তৌফিক আহমেদ: বাংলাদেশি র্যাপ গানের পথিকৃৎ
আইন বিষয়ক লেকচারার এবং প্র্যাক্টিশনার হিসেবে যাত্রা শুরু করার অনেক আগেই তৌফিক আহমেদ নিজেকে একজন সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। আর তার কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা, যাদের উদ্দেশ্য র্যাপ গানের মাধ্যমে নিজেদের মেধা ও সৃজনশীলতা তুলে ধরা।
বিলেতের মাটিতে প্রথম যখন পা রেখেছিলেন, তখন তৌফিক আহমেদের হয়তো কোনো ধারণাই ছিল না যে আইন বিষয়ে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি নিতে এসে তিনি বাংলাদেশি র্যাপ গানের পথিকৃৎ হয়ে উঠবেন।
পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব ও নিজের ব্যান্ডের সহযাত্রীদের ছেড়ে দূর দেশে এসে নিঃসঙ্গ অনুভব করতেন তৌফিক। সেই নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে উঠতে এবং নতুন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার সংগ্রামের ফাঁকে র্যাপ গান বানানোর মধ্যে তিনি একটু শান্তি খুঁজতেন।
যদিও সেসময় অধিকাংশ র্যাপারদের নামের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকতো মাদক নেয়া, সমসাময়িক অন্য শিল্পীদের চাইতে বেশি টাকা আয় করা ইত্যাদি বিতর্ক; কিন্তু তৌফিক সেই পথে পা বাড়াননি।
যুক্তরাজ্যে থাকার সময় বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে তার। প্রত্যেকেই নিজের জীবনের আলাদা আলাদা গল্প শুনিয়েছেন। কিন্তু তৌফিক লক্ষ্য করেন যে তাদের প্রত্যেকের গল্পেই একটা পরিচিত দিক আছে; আর তা হলো, তাদের দেশে দরিদ্র মানুষের অধিকারকে দমিয়ে রাখার জন্য অর্থ ও প্রতিপত্তি ব্যবহার করতো শোষকরা।
অনেকগুলো মানুষের জীবনের এই একই মিল যেন তার মধ্যে একটা সুরতান হয়ে জেগে উঠলো।
এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে তার নিজেরও মনে হতে থাকে যে শুধুমাত্র তার গায়ের রঙ ও ধর্মের জন্য তিনি অনেক সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
বিদেশে নিজের বাজে অভিজ্ঞতার জন্য মন খারাপ হয়ে গেলেও, সেই ক্ষোভ তিনি প্রকাশ করলেন 'প্রতিশ্রুতি', 'বিদ্রোহী' ও 'ক্ষ্যাপা গান' এর মতো গানগুলোর মধ্য দিয়ে।
পুরনো সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করলেন তৌফিক, "আয়ার আইনের বইগুলো থেকে যা কিছু মূল্যবোধ আমি শিখছিলাম, এই যেমন 'আইনের চোখে সবাই সমান' এবং 'সবার জন্য ন্যায় নিশ্চিত করতে হবে'; আমি বাস্তব জীবনে সেগুলোর প্রয়োগ দেখতে পাচ্ছিলাম না। আজও যেমন হয়, তখনো তেমনি অন্যায়, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং বৈষম্যই বেশি দেখতে পেতাম।"
প্রবাস জীবনের নানা প্রতিকূলতা দেখে যে তৌফিকের মনে সঙ্গীতের অনুরাগ জেগে উঠেছিল, তা নয়; বরং ৫ বছর বয়সে নিজের ছোট্ট হাতে যখন প্রথম তবলা বাজানো শিখেছিলেন, তখনই গান তার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিল।
তবলা ও ড্রামের মধ্যে দৃশ্যগত যে মিল রয়েছে, তা দেখেই তিনি ড্রাম বাজানো শিখতে মনস্থির করে ফেলেন। ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময় নিজে নিজেই ড্রাম বাজানো শেখেন এবং সময়ের সাথে সাথে গানের প্রতি তার ভালোবাসা আরও গভীর হয়েছে।
তৌফিক বলেন, "সত্যি বলতে কি, একজিন আইনজীবী হওয়ার জন্য পড়ালেখা করা, বিদেশে নিজের খরচ মেটাতে বিভিন্ন চাকরি করা এবং একই সময়ে গানের দিকে মনোযোগ ধরে রাখা আমার জন্য খুব কঠিন ছিল। কিন্তু এই সব হাঙ্গামার মধ্যেও গানই শুধু আমাকে দুদন্ড শান্তি দিতে পারতো।"
কিন্তু তৌফিকের মতো অসম্ভব অনুরাগী একজন ব্যক্তি র্যাপ গানের অগ্রদূত হওয়া সত্ত্বেও, এবং আরও অনেক প্রতিভাবান শিল্পীর উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও; বাংলাদেশে র্যাপ গানের পথচলার গতি এতটাই দূরে সরে গিয়েছে যে এখন অনেকেই মনে করছেন যে, এই ট্র্যাকে ফিরে আসা একটি অসম্ভব কাজ।
তাহলে আমাদের দেশে যখন র্যাপ গান মাত্র সাফল্য ও জনপ্রিয়তার শিখরে উঠতে শুরু করেছিল এবং ভারত ও পাকিস্তানসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে; তখন দেশে র্যাপ গানের এই পতনের কারণ কি?
জবাবে তৌফিক জানালেন কিছু অমীমাংসিত তথ্য, "হিপহপ-ভিত্তিক কোনো ভালো কনসার্ট কখনোই আমাদের দেশে আয়োজন করা হয়না। এর ফলে তরুণ র্যাপারদের প্রতিভায় বাধা আসে এবং আয় কমে যায়। তাই তারা গানের পেছনে লেগে থাকতে উৎসাহ বোধ করেনা।"
এছাড়াও দেশে স্পন্সরের অভাব তো রয়েছেই। দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো অডিও বা ভিডিও র্যাপ গানের পেছনে স্পন্সর করতে চায় না বললেই চলে। অথচ বিশ্বের অন্যান্য দেশে র্যাপ গান অনেক স্পন্সর পায়।
এর পাশাপাশি, রয়্যালটি বা স্বত্ত্ব ভাগ করে নেয়ার ব্যাপারে স্বচ্ছতার ও দায়বদ্ধতা অভাব রয়েছে। ফলে, শিল্পীদের যা পাওনা; তার সিকিভাগ মাত্র তারা পায়।
নিজেকে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে তৌফিক জানান, র্যাপ গানের জগতের নানা বাধা-বিপত্তি ও সমর্থনের অভাব তাকে মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়ে স্থায়ীভাবে একজন লেকচারার ও আইনি প্র্যাক্টিশনারের পেশা বেছে নিতে বাধ্য করেছে।
"দিনশেষে আমাকে জীবন ধারণের জন্য বিকল্প পথ বেছে নিতেই হবে, যে পথে আমি আমার পরিবার ও নিজের জন্য যথেষ্ট টাকা আয় করতে পারবো", ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বললেন তৌফিক।
তিনি আরও বলেন, "আমি মনে করি যে, আমাদের ইন্ডাস্ট্রি এখনো এমন অবস্থানে যেতে পারেনি যেখানে শুধুমাত্র র্যাপ গানের মাধ্যমে একজন মানুষ ভালোভাবে জীবিকা উপার্জন করতে পারবে।"
তবে আরও অনেকের মতো তৌফিকও আগামীতে সুন্দর ভবিষ্যতের প্রত্যাশা করছেন, যেখানে বাংলা র্যাপ গান আবারও তার গৌরব ফিরে পাবে।
বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েব সিরিজ এবং চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে, তাই সেখানে র্যাপ গান বিকাশ হতে পারে বলে আশাবাদী তৌফিক। তিনি বলেন, "আসলে আমি নিজেও আমাদের দেশের কিছু অসাধারণ পরিচালকদেরকে কিছু গান দিয়েছি। আমার বিশ্বাস, শ্রোতারা এই গানগুলো সমাদরে গ্রহণ করবে।"
নিজের ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তৌফিক জানালেন, চলতি বছরের শেষ দিকেই নিজের একক অ্যালবাম বের করার প্রত্যাশা করছেন তিনি।