রেলের উপর এই চাপ ছিল না। তবে এবছর বাড়তি চাহিদা সত্ত্বেও উভয় অঞ্চলের দুটি মেরামত কারখানা থেকে কোচ সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র ১০০টি।
রেলের পরিবহন ও বাণিজ্যিক বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, করোনাকালীন বিধিনিষেধ উঠে আসায় এবছর ঈদে আগের কয়েক বছরের তুলনায় সবচেয়ে বেশি যাত্রী সমাগম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু প্রকৌশল বিভাগ থেকে অতিরিক্ত কোচ বরাদ্দ অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় কম। ঈদের জন্য ৫০টি করে অতিরিক্ত কোচ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও ইতোমধ্যে ৩৫টি করে বিভিন্ন ট্রেনে সংযোজন করা হয়েছে। এই হিসাবে ঈদের জন্য উভয় অঞ্চলে কোচ পাওয়া যাবে ১৫টি করে। প্রকৌশল বিভাগে বাড়তি চাহিদা দেয়া হলেও ঈদের জন্য সীমিত কোচ সরবরাহ দেয়ার ঘোষণায় ঈদ যাত্রায় বাণিজ্যিক বিভাগ টিকিট বিক্রিতে ভোগান্তির মধ্যে পড়বেন বলে আশঙ্কা করছেন তারা। পূর্বাঞ্চল রেলের কারখানা পাহাড়তলী ও পশ্চিমাঞ্চলের রেলের সৈয়দপুর কারখানায় কোচ মেরামত করা হয়। দীর্ঘদিনের পুরনো কারখানা দুটি কয়েক বছর আগে প্রকল্পের অধীনে সংস্কারও করা হয়েছে। কয়েকশ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প শেষ হলে কারখানার মেরামত সক্ষমতা বাড়লেও লোকবল সংকট, মেরামত উপকরণের সরবরাহ সংকট ও বাজেট বরাদ্দ অপ্রতুল হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী মেরামত কার্যক্রম চালাতে পারছে না কারখানা দুটি। যার কারণে দুটি কারখানা থেকে ঈদের জন্য মাত্র ৫০টি করে কোচ সরবরাহ দেয়া হচ্ছে।
রেলের প্রকৌশল বিভাগের তথ্যমতে, সৈয়দপুর কারখানায় লোকবলের মঞ্জুরিকৃত পদ ২ হাজার ৯০০। এর মধ্যে মাত্র ৭৩২ জন দিয়ে কোন রকমে কাজ চালাচ্ছে প্রকৌশল বিভাগ। অপর দিকে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী কারখানায় লোকবলের মঞ্জুরিকৃত পদের সংখ্যা ২ হাজার ২২৫ জন হলেও কর্মরত রয়েছে ৯৮০ জন। প্রতি মাসে গড়ে ৩৫টি করে কোচ মেরামত করলেও ঈদকে সামনে রেখে দুটি কারখানাই চলতি এপ্রিল মাসে ৫০টি করে কোচ মেরামতের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে। এরই মধ্যে পশ্চিমাঞ্চলে ৩৫টি ও পূর্বাঞ্চলে ৩৫টি কোচ চলমান ট্রেনগুলোতে পাঠিয়ে দিয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। ফলে ঈদের বিশেষ ট্রেন ও যাত্রীবাহী ট্রেনগুলোতে মাত্র ১৫টি করে বাড়তি কোচ সংযোজন করতে পারবে রেলওয়ে। এতে ঈদের বাড়তি চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হবে বাণিজ্যিক বিভাগকে।
ওয়ার্কশপ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পশ্চিমাঞ্চলের সৈয়দপুর কারখানার জন্য ঈদের বাড়তি কোচ মেরামতের জন্য ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার বাজেট রাখা হয়েছিল। কিন্তু বরাদ্দ পাওয়া গেছে মাত্র ৩৪ লাখ টাকা। এছাড়া পাহাড়তলী কারখানায় বার্ষিক হিসাবে ৪০ কোটি টাকার বাজেট থাকলেও বরাদ্দ পাওয়া গেছে মাত্র ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বাজেট ঘাটতির কারণে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ ও দৈনিক ভিত্তিতে বাড়তি লোকবল নিয়োগ দিতে পারেনি কারখানা কর্তৃপক্ষ। এ কারণে প্রতিবছর গড়ে ১০০টির বেশি কোচ সংযোজনের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এবছর মাত্র ৫০টিতে সীমিত ছিল রেলের ঈদ উপলক্ষ্যে বাড়তি কোচ সংযোজনের পরিকল্পনা।
কারখানার জন্য বাজেট বরাদ্দ স্বল্পতার বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অর্থ) মো. আনিছুর রহমান বলেন, 'রেলের প্রতিটি কাজের বাজেট বরাদ্দ হয় অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে। রেলের কোন কোন বিভাগ কতটুকু বরাদ্দ পেয়েছে এবং না পেয়ে থাকলে কিভাবে কাজ করছে তা নির্ভর করে ওই ডিপার্টমেন্টের চাহিদার উপর। আইবাস++ সফটওয়্যার সহ বিভিন্ন কারণে এবার বরাদ্দের ক্ষেত্রে রেলের কোন ভূমিকা নেই। যার কারণে বরাদ্দ কম পেলেও কিছুই করার নেই।'
পরিবহন বিভাগের তথ্যমতে, পশ্চিমাঞ্চলে ঈদের আগে ৬টি আন্তঃনগর ট্রেনে একটি করে নতুন কোচ সংযোজন করা হবে। এছাড়া বাকি ট্রেনগুলো স্ট্যান্ডার্ড কম্পোজিশন অনুযায়ী যাত্রী পরিবহন করবে। তবে পশ্চিমাঞ্চলে ঈদ উপলক্ষ্যে খুলনা-ঢাকা রুটে এক জোড়া ট্রেন যাত্রী পরিবহনের সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে পূর্বাঞ্চল রেলে ঈদের যাত্রীদের চাহিদা বিবেচনায় ৫ জোড়া ট্রেন যাত্রী পরিবহনের পরিকল্পনা রয়েছে। ট্রেনগুলো হলো-চট্টগ্রাম-চাঁদপুর-চট্টগ্রাম রুটে দুই জোড়া, ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ-ঢাকা রুটে এক জোড়া, ভৈরববাজার-কিশোরগঞ্জ-ভৈরববাজার রুটে এক জোড়া এবং ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ রুটে এক জোড়া। মূলত যাত্রী চাহিদা বেশি থাকায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়গামী বেশ কয়েকটি শাটল ট্রেন ও মেইল-এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রা বাতিল করে প্রতিবারের মতো পূর্বাঞ্চলে বিশেষ ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে রেলওয়ে পরিবহন বিভাগ।
বাংলাদেশ রেলওয়েতে ঈদ উপলক্ষ্যে সবচেয়ে বেশি যাত্রী হয় ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে। রাজধানী ঢাকার সাথে দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর নগরীতে যাত্রীদের যাতায়াত থাকায় ঈদের সময়েও টিকিটের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। অথচ এই রুটের মাত্র ৪ জোড়া ট্রেনে ঈদ উপলক্ষ্যে প্রতিটিতে দুটি করে অতিরিক্ত কোচ সংযোজন করা হবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে অতিরিক্ত কোচ সংযোজন করা হবে যথাক্রমে সুবর্ণ এক্সপ্রেস (৭০১/৭০২), মহানগর গোধুলী-তূর্ণা এক্সপ্রেস (৭০৩/৭৪২), তূর্ণা-মহানগর প্রভাতী (৭৪১/৭০৪) এবং উভয়মুখী সোনারবাংলা এক্সপ্রেস (৭৮৭/৭৮৮) ট্রেনে। এই ট্রেনগুলোতে সম্ভাব্য আসন বৃদ্ধি পাবে সুবর্ণ এক্সপ্রেসে ১১৫টি, মহানগর গোধুলী-তূর্ণা এক্সপ্রেসে ৮৮/৭৩টি, তূর্ণা-মহানগর প্রভাতী ট্রেনে ৮৮/৭৩টি এবং সোনার বাংলা এক্সপ্রেসে ১১৫টি। যা দেশের সবচেয়ে যাত্রীঘন রুটির টিকিটের চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল।
ঢাকা-চট্টগ্রাম রুট ছাড়াও ঢাকা-সিলেট রুটের জয়ন্তীকা এক্সপ্রেসে একটি, ঢাকা-মোহনগঞ্জ রুটের হাওর এক্সপ্রেসে একটি, ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ রুটের তিস্তা এক্সপ্রেসে দুটি, ঢাকা-কিশোরগঞ্জ রুটের এগার সিন্ধুর প্রভাতী-এগার সিন্ধুর গোধুলী এক্সপ্রেসে দুটি, এগারসিন্ধুর গোধুলী-এগার সিন্ধুর প্রভাতী এক্সপ্রেসে দুটি, ঢাকা-তারাকান্দি রুটের অগ্নিবীণা এক্সপ্রেসে দুটি, যমুনা এক্সপ্রেসে দুটি, চট্টগ্রাম-চাঁদপুর রুটে মেঘনা এক্সপ্রেসে দুটি, চট্টগ্রাম-সিলেট রুটের উদয়ন-পাহাড়িকা এক্সপ্রেসে দুটি, পাহাড়িকা-উদয়ন এক্সপ্রেসে দুটি, ঢাকা-কিশোরগঞ্জ রুটের কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেসে একটি, চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহ রুটের বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনে একটি, ঢাকা-মোহনগঞ্জ রুটের মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে একটি এবং চট্টগ্রাম-ঢাকা রুটের চট্টলা এক্সপ্রেসে তিনটি অতিরিক্ত কোচ সংযোজন করা হবে।