রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞায় থমকে আছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ প্রকল্প
ইউক্রেনে আগ্রাসনের জন্য মস্কোর উপর দেওয়া পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ এর উৎক্ষেপণ, জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। একটি রাশিয়ান ফার্মের সহায়তায় এই কাজ চলছিল।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শীঘ্রই শেষ হওয়ার লক্ষণ না থাকায় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের বিষয়ে 'ওয়েট অ্যান্ড সি' অবস্থানে রয়েছে সরকার।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিএল) চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা ২০২৩ সালের শেষের দিকে অর্থাৎপরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের আগে স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি এই পরিকল্পনাতে প্রভাব ফেলছে।"
তিনি জানান, কর্তৃপক্ষ তাদেরকে আপাতত অপেক্ষা করতে এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে বলেছে।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মহাকাশ সংস্থা রোসকসমসের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিএসসিএল এবং গ্লাভকসমস চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্যাটেলাইট তৈরি ও উৎক্ষেপণের জন্য একটি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে।
শাহজাহান মাহমুদ টিবিএসকে বলেন, চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে কোনো অগ্রগতি হয়নি। এছাড়া, বিএসসিএলের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত এ প্রকল্পটির কোনো অগ্রগতি হবে না।
স্যাটেলাইট তৈরি এবং উৎক্ষেপণের জন্য বিশেষ চিপ প্রয়োজন। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে মস্কো চিপ আমদানি করতে পারছে না। পাশাপাশি, মস্কোর সাথে বৈশ্বিক আর্থিক লেনদেনে নানাবিধ বাধা থাকায় সেটি রাশিয়ার মহাকাশ খাতেও প্রভাব ফেলছে।
কক্ষপথে স্যাটেলাইট উৎপাদন ও উৎক্ষেপণ ছাড়াও, রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের চুক্তির মধ্যে রয়েছে পৃথিবী পর্যবেক্ষণের তথ্য, বাণিজ্যিক কক্ষপথ ফ্লাইট এবং পরামর্শের জন্য উন্নয়নশীল স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরি।
মহাকাশ থেকে দেশের বিভিন্ন স্থান পর্যবেক্ষণ করাই হবে স্যাটেলাইটের মূল কাজ।
কর্মকর্তারা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ উপসাগরের একটি বিশাল অংশ পুনরুদ্ধার করেছে। সেই অংশ পর্যবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশের এই স্যাটেলাইটটি প্রয়োজন।
তারা আরও বলেন, এই স্যাটেলাইট বন্যার পূর্বাভাস দিতে এবং কৃষি সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করতে সাহায্য করবে।
বিএসসিএলের তথ্যমতে, দ্বিতীয় স্যাটেলাইটের আনুমানিক ব্যয় ৩ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা।
২০১৮ সালে ইউরোপীয় মহাকাশ নির্মাতা থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করে বাংলাদেশ। স্যাটেলাইটটি তৈরি ও উৎক্ষেপণে দেশের প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
রাশিয়াকে নির্বাচন করা কি সঠিক ছিল?
স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য বাংলাদেশ জার্মানি ভিত্তিক এয়ারবাস ডিফেন্স অ্যান্ড স্পেসসহ ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে বেশ কিছু প্রস্তাব পেয়েছে।
এদিকে, চলতি বছরের জানুয়ারিতেই রাশিয়ার চিপ রপ্তানির উপর নতুন নিষেধাজ্ঞার জন্য প্রস্তুত থাকতে নিজেদের চিপ শিল্পকে সতর্ক করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
২০২১ সালের জুনে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মহাকাশ সংস্থা রোসকসমসের প্রধান দিমিত্রি রোগজিন মস্কোকে জানিয়েছিলেন যে, চিপ আমদানিতে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া বেশ কিছু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে পারেনি।
২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করার পর যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বার্তা সংস্থা তাস রোগজিনকে উদ্ধৃত করে বলেছে, "আমাদের কাছে পর্যাপ্ত রকেট আছে। কিন্তু আমরা সেগুলো মহাকাশে পাঠানোর মতো অবস্থায় নেই।"
কিন্তু, রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্ব নিয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও রাশিয়ান মহাকাশ সংস্থাকে বেছে নিয়েছে বাংলাদেশ।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, সরকার এখন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
মঙ্গলবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্ব শুরু হওয়ার পর আমরা মস্কোকে কিছু প্রশ্ন পাঠিয়েছিলাম যে তারা আমাদের জন্য স্যাটেলাইট তৈরি করতে পারবে কিনা। তারা আমাদের কিছু অনুসন্ধানের উত্তর দিয়েছে। তবে, এখনও কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বাকি তাদের।"
ফেব্রুয়ারিতে চুক্তি স্বাক্ষরের পর মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের জন্য বিকল্প হিসেবে সরকার রাশিয়াকে বেছে নিয়েছে।
"সরকার রাশিয়ান ফেডারেশনের মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এটি ফিক্স করা হয়েছে। রাশিয়া এই ক্ষেত্রে বেশ অভিজ্ঞ এবং দক্ষতাসম্পন্ন," যোগ করেন তিনি।
মন্ত্রী আরও বলেন, "আমি মনে করি যে আমরা এখন যে প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে চাচ্ছি তার জন্য রাশিয়াই সেরা পছন্দ।"
একাধিক নির্মাতার সঙ্গে চুক্তি করা সম্ভব কি না জানতে চাইলে মোস্তাফা জব্বার নেতিবাচক জবাব দেন।
তিনি বলেন, রাশিয়ান ফার্মের সাথে এই ধরনের চুক্তি থাকা অবস্থায় সরকার অন্যদের সাথে একটি দ্বিতীয় মেমোরেন্ডাম অব কো-অপারেশন (এমওসি) স্বাক্ষর করতে পারে না।
শুরুতেই দেরি করে ফেলেছে বাংলাদেশ
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, দ্বিতীয় স্যাটেলাইটটি ২০২৪ সালের আগে মহাকাশ কক্ষপথে উৎক্ষেপণ করার কথা।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে উৎক্ষেপণের ৩০ মাস আগে ফরাসি কোম্পানির সঙ্গে ক্রয় চুক্তি হয়। তবে, সমঝোতা স্মারক সই হয়েছিল এরও আগে।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ এর জন্য বাংলাদেশ যখন রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে, তখন স্যাটেলাইট তৈরি ও উৎক্ষেপণের প্রায় ২০ মাস বাকি ছিল।
অন্যভাবে বলতে গেলে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যদি শুরু নাও হতো তাহলেও প্রকল্পটি জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমা মিস করতো।
মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারও এ বিষয়ে একমত যে, ইতিমধ্যেই প্রকল্পে বিলম্ব হয়েছে। "যদি দুই দেশের মধ্যে সংঘাত না ঘটত, তাহলে আমরা আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কাজ শেষ করতে সক্ষম হতাম," বলেন তিনি।
ওয়ানওয়েব নামক ব্রিটিশ সরকারের আংশিক মালিকানাধীন একটি স্যাটেলাইট ইন্টারনেট কোম্পানি চলতি বছরের মার্চ মাসে রাশিয়ান রকেট ব্যবহার করে একটি আসন্ন স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ বাতিল করেছে। পাশাপাশি, রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল ভবিষ্যতের সব উৎক্ষেপণ স্থগিত করেছে৷
ব্রিটিশ ফার্মটি পরবর্তীতে ইলন মাস্কের স্পেসএক্সের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। চলতি বছরের শেষের দিকে উৎক্ষেপণ পরিষেবা দেওয়ার জন্য করা হয়েছে এই চুক্তি।
মস্কোর উপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পর আরও কিছু দেশ রাশিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
এর প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমা দেশগুলোতে রাশিয়া বিভিন্ন পণ্যের ডেলিভারি বন্ধ করে দেয়।
তবে রাশিয়ার এ ধরণের পদক্ষেপের ফলে মার্কিন এবং ইউরোপীয় সংস্থা যেমন স্পেসএক্স, রকেট ল্যাব ইউএসএ ইনকর্পোরেটেড এবং আরিয়ানস্পেস এসএ-এর ব্যবসার নতুন পথ সৃষ্টি হয়েছে।