সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান: আয়তনে বাড়ছে ২০০ প্রজাতির পাখির এ আবাসস্থল
চিন্তা করুন তো, মাত্র ১ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে ২০০ প্রজাতির পাখি দেখা যায়, আছে বিরল ও বিপন্ন অনেক প্রজাতিও।
কিংবা, ঢাকা থেকে মাত্র ৩-৫ ঘণ্টার দূরত্বে বনের মধ্যে হাঁটলে এশিয়াটিক বন্য কুকুর, মহাবিপন্ন উল্লুক, গন্ধগোকুল বা এশিয়ান কালো ভাল্লুকের দেখা পেতে পারেন।
কিন্তু, এসব অনেক প্রাণীর বসবাস দেশে সবচেয়ে ছোট উদ্যান, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে।
তবে পরিস্থিতিতে পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। পার্শ্ববর্তী জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে উদ্যানটির আয়তন দ্বিগুণ বাড়ানো হবে।
প্রায় ২৪৩ হেক্টরের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের আয়তন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বনবিভাগ। নতুন করে ৬০০ হেক্টর সংযোজন করে প্রায় ৮৪৩ হেক্টর জাতীয় উদ্যান করতে চায় বনবিভাগ।
এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে প্রকৃতিবিদরা বলেছেন, এই সম্প্রসারণের ফলে বন্যপ্রাণীরা উপকৃত হবে।
ইতোমধ্যেই এ নিয়ে একটি প্রস্তাব জমা দিয়েছে বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সিলেট। প্রস্তাবটি বন অধিদপ্তর থেকে যাচাই বাছাই শেষে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
"বর্তমানে এটি অধিদপ্তর থেকে মন্ত্রণালয়ে আছে। আমরা আশা করছি চলতি মাসে বা আগামী মাসে এর অনুমোদন পেয়ে যাব", বলেন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী।
প্রকৃতির আপন মায়ায় সুনিপুণভাবে বেড়ে ওঠা এই বনটি হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তের গাঁ ঘেঁষে অবস্থিত। মিশ্র চিরসবুজ এই বনটি আঁকাবাঁকা ৭টি পাহাড়ি ছড়া ও উঁচু-নিচু পাহাড়ি টিলায় পরিবেষ্টিত।
বনাঞ্চলটিকে ঘিরে ৯টি চা বাগান রয়েছে। পশ্চিমে সাতছড়ি চা বাগান ও পূর্ব দিকে চাকলাপুঞ্জি চা বাগান অবস্থিত।
বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, সাতছড়িতে প্রায় ২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী রয়েছে। বড় আকারের স্তন্যপায়ীদের মধ্যে রয়েছে লেজবিহীন স্তন্যপায়ী উল্লুক। ইতিমধ্যেই পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া এই মহাবিপন্ন উল্লুকের অন্যতম উপযুক্ত আশ্রয়স্থল সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান।
অন্যান্য স্তন্যপায়ীর মধ্যে রয়েছে বিপন্ন প্রজাতির মায়া হরিণ, কালো কাঠবিড়ালী, খরগোশ, বন্যশুকর, শিয়াল, মেছোবিড়াল, বনবিড়াল, গন্ধগোকুল, সজারু, হলদে-গলা মার্টিন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি অধ্যাপক ও মাংসাশী প্রাণী বিষয়ক গবেষক মুনতাসির আকাশ জানান, এই বন খুবই সমৃদ্ধ একটি বন, এখানে অনেক বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী রয়েছে।
"এই বনের আয়তন বাড়ানোর যে উদ্যোগ বনবিভাগ নিয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়ন হলে বন্যপ্রাণীদের থাকার জায়গা বাড়বে, সেই সাথে এদের সংরক্ষণে সহযোগী হিসেবে কাজ করবে এই উদ্যোগ"।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের তথ্য অনুযায়ী, সাতছড়ি দেশের একমাত্র বন যেখানে এক কিলোমিটারের ভেতর প্রায় ২০০ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা পাখিবিদ ড. ইনাম আল হক বলেন, বনটি বড় করা হলে অবশ্যই পাখিদের জন্য ভাল খবর।
"ব্যক্তিগতভাবে বনটি আমার কাছে খবই প্রিয়। কারণ এখানে এত বৈচিত্র্যপূর্ণ গাছ এবং লতাপাতা আছে সেই সঙ্গে আছে নানা প্রজাতির উদ্ভিদ। যা এই বনকে সমৃদ্ধ করেছে। ছোট একটি বনে দুইশ প্রজাতির পাখি তখনই থাকবে যখন তাদের জন্য আলাদা আলাদা খাবার পাওয়া যাবে। এটা একটা ভালো দিক।"
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সহ-সভাপতি তারেক অণু জানান, 'দেশের মধ্যে পাখিদের জন্য এমন বৈচিত্রপূর্ণ উদ্ভিদ আর বৃক্ষে ভরা বন কোথাও নেই। সুন্দরবনের পর একসঙ্গে এত প্রজাতির পাখির দেখা আর কোথাও মেলে না।'
সরীসৃপ গবেষক শাহারিয়ার সিজার জানান, এই বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া পাহাড়ি ছড়াগুলো অনেকটাই ভরাট হয়ে গেছে।
"ছড়া খনন এবং দখলমুক্ত করা সেই সাথে বনকে আরো সমৃদ্ধ করতে পারলে সরীসৃপ এবং উভচর প্রাণীর উপকারে আসবে।"
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে প্রায় ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১০ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে। এদের মধ্যে সবুজ বোড়া বা পিট ভাইপার, কিং কোবরা, অজগর, মক ভাইপার, খয়ে গোখরা, শঙ্খিনী, লাউডগা, বাদামি গেছো সাপ, তক্ষক, গিরগিটি, চিতি বন আচিল, গুইসাপ, হলুদ পাহাড়ী কচ্ছপসহ রয়েছে নানান সরীসৃপ।
উভচরের মধ্যে চিত্রিত আঁচিল ব্যাঙ, ভেনপু ব্যাঙ, মুরগিডাকা ব্যাঙ সহ রয়েছে ঝিঁঝিঁ ব্যাঙ, সোনা ব্যাঙ, গেছো ব্যাঙ, দুই দাগী বাঁশি ব্যাঙসহ নানা প্রজাতির ব্যাঙ।
প্রায় ১৯০ প্রজাতির রংবেরঙয়ের প্রজাপতির আবাসস্থল এই সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান। বর্ণিল রঙিন ডানা, আকার-আকৃতি, বসার স্থান, খাদ্যাভ্যাস ও উড়ার ধরনে একটি অন্যটির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের বনাঞ্চলটিকে বর্ধিতকরণের যৌক্তিকতা হিসেবে বিভাগীয় বন-কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে বন্যপ্রাণীর নিরাপদ বিচরণের জন্য আবাসস্থল সংরক্ষণের গুরুত্ব অনেক বেশি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ বনাঞ্চলের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্র যথেষ্ট নয়।
"বিভিন্ন ধরনের ফলদ ও বনজ বৃক্ষ অর্থাৎ বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ও খাদ্যোপযোগী বনায়ন সৃষ্টি করে বন্যপ্রাণীর খাদ্য ও আবাসস্থল নিশ্চিতকরণ প্রয়োজন। সেজন্য বনাঞ্চলের আয়তন বর্ধিতকরণ জরুরি।"
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন, এত কম জায়গাতে দীর্ঘদিন বন্যপ্রানী টিকিয়ে রাখা কঠিন, তাই আয়তন বাড়ানো জরুরি।
"এই বনের আশেপাশের অনেক এলাকা বন্যপ্রাণীদের জন্য সমৃদ্ধ সেই সব জায়গাকে সংরক্ষিত বনের আয়তন বাড়ানোর যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তা বন্যপ্রাণীর জন্য উপকারে আসবে।"
"জায়গা বাড়লে প্রাণীদের আবাসস্থল বাড়বে এবং এই জায়গাটা সংরক্ষিত হবে। এতে তাদের প্রজনন ও চলাচলের জন্য নিরাপদ জায়গা বৃদ্ধি পাবে।"
বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, সাতছড়িতে প্রায় ২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী রয়েছে। এছাড়া প্রায় ১৪৯ প্রজাতির পাখি রয়েছে। বিরল প্রজাতির বেশ কিছু পাখির দেখা মিলে এ বনে। আছে প্রায় ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১০ প্রজাতির উভচর প্রাণী। প্রায় ১৯০ প্রজাতির রংবেরঙয়ের প্রজাপতির আবাসস্থল এই সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান।