গম দিয়ে সাহায্য করতে চায় দিল্লি
রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন তার ভূকম্পন ৪,০০০ কিলোমিটার দূরের বাংলাদেশেও অনুভূত হতে শুরু করে।
উভয় দেশই অন্যান্য পণ্যের পাশাপাশি গম আমদানির প্রধান দুটি উৎস। তাদের থেকে সরবরাহে ব্যাহত হওয়ার ফলে দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশে প্রধান খাদ্যশস্যের দাম লাফিয়ে বাড়তে থাকে। ফলে রুটি, পাউরুটি, বিস্কুট থেকে শুরু করে নিত্যখাদ্য হয়ে ওঠে আরও দামি।
এ সংকটের সমাধান, যা বাংলাদেশের অনেক সাফল্যকে হুমকির মুখে ফেলেছিল, অবশেষে দৃশ্যমান হতে পারে।
ভারত থেকে গম রপ্তানি করতে দেওয়ার বিষয়ে অনুরোধ করেছিল বাংলাদেশ। তার প্রতিক্রিয়ায়, এই মুহূর্তে সরকার-থেকে-সরকার (জিটুজি) ও বেসরকারিভাবে বাংলাদেশের কী পরিমাণ গম আমদানির চাহিদা রয়েছে জানতে চেয়েছে প্রতিবেশী দেশটি।
ভারতের এই প্রতিক্রিয়া স্থানীয় আমদানিকারকদের মধ্যেও আশার সঞ্চার করেছে। এরমধ্যেই তারা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং থেকে আমদানির পারমিট নিতে শুরু করেছেন।
উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের অতিরিক্ত উপপরিচালক ফারহানা হক (আমদানি) টিবিএসকে বলেন, ভারত থেকে গম রপ্তানি বন্ধের পরও প্রতিদিনই ব্যবসায়ীরা আমদানির অনুমতি নিয়ে রাখছেন। যেকোনো মুহুর্তে রপ্তানির সুযোগ পেলে যাতে করে তারা দ্রুত এলসি খুলতে পারেন।
আমদানিকারকরা বলছেন, ভারত থেকে আবার গম রপ্তানি শুরু হলে দেশে আটা, রুটি ও বিস্কুটের বাজার স্থিতিশীল হবে।
মেঘনা গ্রুপের অ্যাসিসট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার মো. তসলিম শাহরিয়ার টিবিএসকে বলেন, ভারত থেকে গম আমদানি হলে সংকট এড়ানো যাবে। একইসঙ্গে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার তুলনায় দামও কম পড়বে।
যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। বাংলাদেশের বাজারে প্রতি কুইন্টালের দামও ৯০০ টাকা থেকে বেড়ে ১,৬০০ টাকা হয়েছে।
এসময় গম আমদানির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস- প্রতিবেশী ভারতের দিকে ঝোঁকে বাংলাদেশে। তবে গত ১৩ মে দেশটির দেওয়া রপ্তানি নিষেধাজ্ঞায় সেই দুয়ারও প্রায় বন্ধের উপক্রম হয়েছিল।
সংকট নিরসনে কানাডা থেকে কিছু গম আমদানি করা হলেও, তার দাম ছিল অনেক বেশি; অর্থাৎ নিত্যখাদ্যমূল্য কমাতে সেটি তেমন ভূমিকা রাখতে পারেনি।
এই বাস্তবতায়, আনুষ্ঠানিকভাবে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা শিথিলের অনুরোধ নিয়ে ভারতের দ্বারস্থ হয় বাংলাদেশ সরকার।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠির প্রেক্ষিতে, নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান গত ১৮ মে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এক নোট ভারবালে জিটুজি পদ্ধতিতে 'যতো দ্রুত সম্ভব' বাংলাদেশে কমপক্ষে ৬ লাখ টন গম রপ্তানির অনুরোধ জানান।
হাইকমিশনকে ফিরতি চিঠিতে বাংলাদেশের এই মুহূর্তে গমের চাহিদা কতো এবং এর কী পরিমাণ সরকারিভাবে (জিটুজি) এবং কি পরিমাণ বেসরকারিভাবে আমদানি প্রয়োজন, সে তথ্য জানতে চেয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এছাড়া, ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে সাম্প্রতিক এক বৈঠকেও বাংলাদেশে গম রপ্তানির অনুরোধ জানান বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। বৈঠকে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিস্তারিত তথ্য পাওয়ার পর যত কম সময়ের মধ্যে সম্ভব এ সমস্যার সমাধানে তার পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
ভারতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারি (রাজনৈতিক) আফজাল মেহদাত আদনান- বাংলাদেশ ভারত থেকে যে ৬-৭ লাখ টন গম আমদানি করতে চায়, ইতোমধ্যে তার এলসি খোলা হয়েছে কি-না জানতে চেয়ে গত ২৫ মে বাংলাদেশের খাদ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন।
গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করার আগে বাংলাদেশের খোলা এলসি, আমদানি মূল্য এবং এলসিগুলির তালিকা সম্পর্কেও বিস্তারিত জানতে চেয়েছে ভারত। এছাড়া, সরকার থেকে সরকারি পর্যায়ে (জিটুজি), ব্যবসায়ী থেকে সরকারিভাবে (বিটুজি) এবং ব্যবসায়ী থেকে ব্যবসায়ী (বিটুবি) পর্যায়ে বাংলাদেশকে কী পরিমাণ গম আমদানি করতে হবে তারও তথ্য চেয়েছে দেশটি।
ইতোমধ্যে কী পরিমাণ গম আমদানি করা হয়েছে?
বিশেষ করে, বাংলাদেশের আমদানি করা গম ভারতের কোথাও আটকে আছে কিনা- সেটিসহ ভারত থেকে বাংলাদেশের গম আমদানির সাম্প্রতিক অগ্রগতি সম্পর্কে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য চেয়েছে নয়াদিল্লি।
খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. শাখাওয়াত হোসেন টিবিএসকে বলেন, ইতিমধ্যে ভারত থেকে এক লাখ টন গম আমদানি করা হয়েছে, যা এখন চট্টগ্রাম বন্দরে খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে। সরকারিভাবে আমদানি করা হচ্ছে আরও এক লাখ টন।
গম আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বাশার চৌধুরী বলেন, ভারত গম রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করার পর এ পর্যন্ত প্রায় তিন লাখ টন গম এসেছে। আরও কিছু চালান আমদানির পথে রয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সংগ্রহ ও সরবরাহ অনুবিভাগ) মো. মজিবর রহমান বলেন, "আগামী অর্থবছরের চাহিদা বিবেচনা করে, ভারত থেকে ১২ লাখ টন গম আমদানির পদক্ষেপ নিতে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে হাইকমিশনারকে অনুরোধ করেছি।"
তিনি বলেন, কমিশন জিটুজি ভিত্তিতে এবং দরপত্রের মাধ্যমে কতটা আমদানি করা হবে তা জানতে চেয়েছে। এছাড়া বেসরকারিভাবে কী পরিমাণ গম আমদানি করতে হবে- সে বিষয়েও হাইকমিশনের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে। "বেসরকারি খাতের কী প্রয়োজন তা জানতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছি। তথ্য পাওয়ার পর আমরা হাই কমিশনকে জানাব।"
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, ভারতীয় রপ্তানিকারকদের একটি সংস্থা- ন্যাশনাল ফেডারেশন অভ ফার্মার্স প্রকিউরমেন্ট, প্রসেসিং অ্যান্ড রিটেইলিং কো-অপারেটিভস অভ ইন্ডিয়া লিমিটেড বাংলাদেশে গম রপ্তানি করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
গমের বাজার যেকারণে হুমকির মুখে
তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে বা ১.১৮ লাখ টনে নেমেছে দেশে গমের মজুদ, যা আগের বছরের একই সময়ের মজুদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।
রাশিয়া, ইউক্রেন ও ভারত থেকে রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় এ বছর গম আমদানিও কম হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলি এই ঘাটতি পূরণে এগিয়ে এলেও, তাদের গমের দাম অনেক বেশি।
চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে গম আমদানি হয়েছে ৩৪.৫৮ লাখ টন; যার মধ্যে সরকার আমদানি করেছে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টন এবং বেসরকারি খাত করেছে বাকি ৩০ লাখ ১৩ হাজার টন।
গত অর্থবছরে সরকারিভাবে আমদানি হয় ৪ লাখ ৭৮ হাজার টন এবং বেসরকারি পর্যায়ে আনা হয় ৪৮.৬৪ লাখ টন।
এরমধ্যেই, রুটি, বিস্কুট, নুডুলস-সহ গম থেকে তৈরি সমস্ত প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। পাইকারিতে আটার দাম প্রতি কেজি ৩৬ টাকা থেকে বেড়ে ৪৬ টাকা হয়েছে। রুটি, পরোটা ও হিমায়িত খাবারের দামও বেড়েছে।
চড়া মূল্য অনেক নিম্ন-আয়ের লোককে খাবারের পেছনে খরচ কমাতে বাধ্য করেছে। বাজারের এই অস্থিতিশীলতা অব্যাহত থাকলে- দাম আরও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।