ঘন ঘন সংশোধনে যেভাবে প্রকল্পের খরচ বেড়ে গিয়ে, লাভ চাপা পড়ে যায়
সরকারি সংস্থাগুলোর সক্ষমতার অভাব, দুর্বল পরিকল্পনা ও ত্রুটিপূর্ণ বাস্তবায়নের কারণে বার বার উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সংশোধন করতে হচ্ছে। এতে এসব প্রকল্পের অর্থনৈতিক সুবিধা-বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ।
চলমান প্রকল্পগুলির প্রায় ৩৫ শতাংশ — ১,৮১৯টির মধ্যে ৬৪০টি— গত এক দশকে এক বা একাধিকবার সংশোধনের মধ্য দিয়ে গেছে, যা শেষ পর্যন্ত উন্নয়ন কাজকে ব্যয়বহুল করে তুলেছে।
পরিকল্পনা কমিশনের তথ্যানুসারে, উন্নয়ন প্রকল্পগুলি বারংবার সংশোধনের ফলে দিনে দিনে কতোটা ব্যয়বহুল হচ্ছে তার একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অধীন সংশোধিত প্রকল্পগুলির ব্যয় বেড়ে এখন ১৮ লাখ ৫৩ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা হয়েছে, যা জাতীয় বাজেটের তিনগুণ।
নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় ব্যয় বাড়ে
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, নির্ধারিত ডেডলাইনে শেষ করা গেলে চলমান প্রকল্পগুলোর মোট ব্যয় আরো কম হতো।
ওয়াকিবহাল সূত্রে জানা গেছে, রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রায় ১১টি প্রকল্প সংশোধন করা হয়েছে। প্রকল্পগুলির মূল ব্যয় ৪৩ হাজার ৯১৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে প্রায় ৬৬ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা হয়েছে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ৫৮টি সংশোধিত প্রকল্প রয়েছে, যেগুলোর ব্যয় বেড়েছে ২৪ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা।
স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের ২০টি প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে ১৩ হাজার ৮১ কোটি টাকা।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধীন অন্যান্য অনেক প্রকল্পও মেয়াদ বাড়ানো এবং খরচ বৃদ্ধির সম্মুখীন হয়েছে।
অদক্ষতা একটি বড় কারণ:
সরকারি সংস্থাগুলোর সক্ষমতার অভাবকেই প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি ও ব্যয় বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সরকারি সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বাড়েনি। যেনতেন ভাবে সমীক্ষা করে প্রকল্প নেওয়া হয়। এতে বার বার প্রকল্প সংশোধন করতে হয়।"
অন্যদিকে ব্যয় বাড়ানোর উদ্দেশ্যে- ঠিকাদার ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছা করে প্রকল্প ধীরে বাস্তবায়নে করে। রড সিমেন্টসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়তি থাকলে, অনেক ঠিকাদারই ধীর গতিতে কাজ করে। প্রকল্পের ব্যয় পুনঃমূল্যায়ন হবে, এই আশায় তারা বসে থাকে। আবার অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালক ও সংশ্লিষ্টরা প্রকল্প থেকে সুবিধা পাওয়ার আশায় বাস্তবায়ন দীর্ঘায়িত করে, যোগ করেন তিনি।
অর্থনীতিবিদ ও গবেষক জায়েদ বখত বলেন, "নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা না গেলে, উন্নয়ন কার্যক্রমে অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়। অথচ এই বাড়তি অর্থ অন্য কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা যেত। বাড়তি ব্যয়ের যোগান দিতে গিয়ে অর্থনীতিতেও চাপ তৈরি হচ্ছে।"
অনেক ক্ষেত্রে কোনো প্রকল্পে পরিচালক নিয়োগ দিতেই দীর্ঘসময় চলে যায়। একইভাবে বিদেশি ঋণের প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগে বিলম্বের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ভূমি অধিগ্রহণেও দেরি হয়। সঠিক সমীক্ষা ছাড়া প্রকল্প নেওয়ার কারণে মাঝপথে প্রকল্পের নকশা পরিবর্তন করতে হয় বলেও যোগ করেন জায়েদ বখত।
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার এবং রামু হয়ে গুনদুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১০ সালের জুলাই মাসে। তিন বছরে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণ ও অর্থায়ন জটিলতায় প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি হয়নি। ফলশ্রুতিতে প্রকল্পের মেয়াদ আরো তিন বছর বাড়ানো হয়, সাথে ব্যয়ও ঊর্ধ্বমুখী হয়।
এছাড়া, এ প্রকল্পে একটি ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণে অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে প্রকল্পের ব্যয় ৮৭৪ শতাংশ বাড়ে। এজন্য ২০১৬ সালের এপ্রিলে প্রকল্পটি সংশোধন প্রস্তাব পুনরায় অনুমোদন দেওয়া হয়। এবং ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়। এপর্যন্ত প্রকল্পটির অগ্রগতি ৬৮ শতাংশ। এ অবস্থায় প্রকল্পটির মেয়াদ আবার বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে রেলওয়ের বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের সংখ্যা ৩৯টি, যাতে বর্তমান অনুমোদিত ব্যয় প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে ১১টি প্রকল্প সংশোধন করে মেয়াদ দ্বিগুণ বাড়ানোর পাশাপাশি এসব প্রকল্পে আরো ২২ হাজার ৫৪০ কোটি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের বাস্তবায়নাধীন ১৯৮টি প্রকল্পের ব্যয় এখন ২ লাখ ৮৫ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬৯টি প্রকল্প বিভিন্ন সময়ে সংশোধন করা হয়েছে। সংশোধিত ৫৮ প্রকল্পে ব্যয় বেড়েছে ২৪ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা। তবে সংশোধনের পর ১১ প্রকল্পে ২৯১ কোটি টাকা ব্যয় কমেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক নকশা ও পরিকল্পনার অভাবে সরকারের কোনো বড় সড়ক প্রকল্প এক মেয়াদে শেষ হয়নি।
"বাস্তবায়ন পরিস্থিতি অনুসারে হালনাগাদ করতে প্রকল্প সংশোধনের প্রয়োজন হয়"
জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, "বাস্তবায়ন পর্যায়ের বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণেই প্রকল্পে সংশোধন করা হয়।তবে পরিকল্পনা কমিশন মাঝপথে নতুন কনো অঙ্গ বা আইটেমকে প্রকল্পভুক্ত করাকে নিরুৎসাহিত করে।"
"অনেক সময় পাঁচ বছরের প্রকল্প সংশোধন করে হালনাগাদ করা হয়। সরকারের এক বছর মেয়াদি বাজেটও মাঝপথে সংশোধন করে হালনাগাদ করা হয়। এটি খারাপ কিছু নয়"- যোগ করেন মন্ত্রী।
তিনি আরও বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের একটি সমস্যা হলো ভূমি অধিগ্রহণ। মূল প্রকল্প অনুমোদনের আগে ভূমি অধিগ্রহণ করা যায় না। "অনেক সময় আমরা ভূমি অধিগ্রহণের আলাদা প্রকল্প নিচ্ছি। কিন্তু, সব প্রকল্পের ক্ষেত্রে এটা করা সম্ভব হয় না। কারণ ভূমি অধিগ্রহণের পর যদি মূল প্রকল্প অনুমোদন পাওয়া না যায়, তাহলে সরকারের অপচয় বাড়বে।
"দেরি ইচ্ছেকৃত"
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, "ব্যয় বাড়ানোর উদ্দেশ্যে পরামর্শক ও ঠিকাদার ইচ্ছা করে প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ বিলম্বিত করে। প্রকল্প পরিচালকদের সক্ষমতার অভাবে তারা এ সুযোগ পায়। সরকারের সব সংস্থাতেই দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে।"
দেশে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বার বার সংশোধনের যে চক্রে পড়েছে তার জন্য প্রকল্প গ্রহণের আগে যথাযথ সমীক্ষা না করা এবং জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) এ ধরনের অপরিকল্পিত প্রকল্পে অনুমোদন দেওয়াকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
প্রকল্প অনুমোদন পাওয়ার আশায়, যেনতেনভাবে একটা সমীক্ষা করে সংস্থাগুলো। এতে বাস্তবায়ন পর্যায়ে গিয়ে পড়তে হয় জটিলতায়। তখন ব্যয় বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়, আগের সমীক্ষার আর কোনো মূল্য থাকে না।"
শামসুল হক বলেন, "গত ১০ বছর যে উন্নয়ন হয়েছে, তার মূল্যায়ন করা দরকার। এতে দুর্বলতা ও ব্যর্থতা চিহ্নিত করা যাবে এবং প্রকল্প সংশোধনের কারণে যে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে- তা সঠিকভাবে বের হয়ে আসবে। এটা না করলে, আগামী দশকে আর্থিক ক্ষতি বেড়ে দ্বিগুণ হবে।"
বিল্মবিত প্রকল্পের একঘেয়ে রীতি চলছেই
স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। দুর্নীতির কারণেও প্রকল্পটি আলোচিত। ইতোমধ্যে এ প্রকল্পের ব্যয় ৪০ শতাংশ বেড়েছে।
এক দশকের বেশি সময় ধরে বাস্তবায়ন হচ্ছে গোপালগঞ্জে ইডিসিএল- এর তৃতীয় শাখা কারখানা স্থাপনের প্রকল্প। শুরুতে এই প্রকল্পের ব্যয় মাত্র ৩১ কোটি টাকা হলেও, বর্তমানে এ প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে ৮০০ কোটি টাকা হয়েছে।
এ বিভাগের ৬৬ শতাংশ প্রকল্পই বিভিন্ন কারণে সংশোধন করা হয়েছে। ৩১টি সংশোধিত প্রকল্পের মধ্যে ২০টি প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে ১৩ হাজার ৮১ কোটি টাকা। অন্যদিকে, আটটি প্রকল্পের ব্যয় শুরুতে বেশি ধরা হলেও, পরে সংশোধনে ব্যয় কমানো হয়েছে। এসব প্রকল্পে ব্যয় কমেছে ২ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা। আরও তিনটি সংশোধিত প্রকল্পের ব্যয় বাড়া-কমার তথ্য পাওয়া যায়নি।
বর্তমানে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অধীনে বাস্তবায়নাধীন মোট প্রকল্পের সংখ্যা ৪৭টি, যাতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৩ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা।
বড় মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে সংশোধিত এডিপিতে সবচেয়ে বেশি ২৪৪টি প্রকল্প রয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগের। এসব প্রকল্পের বর্তমান বাস্তবায়ন ব্যয় ২ লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকা। এ বিভাগের ৮১টি প্রকল্প এক বা একাধিকবার সংশোধন করা হয়েছে।
এছাড়া বিদ্যুৎ বিভাগের ৮০ প্রকল্পের মধ্যে ৩৩টি, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ৪৬ প্রকল্পের মধ্যে ২০টি, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ১১৪ প্রকল্পের মধ্যে ৩৮টি, কৃষি মন্ত্রণালয়ের ৯৬ প্রকল্পের মধ্যে ৩৩টি, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের ৭৮ প্রকল্পের মধ্যে ৩৭টি প্রকল্প সংশোধন করা হয়েছে।