পদ্মা সেতু: কেমন আছেন পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দারা
পদ্মা সেতুর জাজিরা ও মাওয়া প্রান্তে গড়ে তোলা হয়েছে ৭টি পুনর্বাসন কেন্দ্র। আধুনিক আবাসন প্রকল্পের আদলে পদ্মা সেতু নিমার্ণে অবদান রাখা এখানকার মানুষগুলো আছেন সুখে-শান্তিতে। শিক্ষা-চিকিৎসাসহ সব মৌলিক চাহিদার ব্যবস্থা রয়েছে বাসিন্দাদের জন্য। স্বপ্নের এই সেতু বাস্তবায়নের প্রথম চ্যালেঞ্জই ছিল জমি অধিগ্রহণ। সেই চ্যালেঞ্জ পূরণের পর পদ্মা সেতুর কাঠামোই শুধু দৃশ্যমান হয়নি, চলতি মাসেই উদ্বোধন হতে যাচ্ছে স্বপ্ন সেতু।
যাদের জমিতে পদ্মা সেতুর অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে সে মানুষগুলো কোথায় আছেন, তাদের জীবন কেমন চলছে আর তাদের ভবিষ্যতই বা কি? সেসব কথা জানতে জাজিরার পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখেছেন প্রতিবেদক আর শুনেছেন এখানকার বাসিন্দাদের সুখ-দুঃখের কথা পুনর্বাসন কেন্দ্রের মূল গেইট দিয়ে প্রবেশ করলে সবুজে ঘেরা একটি আধুনিক পরিকল্পিত আবাসিক এলাকার দেখা মিলবে। প্রতিটি বাড়ির পাশে ফলদ-বনজ গাছ বেড়ে উঠেছে। ঘন সবুজের মধ্যে প্রশস্ত পিচঢালা সড়কঘেঁষা পাকা, আধাপাকা আর টিনশেড বাড়ি। বসবাসকারীদের জন্য দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ, সাপ্লাই পানি, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, যেন এক আধুনিক নগর।
পদ্মা সেতুর পুনর্বাসন কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছ থেকে জানা যায়, যাদের জমি কিংবা আবাসস্থলে গড়ে উঠেছে দেশের অন্যতম এই মেগা প্রকল্প তাদের জন্য সেতুর জাজিরা ও মাওয়া প্রান্তে ৭টি পুর্নবাসন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। যেখানে ৩০১১টি পরিবারের মাঝে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে আড়াই, পাঁচ ও সাড়ে সাত শতাংশ জমি। বসবাসকারী পরিবারগুলোর সন্তানদের শিক্ষা গ্রহণে বিশাল খেলার মাঠসহ শিক্ষার সব ধরনের সুবিধাসম্বলিত ৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দাদের প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে পাঁচটি স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র চলমান রয়েছে। প্রতিটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে দ্বিতল পদ্মা সেতু পুনর্বাসন জামে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দাদের কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণের সুযোগও আছে। দৈনন্দিন কেনাকাটা ও ব্যবসা পরিচালনা এবং কর্মসংস্থানের জন্য বিশাল মার্কেট শেডও নির্মাণ করা হয়েছে।
এখানকার বাসিন্দা রাশিদা বেগম (৪৫) বলেন, "দ্যাশের একটা বড় কাজের লিগ্যা জমি ছাইড়া দিছি। সরকার আমাগো জমির লিগ্যা টাহাও দিছে আবার থাকোইন্যা ব্যবস্থাও কইরা দিছে। ঢাহার শহরের মতো পানি টিপ দিলেই পারতে থাকে। কারেং আছে। হাসপাতালে গেলে অসুদ বড়ি দেয়। এইহানে অনেক ভালোই আছি।'
কুতুবপুরের জব্বর শিকাদারকান্দি গ্রামের আব্দুল মজিদ হাওলাদারের বাড়ির ২৫ শতাংশ জমি ছাড়াও ২ বিঘা ফসলি জমি অধিগ্রহণে নেয়া হয়েছে। পুনর্বাসন কেন্দ্রে তিনি ৫ শতাংশ জমি পেয়েছেন। ছেলে-মেয়ে নিয়ে সুখে-শান্তিতেই দিন কাটাচ্ছেন। বাড়ির সামনের বাগানে বসে কথা হচ্ছিল তার সাথে। বলেন, ' জমি জমার লিগ্যা সরকার আমাগো টাহা দিতে। ওই টাহার থাইক্যা পোলারে ব্যবসা দিয়া দিছি। মাইয়া বিয়া দিছি। বাকি টাহা ব্যাংকে আছে। যেইহানে সরকার থাকতে দিতে এইডা আরামের জায়গা। সব রাস্তাঘাট পাকা করইরা দিছে। বিশটি হইলে একটুও পানি থাকে না সব ড্রেন দিয়া যায়গা। নামাজ পড়নের লিগ্যা বড় মসজিদ। কবরস্থানও আছে। আমাগো লিগ্যা সরকার সব করই দিছে।'
পূর্ব নাওডোবা পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দা সোহরাব বেপারি বলেন, 'পোলাইনের পড়ালেখার জন্য সুন্দর বিদ্যালয় আছে। যারা কাজ শিখতে চায় তাদের জন্য গাড়ি চালানের ট্রেনিং দিয়া আবার চাকরিও দিয়া দিছে। মেয়েছেলেরা শিলায়ের ( টেইলারিং) কাজ শিখছে। অহন জামা কাপাড় বানাইয়া টাকা কামাই করতে পারে। আমাগো সব দিক দিয়াই সুখে রাখছে।'
নাওডোবা পদ্মা সেতু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক শহীদুল ইসলাম বলেন, 'বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগুলো আধুনিকভাবেই নির্মাণ করা হয়েছে। শিক্ষার সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে আমরা শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে আসছি। প্রতি বছরই প্রাথমিক সমাপনীতে আমাদের বিদ্যালয়ের ভাল অবস্থান রয়েছে। বিদ্যালয়গুলো প্রকল্পের অধীন চলছে। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত মেয়াদ। ইতোমধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক বিদ্যালয়গুলো পরিদর্শন করে গেছেন। বিদ্যালয়গুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন চলে গেলে আমাদের চাকরিও বাঁচবে আর এখানকার শিক্ষার্থীরাও শিক্ষা গ্রহণ থেকে বিরত হবে না।'
পদ্মা সেতু পুনর্বাসন কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী রজব আলী বলেন, '৭টি পুনর্বাসন কেন্দ্রকে আধুনিক সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করেই গড়ে তোলা হয়েছে। যোগাযোগ, শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপদ পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, বাজারসহ সব ধরনের সুবিধা দেয়া হয়েছে ওখানকার বাসিন্দাদের। প্রতিটি পুনর্বাসন কেন্দ্রেই ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছে। ওই কমিটিই ওখানকার সব কিছু দেখভাল করবে।'
তিনি আরও বলেন, 'প্রাথমিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য কেন্দ্র নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারিকরণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করে গেছেন। যতদিন সরকারিকরণ না হবে ততোদিন প্রকল্প থেকেই কার্যক্রম চলমান থাকবে।'