এক স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তে বারবার ধর্মঘটে রেলওয়ের রানিং স্টাফরা
রেলওয়ে রানিং স্টাফরা তিন বছর ধরে যেসব দাবি জানিয়ে আসছিলেন, সরকার সেগুলো পূরণে সম্মত হওয়ায় ধর্মঘট প্রত্যাহারের পর বুধবার (২৯ জানুয়ারি) সারা দেশে পুনরায় ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে।
রেলওয়ের শীর্ষ ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্তের পর ব্যয় নিয়ন্ত্রণের অজুহাতে ২০২২ সাল থেকে লোকোমাস্টার ও গার্ডসহ রেলওয়ের রানিং স্টাফদের ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
রানিং স্টাফরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত স্বেচ্ছাচারী ছিল, কারণ তারা বহু বছর ধরেই আইনত এই ভাতা পাওয়ার যোগ্য ছিলেন।
হঠাৎ ভাতা বন্ধ করে দেওয়ায় রেলওয়ের মাঠ পর্যায়ের রানিং কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়। তারা বেশ কয়েকবার কর্মবিরতিতে যান। তখন উচ্চ পর্যায়ে সভা ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও তা আর বাস্তবায়ন করা হয়নি। সর্বশেষ সোমবার পর্যন্ত তাদের দাবি পূরণ না হওয়ায় মঙ্গলবার ফের তারা ধর্মঘটে যান।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ অবশেষে গতকাল বুধবার ভোরে তাদের দাবি মেনে নেয়, যার ফলে আন্দোলনরত রানিং কর্মীরা গতকাল সকালেই কাজে ফেরেন।
দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি কাজ করলে বেসিকের হিসাবে বাড়তি অর্থ পেতেন রানিং স্টাফরা। একে রেলওয়ের ভাষায় বলা হয় মাইলেজ।
প্রতি ১০০ কিলোমিটার ট্রেন চললে তাতে দায়িত্বপালনরত রানিং স্টাফরা মূল বেতনের এক দিনের বেসিকের সমপরিমাণ টাকা অতিরিক্ত পেতেন। আট ঘণ্টায় এক দিনের কর্মদিবস ধরলে রানিং স্টাফদের প্রতি মাসে কাজ দাঁড়ায় আড়াই বা তিন মাসের সমপরিমাণ।
আর কর্মচারীদের অবসরের পর মূল বেতনের সঙ্গে ৭৫ শতাংশ মাইলেজ যোগ করে পেনশন নির্ধারণের বিধান ছিল। অর্থ মন্ত্রণালয় মাইলেজ সুবিধা পুনর্বহাল করলেও ৭৫ শতাংশ গ্র্যাচুইটি মঞ্জুর করেনি।
রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও কর্মচারী শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক (মহানগর) সাইদুর রহমান বলেন, 'আমাদের যে দাবি ছিল তার একটা অংশ পূরণ হয়েছে, অন্য দাবি এখনও বাকি থেকে গেল। আমাদের যে মাইলেজ সুবিধা ছিল, সেটা দিয়েছে। কিন্তু ৭৫ শতাংশ আনুতোষিক সুবিধা দেওয়া হয়নি।'
রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও কর্মচারী শ্রমিক ইউনিয়নের সংগঠনিক সম্পাদক মো. মহসিন আলী অভিযোগ করেন, '২০২২ সালে রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক, তৎকালীন রেল সচিব ও মন্ত্রী মিলে ব্যয় সংকোচনের নামে রানিং স্টাফদের ভাতা বন্ধ করে দেন, যা মূলত আগের সরকারের সাথে রাজনৈতিক সখ্য গড়ে তোলার কৌশল ছিল।'
রেলওয়ে সূত্র জানায়, বাংলাদেশ রেলওয়ের রানিং কর্মচারীরা দীর্ঘদিন ধরে রেলওয়ের প্রচলিত কোড ও বিধিবিধানের আলোকে রানিং ভাতা, পেনশন ও আনুতোষিক সুবিধা ভোগ করে আসছিলেন।
কিন্তু ২০২১ সালের নভেম্বরে রানিং কর্মচারীদের এসব সুবিধা কিছু ক্ষেত্রে রহিত ও খর্বিত করা হয়, যা ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়। এতে একজন রানিং কর্মচারী চূড়ান্ত অবসরে যাওয়ার সময় তার পেনশন ও আনুতোষিক নির্ধারণের ক্ষেত্রে রানিং ভাতা অন্তর্ভুক্ত করে পেনশন ও আনুতোষিক হিসাব করার সুবিধা হারান।
এর ফলে রেলওয়ে কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। যদিও উচ্চ পর্যায়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সময় তাদের পক্ষে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তবে তা কার্যকর হয়নি।
২০২৩ সালের আগস্টে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে একটি সভা। সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, রেলওয়ে রানিং স্টাফরা যে রানিং অ্যালাউন্স, পেনশন ও আনুতোষিক পাচ্ছিলেন, তা আইন ও বিধি অনুযায়ী বৈধ এবং এ প্রাপ্যতা আগের মতোই বহাল থাকবে।
কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি। ফলে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত রানিং স্টাফরা ১ ডিসেম্বর থেকে ধর্মঘটে যান।
পরে তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পেনশন ও মাইলেজ-সংক্রান্ত দীর্ঘদিনের জটিলতা নিরসন হবে মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে রানিং স্টাফরা তাদের কর্মবিরতি-সংক্রান্ত কার্যক্রম ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত স্থগিত করেছিলেন।
পুনরায় চালু হওয়ার পর সেবা বিলম্বিত
বুধবার ট্রেন চলাচল শুরু হলেও সকালেই শিডিউলে কিছু বিলম্ব দেখা যায়। কামালাপুর রেলস্টেশনের স্টেশন ম্যানেজার আনোয়ার হোসেন টিবিএসকে জানান, সকাল ৬টা ৩০ থেকে ১১টার মধ্যে ১৩টি ট্রেন স্টেশন ছেড়ে গেছে, তবে কিছু ক্ষেত্রে সামান্য বিলম্ব হয়েছে।
তবে সবচেয়ে বেশি দেরি হয় সিলেটগামী পারাবত এক্সপ্রেসের। ট্রেনটি প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টা দেরিতে ছেড়ে যায়।
মঙ্গলবারের ধর্মঘটের ফলে ট্রেনযাত্রীরা মারাত্মক দুর্ভোগের শিকার হন। বাস ও অন্যান্য সড়ক পরিবহন সেবাদাতারা চাহিদা বাড়ার সুযোগ নিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।
এছাড়া ধর্মঘটের ফলে চট্টগ্রাম বন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ রুটগুলোর পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাও মারাত্মক ব্যাহত হয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান মঙ্গলবার দিবাগত রাত ২টা ৪৫ মিনিটে এক সংবাদ সম্মেলনে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। তিনি জানান, রেলওয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের সঙ্গে তার বাসভবনে বৈঠকের পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
মজিবুর রহমান বলেন, 'উপদেষ্টা আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন, আগামীকাল (বুধবার) আমাদের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আমরা জনদুর্ভোগ চাই না। আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। আমরা এখন থেকে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।'