বাংলাদেশ পেল নতুন ফড়িং
বাংলাদেশের জীব বৈচিত্র্যের প্রাচুর্য বিশাল। রয়েছে বিভিন্ন রঙেরর, বর্ণের, বৈচিত্র্যের হাজারো প্রাণী। যাদের রঙিন বর্ণচ্ছটা ছড়ায় জীবনের হাজারো রং। তাদের এই মোহনীয় রূপে আকৃষ্ট হয় সবাই। তেমনি একটি প্রাণী ফড়িং ও সূচ ফড়িং (Dragonfly and Damselfly), যাদের দেহের বর্ণিল বর্ণচ্ছটায় ছেলে-বুড়ো সবাই আকৃষ্ট হয়।
ওডনাটা (Odonata) গোত্রের অন্তর্গত ফড়িং এবং সূচ ফড়িংদের (Dragonfly and Damselfly) বলা হয় Amphibious, মানে এরা জীবনের প্রাথমিক অংশ জলে এবং দ্বিতীয় অংশ স্থলে কাটায়। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত এদের মোট প্রজাতির সংখ্যা ৬,৩৩৭ এবং বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত ১০২টি (৫৭টি ফড়িং ও ৪৫টি সূচ ফড়িং) সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংখ্যা ১৫০-র বেশি হতে পারে যদি গবেষণার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
বাংলাদেশের ফড়িংরা মূলত ৪টি পরিবারের অন্তর্গত। এর মধ্যে Gomphidae পরিবারে এখন পর্যন্ত ৫টি প্রজাতির উপস্থিতি বাংলাদেশে নিশ্চিত করা হয়েছে (Ictinogomphus rapax, Macrogomphus montanus, Macrogomphus robustus, Megalogomphus smithii and Paragomphus lineatus)। কিন্তু Platygomphus dolabratus নামক ফড়িং, যা কিনা Ghomphidae পরিবারের অন্তর্গত, তার উপস্থিতি বাংলাদেশে থেকে এখনও নিশ্চিত তথ্য-প্রমাণ ও ছবিসহ উপস্থন করা হয়নি এবং স্বাধীনতার পর প্রকাশিত গবেষণাপত্রগুলোতেও কোথাও এর অস্তিত্বর প্রমাণ মেলেনি।
এর আগে হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশসংলগ্ন অঞ্চলগুলোতে এই ফড়িংয়ের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এমনকি ভারত, পাকিস্তান, নেপালের বাইরেও এর উপস্থিতির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এছাড়া এর কোনো ইংরেজি নাম বা সাধারণ নাম কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি এখন পর্যন্ত।
২০২০ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে করোনাকালীন লকডাউন সময়ে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী মিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষকদের আন্তরিক সহযোগিতা ও তত্ত্বাবধানে (অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান, অধ্যাপক ড. এম নিয়ামুল নাসের, মো. মাহাবুব আলম, সানজিদা সুলতানা, এবং মো. ফজলে রাব্বি) নিজ এলাকার জীববৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা শুরু করি। করোনাকালে প্রকৃতিতে প্রাণীদের অবাধ বিচরণের তথ্য সংগ্রহ করতে থাকি। এভাবে আমরা জামালপুর থেকে ২০২০ সালের জুন মাসের ২০ তারিখে সর্বপ্রথম এই ফড়িংয়ের উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হই, একটি ডোবার পাশ থেকে পাওয়া যায় এই ফড়িংকে। শরীরের গঠন, বর্ণ দেখে বুঝতে বাকি থাকে না এটি অন্যরকম কিছু। ফড়িংটি সাবধানে সংগ্রহ করে এর শরীরের বিভিন্ন অংশের ছবি তুলে শিক্ষকদের পাঠানো হয়। এরপর তারা পূর্ণাঙ্গভাবে নিশ্চিত করেন এটি Platygomphus dolabratus নামক ফড়িংয়ের প্রজাতি। ফড়িংটিকে ছবি সংগ্রহের পর নিরাপদে আবার প্রকৃতিতে অবমুক্ত করা হয়।
এরপর ২২ জুন, ২০২০ প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী রিপন চন্দ্র রায় দিনাজপুরের বীরগঞ্জ থেকে একটি ছবি পাঠান, যার সঙ্গে Platygomphus dolabratus নামক ফড়িংয়ের মিল পাওয়া যায়। আমরা ভারতীয় উপমহাদেশের কয়েকজন বিখ্যাত ফড়িং গবেষকের সহায়তা নিই এই প্রজাতির ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ তথ্য জানতে।
মজার ব্যাপার হলো, এই প্রজাতির ফড়িংয়ের সম্পর্কে তথ্য ছিল একেবারেই অপ্রতুল। এর বর্ণনা সম্পর্কে কোথাও সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষকরাও বাইরের বিভিন্ন বই সংগ্রহ করে আমাদের পাঠাতে থাকেন। লকডাউন উঠে যাওয়ার পর বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রাণীর বইয়ের সংগ্রহশালায় যাই আমি ও দীপ্ত বিশ্বাস। Dragonfly South Asia নামক উপমহাদেশের একটি সংস্থা তথ্য সরবরাহে আমাদের সহায়তা করে এবং ১৯ শতকের কিছু বইয়ের তথ্য প্রদান করে। অবশেষে ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত 'The fauna of British India' নামক বইয়ে পাওয়া যায় এই ফড়িংয়ের তথ্য। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার (আইইউসিএন, জিবিআইএফ) তথ্যমতেও বাংলাদেশে ছিল না এই ফড়িংয়ের কোনো রেকর্ডের তথ্য। আর বিশ্বব্যাপী এর বিস্তৃতির তথ্যও সামান্য। ২০২০ সালে প্রকাশিত আমাদের উপমহাদেশের ফড়িংয়ের তালিকায়ও বাংলাদেশে এর অস্তিত্ব থাকার প্রমাণ নেই।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পাকিস্তান ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের একটি তথ্যমতে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একটি রিপোর্টে এই ফড়িংয়ের নাম উল্ল্যেখ করা হয় যা ২০০৮ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রাণী জ্ঞানকোষ-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয় কিন্তু এই ফড়িং এর পূর্ণাঙ্গ তথ্য, বাংলাদেশে এর বিস্তৃতির কোনো তথ্য বা উপস্থিতির পূর্ণাঙ্গ প্রমাণ নেই।
পর্যবেক্ষণকৃত ২টি ফড়িংই ছিলো পুরুষ। হলদে শরীরে কালো ডোরাকাটা দাগ। সবুজ চোখ, হলদেটে মুখ। হলদে পায়ে কালো ছাপ বিদ্যমান। ৫, ৬ ও ৭ নম্বর এবডোমেনাল খণ্ডে হলদে-কালো ডোরাকাটা দাগ যা এই প্রজাতিটিকে একই গণের Platygomphus feae নামক প্রজাতি থেকে পৃথক করেছ।
বাংলাদেশের ফড়িংয়ের তালিকায় উক্ত ফড়িং যোগ করেছে নতুন একটি নাম। সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এ-সংক্রান্ত তথ্য বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র হিসাবে গতকাল (২১ জুন) প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির প্রকাশিত Bangladesh Journal of Zoology নামক জার্নালে।
শীঘ্রই ফড়িংটির একটি বাংলা নাম দেওয়া হবে।
আমাদের প্রতিবেশ ও পরিবেশ রক্ষায় ফড়িংরা রাখছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান; সেইসঙ্গে মশা দমন, ক্ষতিকর পোকামাকড় দমনেও রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ফড়িংয়ের উপস্থিতি পরিবেশের সুস্থতার নির্দেশক, কিন্তু ক্রমাগত দূষণ, জলাশয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হওয়ার করাণে আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের এই ফড়িংদের। গত ৫ বছরে আমার নিজের পর্যবেক্ষণে ঢাকা শহরের ফড়িংদের অনেক বেশি হারে কমে যেতে দেখেছি। এমনি করে আমাদের অজান্তেই হারিয়ে যাচ্ছে সৌন্দর্যের প্রতীক, পরিবেশের বন্ধু ফড়িংরা।
-
আশিকুর রহমান সমী: ওয়াইল্ডলাইফ ইকোলজিস্ট, সিইজিআইএস ও বন্যপ্রাণী বিষয়ে গবেষণারত শিক্ষার্থী, প্রাণীবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।