যেভাবে শুরু হয়েছিল শত বছরের ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলী খেলা
দুই বছরের অনিশ্চয়তা কাটিয়ে চট্টগ্রা্মে আবারও অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জব্বারের বলী খেলা। সোমবার (২৫ এপ্রিল) বিকেল তিনটা থেকে শুরু হওয়ার কথা শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এই বলী খেলা। ইতোমধ্যে সারাদেশ থেকে শতাধিক বলী এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে তাদের রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করছেন। জব্বারের বলী খেলার ১১৩ তম আসরকে ঘিরে তৈরি হয়েছে বিপুল লোকসমাগম, উত্তেজনা কাজ করছে দর্শণার্থীদের মনে। লালদিঘি মাঠ প্রস্তুত না থাকায় এবার বলী খেলার আয়োজন করা হয়েছে জেলা পরিষদ চত্বরে।
১৯০৯ সালের ২৫ এপ্রিল, বাংলা ১২ বৈশাখ তারিখে চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার চট্টগ্রামের লালদিঘির মাঠে এই বলী খেলার আয়োজন করেন। আবদুল জব্বারের নামানুসারে পরবর্তীতে এটি জব্বারের বলী খেলা নামে পরিচিতি লাভ করে। খেলাধুলার মাধ্যমে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে তিনি এই খেলার সূচনা করেছিলেন। আর সংস্কৃতি যে শুধু বিনোদনের অংশ নয়, লড়াই-সংগ্রামেরও অংশ, একথা সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন।
মূলত সুলতানি আমল থেকে সেনাবাহিনীর প্রয়োজনে কুস্তির চর্চা হতো চট্টগ্রামে। তখন এ অঞ্চলের সেনারা ছিলেন মূলত পদাতিক। তাই কুস্তির মধ্য দিয়ে শারীরিক সামর্থ্য ধরে রাখার প্রয়োজন ছিল তাদের। এরপর মল্ল সম্প্রদায়ের মানুষজন গ্রামে গ্রামে বৈশাখ মাসে বলী খেলার আয়োজন করতেন।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সাংস্কৃতিক কর্মীরা অচিরেই ব্রিটিশ বিরোধী হিসাবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিলেন। সে কারণে তাঁদের কর্মকান্ডের উপরে ব্রিটিশদের সার্বক্ষণিক নজর ছিল। তাই বিকল্প পন্থা হিসাবে খেলাধুলাকে বেছে নিয়েছিলেন তৎকালীন বিপ্লবীরা ও তাঁদের সমর্থকরা।
আবদুল জব্বারের বলী খেলাও খেলাধুলার আড়ালে ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক তৎপরতার অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে। ব্যবসায়ী জব্বার ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের যৌক্তিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাই ব্যতিক্রমধর্মী এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে 'খান বাহাদুর' উপাধিতে ভূষিত করলেও, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
একসময় বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকে স্বনামধন্য বলীরা এ খেলায় অংশগ্রহণ করতেন। এ প্রসঙ্গে চট্টল গবেষক আবদুল হক চৌধুরী 'বন্দর শহর চট্টগ্রাম' বইয়ে লিখেছেন, "চট্টগ্রাম বলীর দেশ। কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী স্থানের উনিশটি গ্রামে মল্ল উপাধিধারী মানুষের বসবাস ছিল। প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী মল্লরা সুঠামদেহী সাহসী পুরুষ এবং তাদের বংশানুক্রমিক পেশা হচ্ছে শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন। এই মল্লবীরেরাই ছিলেন বলী খেলার প্রধান আকর্ষণ ও বলী খেলা আয়োজনের মূল প্রেরণা। চট্টগ্রামের বাইশটি মল্ল পরিবার ইতিহাস প্রসিদ্ধ। আশিয়া গ্রামের আমান শাহ মল্ল, চাতরি গ্রামের চিকন মল্ল, কাতারিয়া গ্রামের চান্দ মল্ল, জিরি গ্রামের ঈদ মল্ল ও নওয়াব মল্ল, পারি গ্রামের হরি মল্ল, পেরলা গ্রামের নানু মল্ল, পটিয়ার হিলাল মল্ল ও গোরাহিত মল্ল, হাইদগাঁওর অলি মল্ল ও মোজাহিদ মল্ল, শোভনদণ্ডীর তোরপাচ মল্ল, কাঞ্চননগরের আদম মল্ল, ঈশ্বরখাইনের গনি মল্ল, সৈয়দপুরের কাসিম মল্ল, পোপাদিয়ার যুগী মল্ল, খিতাপচরের খিতাপ মল্ল, ইমামচরের ইমাম মল্ল, নাইখাইনের বোতাত মল্ল, মাহাতার এয়াছিন মল্ল, হুলাইনের হিম মল্ল, গৈরলার চুয়ান মল্ল।"
বর্তমান বলীদের অবস্থা
আব্দুল জব্বার সওদাগরের ছেলের ঘরের নাতি শওকত আনোয়ার বাদল জানান, ৫০ বছর আগেও বলীরা খেলায় অংশ নিতে মাস দু'য়েক আগে চট্টগ্রামে এসে জড়ো হতেন। তাদের বাড়িতেই বড় একটা বৈঠকখানা ছিল। সেই ঘরেই থাকতেন। সেখানেই তারা খাওয়াদাওয়া করতেন এবং দিনভর নানা শারীরিক কসরত ও অনুশীলন করতেন, প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নিতেন। সত্তরের দশক থেকে সারা দেশের বলীরা জব্বারের বলী খেলায় আসছেন। এমনকি একবার ফ্রান্স থেকে দুজন কুস্তিগীর এখানে অংশগ্রহণ করেছিলেন বলেও জানান বাদল।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বলীদের সেই প্রতাপ ও তাঁদের সামর্থ্য কিছুটা মলিন হয়েছে। তবে এখনো শখের বসে শ-খানেক বলী সারাদেশ থেকে জব্বারের বলী খেলায় আসেন।
জব্বারের বলী খেলার বর্তমান চ্যাম্পিয়ন, চকরিয়ার জীবন বলী বলেন, "আমরা গরীব মানুষ। ওভাবে খাওয়া-দাওয়া করা সম্ভব হয়না। তবে ফাল্গুন মাস থেকে আমরা নিজেরা নিজেরা প্রস্তুতি নেই।" কক্সবাজারের আরেক বলী বান্টু জানান, তাঁর পরিবার ঐতিহাসিকভাবে এই খেলার সঙ্গে জড়িত। দাদা-পরদাদা ও বাবা সবাই বলী ছিলেন। এবারের বলী খেলার জন্য গত তিনমাস ধরে প্রস্তুতি নিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে নিয়মিত দুধ-ডিম ও সবজি খেয়েছেন তিনবেলা।
এদিকে সাহাবুদ্দিনের বলী খেলার বর্তমান চ্যাম্পিয়ন বাদশা বলী বলেন, "মাসখানেক ধরে প্রস্তুতি নিয়েছি। এখানে আমরা যারা এসেছি তারা খেলার মঞ্চে প্রতিপক্ষ হলেও এর বাইরে সবাই ভাই-ভাই। তাই সকলে মিলেমিশে প্রস্তুতি নিয়েছি। আমাদের কোনো ব্যয়ামাগার নেই। এমন কিছু থাকলে ভালো হতো।"
বলীদের শক্তির পরীক্ষা
প্রতিপক্ষকে শারীরিকভাবে আঘাত না করে কিংবা তাকে আহত না করে পুরোপুরি ধরাশায়ী করাই বলী খেলার লড়াইয়ের নিয়ম। তাই এ খেলায় কেবল শারীরিক সামর্থ্যেরই পরীক্ষা হয়। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর আবদুল মালেক ৩০ বছর ধরে বলী খেলার রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বলীর লড়াইয়ের নিয়মকানুন সম্পর্কে জানা গেল তাঁর কাছ থেকে।
তিনি বলেন, এখানে কোনো পয়েন্টের নিয়ম নেই। কুস্তি করতে করতে মাটিতে যার পিঠ যে ঠেসে ধরতে পারবে সে-ই বিজয়ী হবে। সারা দেশের ১০০ জনের বেশি বলী অংশ নেন লড়াইয়ে। শুরুর দিকে চলে বাছাইপর্ব। লটারির মাধ্যমে বলীরা একজন আরেকজনের সাথে লড়াইয়ে অংশ নেন। সেখান থেকে বাছাই করা হয় আটজন বলীকে। তাঁদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় কোয়ার্টার ফাইনালের চারটি, সেমিফাইনালের দুটি ও ফাইনালের একটি খেলা। মাগরিবের নামাজের আগেই শেষ হয়ে যায় জমজমাট এই খেলার আসর।
জব্বারের বলী খেলা আয়োজন কমিটির সভাপতি জওহরলাল হাজারী বলেন, "চট্টগ্রামের বলী খেলাকে আরো প্রসারের চিন্তা করা হচ্ছে। সে রকম সরকারি আশ্বাস রয়েছে। শহরের স্টেডিয়ামের পাশে প্রশিক্ষণের জন্য একটি কেন্দ্রে স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে।"