খোঁড়াখুঁড়ি আর অসহনীয় যানজটে ভোগান্তি তেজগাঁওয়ে
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বিভিন্ন সময়ে ঢাকার যানজটসহ নানা ভোগান্তির জন্য পরিকল্পনা ব্যতীত প্রকল্পভিত্তিক বিভিন্ন সংস্থার উন্নয়নমূলক কাজকে দায়ী করলেও খোদ উত্তর সিটির সমন্বয়হীনতার কারণেই তেজগাঁও এলাকার মানুষের ভোগান্তি কমছে না।
তেজগাঁও শিল্প এলাকার বিভিন্ন রাস্তায় সমন্বয়হীন বিভিন্ন সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ি, রাস্তা ও ফুটপাতের উন্নয়ন কাজ এবং অবৈধ পার্কিং এর কারণে সৃষ্টি হচ্ছে অসহনীয় যানজট, এর সাথে ধুলোয় নাকাল হচ্ছে এলাকাবাসী। তেজগাঁও লিংক রোডের কাজ মার্চ মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনও পড়ে আছে ঢালাইবিহীন অবস্থায়। কালেভদ্রে পানি ছিটানো হলেও ধুলার প্রকোপ থেকে মিলছে না মুক্তি।
উত্তর সিটির কর্পোরেশন বলছে, এ এলাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা খুবই খারাপ থাকায় এবং রাস্তাগুলো অনুন্নত হওয়ায় পুরো এলাকার উন্নয়ন শেষ করতে একটু সময় লাগছে। এছাড়া অবৈধ পার্কিং এর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর পাশাপাশি স্মার্ট পার্কিং ব্যবস্থায় উত্তর সিটি কর্পোরেশন কাজ করছে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, সিটি কর্পোরেশন কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা এবং মনিটরিংয়ের অভাবেই সমস্যা বেশি হচ্ছে। মেয়রের একা দায়িত্ব না নিয়ে কাউন্সিল শক্তিশালীকরণসহ 'কমিউনিটি এনগেজমেন্ট' বাড়ানো দরকার বলে মনে করছেন তারা।
গত সপ্তাহে সকাল ৮টায় রাজধানীর উত্তরা থেকে বাংলামোটর যেতে নিজের ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে রওনা দেন সামিউল হক। রাস্তায় যানজট থাকায় হাতিরঝিল হয়ে তেজগাঁও লিংক রোড দিয়ে, পরে তেজগাঁও শিল্প এলাকা হয়ে বের হবার জন্যে ড্রাইভারকে ভেতর দিয়ে আসতে বলেন তিনি। কিন্তু এ রাস্তায়ও যে দুর্বিষহ যানজট সেটা আঁচ করতে পারেন কিছুদূর এগোনোর পর। তেজগাঁওয়ের রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি আর অবৈধ গাড়ি পার্কিংয়ের কারণে রাস্তা সরু হয়ে যানজট লেগে প্রায় ২ ঘণ্টা লাগে মাত্র ২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে।
সামিউল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এ রাস্তার যে এতো করুণ অবস্থা আগে জানা ছিল না। ভেবেছিলাম লিংক রোড ধরে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাবো কিন্তু এখানেই আমার সময় নষ্ট করেছে। যেখানে ১০ টার মধ্যে পৌঁছানোর কথা ছিল সেখানে দুপুর হয়ে গিয়েছিল পৌঁছাতে। রাস্তার মধ্যে এত পরিমাণ গাড়ি পার্ক করা ছিল যে একটি গাড়ি মুভ করতেও সমস্যা হচ্ছিল।"
শুধু সামিউলই নন, রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার রাস্তাগুলোতে নিয়মিত চলাচলকারীদের রাস্তার খোঁড়াখুঁড়ি এবং অবৈধ পার্কিং এর সমস্যার কথা মাথায় নিয়েই সবাইকে চলাচল করতে হয়। ঢাকার যানজট যেমন বাড়ছে, তেমনি তা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে।
এ এলাকার দীর্ঘদিন ধরে চলা রাস্তার উন্নয়ন কাজের কারণে বাড়ছে যানজট ও জনদুর্ভোগ। ফলে চলাচলে প্রতিবন্ধকতার কারণে এ রাস্তা পাড়ি দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে নগরবাসীকে। ফলে একদিকে যেমন নষ্ট হচ্ছে নগরবাসীর কর্মঘণ্টা, তেমনি পোহাতে হচ্ছে অসহনীয় ভোগান্তি।
রাজধানী ঢাকার পার্কিং নৈরাজ্য কমাতে ২০০৭ সালে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন মহাপরিকল্পনা হাতে নিলেও আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। গত ১৫ বছরেও কার্যকর হয়নি কোনো পরিকল্পনা। বিভিন্ন সময় পার্কিং নৈরাজ্য নিয়ে একাধিক সংস্থা কাজ করার কথা বললেও, সমস্যার জটিলতা কমেনি।
সম্প্রতি তেজগাঁও শিল্প এলাকাসহ এর আশপাশের রাস্তাগুলো সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, এ এলাকা রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলেও প্রায় প্রতিটি রাস্তায়ই হয় খোঁড়াখুঁড়ি কিংবা পুরো রাস্তা জুড়েই চলে উন্নয়ন কাজ। এখানে এখনও গড়ে উঠেনি পরিকল্পিত পার্কিং ব্যবস্থা। এ এলাকায় যেসব সরকারি ও বেসরকারি ভবন রয়েছে সেগুলোর পার্কিং ব্যবস্থা একেবারেই নগণ্য।
তেজগাঁও এলাকার লিংক রোড, লাভ রোড, বেগুনবাড়ি, কুনিপাড়াসহ আশপাশের এলাকার সড়কগুলোর দুপাশে সারিবদ্ধভাবে ট্রাক-পিকআপ, কাভার্ডভ্যান, প্রাইভেটকার পার্কিং করে রাখা হয়। মাঝ দিয়ে একটি করে গাড়ি চলাচল করতে পারে সেই পরিমাণ জায়গা ফাঁকা থাকে। সকালে গাড়ির চাপ বাড়লে লেগে যায় যানজট। বিকেলে অফিস ছুটি হলে আবার যানজট শুরু হয়।
এছাড়া এ এলাকার বিভিন্ন রাস্তায় রয়েছে অবৈধভাগে গড়ে ওঠা অন্তত ৮টি রিকশার গ্যারেজ। এসব গ্যারেজের রিকশাগুলো রাস্তায় কিংবা ফুটপাতেই সারিবদ্ধভাবে রাখা হচ্ছে। প্রতিটি গ্যারেজের কয়েক'শ করে রিকশা অবৈধভাবে রাস্তাতে রাখা হচ্ছে।
ফার্মগেট ও তেজগাঁও এলাকার অন্তত ১০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, জাতীয় নাক-কান-গলা ইনস্টিটিউট ও কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের প্রধান কার্যালয়সহ বহু সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী এবং সাধারণ মানুষ এই সড়ক ব্যবহার করেন যারা প্রতিদিনই সম্মুখীন হচ্ছেন যানজটের।
তেজগাঁও এলাকার সড়ক ব্যবহার করা লোকজনের সাথে কথা হলে তারা জানান, সকালে অফিসগামী গাড়িগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা এ রাস্তায় যানজটে আটকে থাকে। রাস্তার উন্নয়ন কাজ চলমান থাকায় পুরো এলাকা ধুলোয় ভরে যায়। ফুটপাত দিয়ে চলাচলেরও সুযোগ থাকে না। ফুটপাতেও রিকশা তুলে রাখা হয়।
তেজগাঁও লাভ রোড থেকে ফার্মগেটের একটি স্কুলে মেয়েকে নিয়ে নিয়মিত আসা-যাওয়া করেন উর্মিলা ঘোষ। অনেক সময় জ্যামের মধ্যে রিকশা থেকে নেমে হেঁটেও যেতে হয় তার।
তিনি টিবিএসকে বলেন, "এ রাস্তা যতটুকু না চওড়া এর থেকে গাড়ির চাপ বেশি। রাস্তার দুপাশে এমনভাবে গাড়ি পার্কিং করা থাকে মনে হয় এ রাস্তাটি একটি পার্কিং গ্রাউন্ড। পায়ে হেঁটেও শান্তি নেই এ এলাকায়।"
জামিল নামে এক দোকানী বলেন, "সকালে আর বিকালে এ রাস্তায় যানজট বেশি থাকে। এমনও দেখেছি এ রাস্তায় একই স্থানে এক ঘণ্টার উপরেও গাড়িগুলোকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। এ রাস্তার সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে কোনো ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নেই। মাঝে মাঝে অবৈধ পার্কিংয়ের বিরুদ্ধে দেখি অভিযান হয় কিন্তু আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে অভিযান শেষেই।"
আব্দুস সালাম নামের এক প্রাইভেটকার ড্রাইভার টি্বিএসকে বলেন, "এখানে গাড়ি পার্ক করার কোনো ব্যবস্থা নেই তাই রাস্তার মধ্যেই বাধ্য হয়ে পার্কিং করে রাখতে হচ্ছে। পার্কিং ব্যবস্থা থাকলে তো আমরা রাস্তায় গাড়ি রাখতাম না।"
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল-৩ এর নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল বাকী টিবিএসকে বলেন, "রাস্তাগুলোর কাজ শীঘ্রই শেষ হবে, এছাড়া পার্কিংয়ের বিষয়টি সম্পূর্ণ পুলিশের বিষয়। অবৈধ পার্কিংয়ের বিরুদ্ধে তারা ব্যবস্থা নিবে এখানে সিটি কর্পোরেশনের হাত নেই।"
তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) সাহেদ আল মাসুদ টিবিএসকে বলেন, পুরো ঢাকার প্রায় ৭০ ভাগ গাড়ি তেজগাঁও এলাকা অতিক্রম করে তাই এ এলাকায় যানজট বেশি থাকছে। একদিকে সিটি কর্পোরেশনের রাস্তা উন্নয়ন কাজ ও বিভিন্ন সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ির কারণে গাড়ির চাপ বেড়ে গেলে অটো যানজট লেগে যায়।
তিনি আরও বলেন, "যেসব রাস্তায় গাড়ি চলাচল করতে পারে না সেসব রাস্তায় গাড়ি পার্কিং করা থাকে। মেইন রাস্তায় অবৈধ পার্কিং করে রাখলে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেই। অবৈধ স্থানে পার্কিং করলে জরিমানা করি।"
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ সেলিম রেজা টিবিএসকে বলেন, তেজগাঁও এলাকার রাস্তাগুলোর ড্রেনেজ ব্যবস্থা একেবারেই খারাপ ছিল সেগুলো উন্নয়নসহ রাস্তার উন্নয়ন কাজ চলার কারণে সাময়িক সমস্যা হচ্ছে। তবে খুব দ্রুতই রাস্তার কাজ শেষ হলে ভোগান্তি থাকবে না।
সেলিম রেজা বলেন, "আমরা মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করার পরে তারা পানি ছিটাচ্ছে। আর আমাদের ১৪টি গাড়ি নিয়মিত পানি ছিটাচ্ছে দূষণ প্রতিরোধে। এছাড়া ঠিকাদারেদেরও নির্দেশনা দেওয়া আছে পানি ছিটানোর জন্য।"
রাস্তায় ও ফুটপাতে অবৈধ পার্কিং এর বিষয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, "আমরা রাস্তায় অবৈধ পার্কিং এর বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। পরে আবার তারা পার্কিং করছে।"
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, রাজধানীর প্রতিটি সংস্থাই নাগরিকদের সেবা দানের ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন রাস্তার উন্নয়নসহ বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব যাদেরকে দিচ্ছে তারা এক দায়িত্বে অবহেলা করছে আবার সিটি কর্পোরেশনের মনিটরিংও দক্ষ নয়। এ কারণে তেজগাঁওয়ের মতো এলাকায় মানুষের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এজন্য সর্বপ্রথম দায়ী সিটি কর্পোরেশনই।
তিনি আরও বলেন, "সিটি কর্পোরেশন যদি এলাকাভিত্তিক কমিউনিটির লোকজন নিয়ে ঐ এলাকার বিভিন্ন বিষয় মনিটরিং এবং জবাবদিহির জন্য কমিটি করে দেয় তবে সমস্যাগুলো সমাধান সহজ হয়। এজন্য এক সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিল শক্তিশালী করতে হবে সাথে সাথে সিটি কর্পোরেশনকেও আরও দায়িত্ববান হতে হবে।"