বাংলার সমৃদ্ধি’র মালিকানা হারানোর ঝুঁকিতে বাংলাদেশ
আড়াই মাস ধরে ইউক্রেনের অলিভিয়া বন্দরের ডিনিপ্রো-বাগ মোহনায় পরিত্যাক্ত অবস্থায় ভাসছে বাংলাদেশি জাহাজ 'বাংলার সমৃদ্ধি'। এ দীর্ঘ সময়েও জাহাজটি নিয়ে করণীয় ঠিক করতে পারেনি পরিচালক সংস্থা বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)। এমন কি জাহাজটি দেখে রাখার জন্য ওয়াচম্যানও নিয়োগ করা সম্ভব হয়নি।
অর্থ আদায়ের জন্য বীমা কোম্পানির কাছে বীমা দাবি করা হলেও যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে সেই প্রক্রিয়াও ঝুলে আছে। দেশের অভিজ্ঞ মেরিনাররা বলছেন, বিএসসির ভুল পদক্ষেপ এবং দায়িত্ব এড়িয়ে যাবার চেষ্টা 'বাংলার সমৃদ্ধি'র ভবিষ্যৎ আরও বেশি অনিশ্চিত করে তুলছে। এমনকি 'বাংলার সমৃদ্ধি'র মালিকানা হারানোর ঝুঁকিতেও রয়েছে বাংলাদেশ।
দেশের সিনিয়র শিপ ক্যাপ্টেন আবদুল্লাহ আল মাহমুদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমার জানা মতে 'এমভি বাংলার সমৃদ্ধি' দেখভালের দায়িত্বে এই মুহুর্তে কেউ নেই। এ অবস্থায় জাহাজটির মালিকানা হারানো ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ।"
"যখন সাগরে কোনো জাহাজকে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করা হয়; তখন মেরিটাইম রুল অনুযায়ী যে কেউ এটির মালিকানা দাবি করতে পারে। বিএসসি যদি লিগ্যালি টেক কেয়ার করতে না পারে তাহলে অন্য কিছু হয়েও যেতে পারে।"
অন্যদিকে বিএমএমওএ নেতারা বলছেন, বিএসসির ভুল পদক্ষেপের কারণে এ শঙ্কা আরও জোরদার হচ্ছে।
বিএমএমও-র সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসাইন বলেন, "বিএসসি এমভি বাংলার সমৃদ্ধির ক্ষতিপুরণ বাবদ বীমা কোম্পানীর কাছে পুরো টাকা দাবি করেছে।
কিন্তু বীমা কর্তৃপক্ষ জাহাজটি সরেজমিন পরিদর্শন ছাড়া কোনোভাবেই ক্ষতিপুরণ দিতে সম্মত হবেনা, যা এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সম্ভব নয়। এর চাইতে জাহাজের যতটুকু ক্ষতি হয়েছে তা চাইলে বরং সেটি পাওয়া সহজ হতো। একই সঙ্গে স্থানীয় প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়ে জাহাজটি উদ্ধারের চেষ্টা করা যেতো।"
"বাংলাদেশ যেহেতু জাহাজটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে চলে এসেছে, অন্যদিকে যুদ্ধের কারণে দীর্ঘ সময় জাহাজটি পরিত্যাক্ত অবস্থায় থাকবে। এ অবস্থায় খোদ অলিভিয়া পোর্ট জাহাজটি নিজেদের বলে ক্লেইম করে ফেলতে পারে। পোর্টের সে সুযোগটা আছে।"
অন্যদিকে, মেরিটাইম ক্লজে আছে যেহেতু জাহাজটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে, যে প্রথমব্যক্তি জাহাজটি বোট করতে পারবে তিনিই জাহাজের মালিকানা ক্লেইম করতে পারবেন বলে জানান সাখাওয়াত হোসাইন।
মেরিটাইম আইনজীবি হামদুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "পরিত্যক্ত ঘোষণা দুই ধরনের হয়। প্রথমত- দুর্ঘটনা কবলিত জাহাজ ডুবন্ত অবস্থায় পরিত্যক্ত ঘোষণা, অপরটি হলো ভাসমান অবস্থায় পরিত্যক্ত ঘোষণা। যেহেতু বন্দর সীমানায় বাংলার সমৃদ্ধি রয়েছে, সেহেতু অলিভিয়া পোর্ট তাদের পাওনা আদায়ের জন্য জাহাজটির মালিকানা দাবির সম্ভাবনা বেশি। কারণ ইতোমধ্যেই আড়াইমাস অতিক্রম হয়েছে। প্রতিটি দিনের জন্য তারা নুন্যতম ১০ হাজার ইউএস ডলার জরিমানা দাবি করবে।"
তবে বাংলাদেশ মেরিটাইম ল' সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন আবদুল কাদিরের বলেন, "ফাস্ট বোটিং এর যে বিষয়টি বলা হচ্ছে সেটি আগে ঘটতো, কারণ পরিত্যাক্ত ঘোষণার পর জাহাজের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে মালিক পক্ষের জানার কোনো সুযোগ থাকতো না, তাই অন্যরা জাহাজ দখল নিয়ে নিতো। এখন এমনটা করা সম্ভব না।"
"তবে যেহেতু যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই, এ অবস্থায় যদি কোনো পক্ষ জাহাজটিকে টেনে নিয়ে কেটে ফেলে তখন অবশ্য কিছু করার থাকবে না। যেহেতু বাংলাদেশ ইন্সুরেন্স কোম্পানীর কাছে জাহাজটি পরিত্যাক্ত ঘোষণা করেছে, সেহেতু ইন্সুরেন্স কোম্পানীই চিন্তা করবে জাহাজটি উদ্ধার করা যায় কিনা," বলেন তিনি।
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন 'বাংলার সমৃদ্ধি' জাহাজের ক্ষতিপূরণ আদায়ের প্রক্রিয়া শুরু করলেও রকেটের আঘাতে চলাচল অযোগ্য হয়ে পড়া দেড়শ' কোটি টাকা দামের জাহাজটি ইউক্রেনের ওলভিয়া বন্দরে এখনো পরিত্যক্ত অবস্থায় ভাসছে।
এটিকে কবে উদ্ধার করা হবে বা কিভাবে উদ্ধার করা হবে সেই সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো রোডম্যাপ বিএসসির কাছে নেই। এমনকি যুদ্ধকালীন সময়ে জাহাজটি দেখে শুনে রাখার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা ওয়াচম্যানকে দায়িত্বও দিতে পারেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসসির নির্বাহী পরিচালক (বাণিজ্য) ড. পিযুষ দত্ত টিবিএসকে বলেন, "জাহাজটি পরিত্যক্ত ঘোষণার পর থেকে ওই অবস্থায় আছে। যতটুকু সম্ভব হচ্ছে লোকালি দেখে রাখা হচ্ছে। উপসাগরে স্থাপিত মাইন অপসারণ না হলে জাহাজটিকে সরানো যাচ্ছেনা।"
এর আগে নাবিকদের উদ্ধারের পর জাহাজটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে জানিয়ে বিএসসি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছিলেন, "একটি জাহাজ পরিত্যাক্ত ঘোষণা করার জন্য যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় তা সম্পন্ন করেই পরিত্যাক্ত করা হয়েছে। জাহাজটি পরিত্যাক্ত ঘোষণা করলেও যুদ্ধাবস্থায় সেটি দেখাভালের জন্য কোনো ওয়াচম্যান পাওয়া যায় কিনা সেটাও খোঁজ করা হচ্ছে।"
তবে ঘটনার আড়াইমাস পরেও সে ওয়াচম্যানও নিয়োগ করা সম্ভব হয়নি বিএসসির পক্ষে।
২০১৮ সালের শেষ দিকে চীনা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান 'জিয়াংসু নিউ ইয়ানজি শিপ বিল্ডিং' কোম্পানি থেকে দুই কোটি ৬৩ লাখ ডলারে 'এমভি বাংলার সমৃদ্ধি' কার্গো জাহাজটি কিনে নেয় বাংলাদেশ। দুর্ঘটনার আগ পর্যন্ত জাহাজটি ডেনিশ কোম্পানি ডেল্টা করপোরেশনের অধীনে ভাড়ায় পরিচালিত হচ্ছিল।
জাহাজটি গত ২২ ফেব্রুয়ারি ভারতের মুম্বাই থেকে তুরস্ক হয়ে ইউক্রেনের ওলভিয়া বন্দরে যায়। ওলভিয়া থেকে সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল (ক্লে) নিয়ে ২৪ ফেব্রুয়ারি ইতালির রেভেনা বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু তার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। ফলে ২৯ ক্রু নিয়ে ওলভিয়া বন্দরে আটকা পড়ে জাহাজটি। পরে ২ মার্চ রকেট হামলার শিকার হয়। এতে জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হাদিসুর রহমান প্রাণ হারান।
পরদিন ৩ মার্চ জাহাজটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে অন্য ২৮ নাবিককে অক্ষত অবস্থায় নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়। 'এমভি বাংলার সমৃদ্ধি'র জন্য সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের কাছে ২২.৮ মিলিয়ন ডলার বীমা দাবি করেছে সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনাকারী বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) কর্তৃপক্ষ।
বিএসসি'র উপ-মহা ব্যবস্থাপক (চার্টারিং ও পরিকল্পনা) ক্যাপ্টেন মো. মুজিবুর রহমান বলেন, "বাংলার সমৃদ্ধি এখন বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন ও বীমা কোম্পানীর যৌথ মালিকানায় আছে। যুদ্ধ শেষ হলে এ নিয়ে করণীয় ঠিক করা হবে।"
'বাংলার সমৃদ্ধি' উদ্ধারে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছে বিএসসি
রকেট হামলায় ক্ষতিগ্রস্থ বাংলার সমৃদ্ধির ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে জাহাজের ক্যাপ্টেন ওমর ফারুক তুহিন জানান, হামলায় জাহাজের নেভিগেশন সিস্টেম পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। জাহাজের মেইন পাওয়ার জেনারেটরও কাজ করছে না।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ক্যাপ্টেন মো. এনাম চৌধুরী বলেন, "এ জাহাজ নিয়ে আর সমুদ্রপথে বের হওয়া সম্ভব নয়।
কারণ ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটারে এই বিধ্বস্ত জাহাজটিকে চলাচলের অনুমতি দেওয়া হবে না। বিশেষ করে বসফরাস প্রণালী দিয়ে জাহাজ বের করে আনার অনুমতি তুরস্ক দেবে না। কোনো কারণে যদি জাহাজটি ওই চ্যানেলে ডুবে যায় তাহলে পুরো চ্যানেলই বন্ধ হয়ে যাবে। এই জাহাজ ফেরানো যাবে কিনা তা এখনও অনিশ্চিত।"
"বিকল্প হিসেবে যুদ্ধ থামলে জাহাজটি আশেপাশের কোন দেশের কোনো ডকইয়ার্ডে নিয়ে মেরামত করা যায়। তাতে খরচ হতে পারে কম-বেশি ৩০ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে বিএসসিকে প্রস্তাবও দিয়েছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান প্রান্তিক মেরিন," বলেন তিনি।
প্রান্তিক মেরিনের ওয়ার্কসপ এন্ড ওয়ার হাউসের পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "ইউক্রেনে আমাদের নিজস্ব সোর্সকে কাজে লাগিয়ে জাহাজ উদ্ধার করে মরামতের প্রস্তাব দিয়েছিলাম, তবে এ ব্যাপারে বিএসসির কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।"
দেড় মাসেও জমা হয়নি দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট
বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজে দুর্ঘটনা তদন্তে গত ২০ মার্চ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব তোফায়েল ইসলামকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। ২০ মার্চ তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও বিষয়টি জানাজানি হয় ৩০ মার্চ।
সে সময় কমিটিকে ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছিলো। গঠিত কমিটি নির্ধারিত সময় পরেও রিপোর্ট জমা দিতে পারেনি।
কমিটির বাকি সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন বিএসসির ওয়ার্কশপের মহাব্যবস্থাপক আহসান-উল করিম এবং নৌপরিবহন অধিদপ্তরের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার, নৌবাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার, চট্টগ্রাম মেরিন অ্যাকাডেমির চিফ ইঞ্জিনিয়ার, বুয়েটের নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপক।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব তোফায়েল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "আমরা তদন্ত রিপোর্টর কাজ প্রায় শেষ করে এনেছি। আগামী সপ্তাহেই তা নৌ-মন্ত্রণালয়ে জমা করা হবে। তবে সে রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে কিনা সে সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয় ও বিএসসি নেবে।"
অপরদিকে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন দাবি করেছে, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) জাহাজ পরিচালনায় গাফিলতির খেসারত হিসেবে 'এমভি বাংলার সমৃদ্ধি' গোলার আঘাতের বিধ্বস্ত হয়েছে। জীবন দিতে হয়েছে থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হাদিসুর রহমানকে।
জয়েন্ট ওয়ার কমিটি জায়গাটি 'যুদ্ধাঞ্চল' ঘোষণার পরও ওই বন্দরে জাহাজ ছিল পাঠানো শিপিং করপোরেশনেরই ভুল। সংগঠনটির 'বাংলার সমৃদ্ধি'র বর্তমান অবস্থা ও তদন্তে গঠিত রিপোর্ট নিয়ে জাতিকে অন্ধকারে রেখেছে।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসাইন বলেন, "মার্চ মাসে তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও প্রথম দিকে বিষয়টি গোপন রাখা হয়, জানাজানির প্রায় দুইমাস অতিক্রান্ত হলেও নৌ-মন্ত্রণালয় বা বিএসসি থেকে বিষয়টি নিয়ে কিছু জানানো হচ্ছে না।"