মনে পড়ে গালি বয় রানাকে?
ক্ষুধার রাজ্যে উঁচু আকাশটা মাটি
পূর্নিমা চাঁদ যেনো ঝলসানো রুটি;
সুকান্ত বুঝেছিলো আমাদের ব্যাথা
লিখেছিলো কবিতায় ক্ষুধাতুরা কথা।
তিন দিন হয়ে গেলো পেট ভরে খাই নাই
মানুষের কাছে কিছু লজ্জায় চাই নাই;
এভাবেই বেঁচে আছি ক্ষুধা নিয়ে পেটে
মাটি কেটে ইট ভেঙ্গে দিন রাত খেটে।
ওপরের গানের লাইনগুলো ঢাকার অলি-গলির বস্তিতে বেড়ে ওঠা এক শিশুর জীবনের গল্প। গালি বয় রানা-৩ পার্টের হিপহপ গান গেয়ে রানা নামের ১০ বছরের শিশুটি নেটিজেনদের কাছে পরিচিতি পায়। কিন্তু তার মতো আরো অনেক পথশিশু রয়ে গেছে সমাজের অন্ধকার আড়ালে। রানার মতো পথশিশুরা ক্ষুধার তাড়নায় অন্যদের কাছে হাত পাতলেও শুনতে হয় গঞ্জনা, খেতে হয় প্রহার।
পথ শিশুদের জীবনের করুণ বাস্তবতাকে রানা নামের ছোট শিশুটি গানের লাইনে প্রকাশ করলে তা মানুষের টনক নাড়িয়ে দেয়। একদল লোক গান শোনার পর রানার দিকে সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু রানার মতো হাজারো পথশিশু যে রাস্তার ধারে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে- তা নিয়ে এই ব্যস্ত নগরীর নাগরিকের ভাবার সময় নেই। আলোচনায় উঠে আসলে বা ভাইরাল হলেই মানুষ কেবল এগিয়ে আসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। কিন্তু যেসব পথ শিশুরা আলোচনার বাইরে রয়ে যায়, তাদের কী হবে! তাইতো রানা নিজের গানের মাধ্যমে তাদের উদ্দেশ্য করে বলেছে-
ভেবে দেখো পৃথিবীতে তুমি কত নিরুপায়
টাকা নাই হাঁটো তাই ফুটপাতে খালি পায়,
জীবনটা থেকে যেন সুখী তুমি গেছো চুরি
বেঁচে আছো কোনো মোতে দিয়ে যেন হামাগুড়ি।
আমি রানা আমার সবটা জানা
আমার মতো আছে হাজার রানা,
এক গান গেয়ে আমি আজ ভাইরাল
বাকি রানাদের বলো কি হবে কাল?
ফুল বিক্রেতা থেকে গালি বয় রানা হয়ে ওঠার গল্প
পথশিশুদের জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা রাস্তার ধারের অলি-গলিতে। আর পাঁচজন শিশুর মতো তাদের শৈশব সুখে-আনন্দে কাটে না। ছোট থেকেই নিজেদের ক্ষুধার যন্ত্রণাকে শান্ত করতে নেমে পড়তে হয় কাজে। কেউ করে ফুল বিক্রি, কেউ আবার দোকান-হোটেলে কাজ করে। 'গালি বয় রানা' নামে পরিচিত হওয়ার আগে রানার জীবনের গল্পটাও ছিলো ঠিক এরকম। ক্ষুধার তাড়নায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘুরে ঘুরে ফুল বিক্রি শুরু করে সে। সেখান থেকেই পরিচয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি সাহিত্যের ছাত্র তবীব মাহমুদের সাথে।
রানার দায়িত্ব নেওয়া তবীব মাহমুদ জানান, 'সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সামনে দিয়ে বাইকে করে যাওয়ার সময় রানা ও মারুফ নামের আরেকটি ছেলে আমার কাছে ছুটে আসে। বাইকে চড়ার আবদার করলে আমি ওদের বাইকে উঠিয়ে ক্যাম্পাস ঘুরাই। তারপর রানাকে নাম, পরিচয়ের এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করি গান গাইতে পারে কিনা। বাইকে বসেই রানা আমাকে গান গেয়ে শোনায়। আমি ছোট থেকেই হিপহপ গান শুনতাম ও লেখালেখি করতাম। ২ ঘণ্টা আমি রানার জীবনের গল্প শুনি। তখন বলিউডের গালি বয় সিনেমার দৃশ্যপট মনে পড়ে যায়। কিন্তু আমার সামনেই রয়েছে বাস্তবের এক গালি বয়'।
'সমাজবিজ্ঞান চত্বরে বসে খেতে খেতে রানার জীবনের ওপর 'গালি বয়' গানটি লিখে ফেলি। এতো বেশি উদ্যম কাজ করছিলো আমার মধ্যে-যে ঐদিনই আমি গানের মিউজিক কম্পোস করি। শুধু তাই নয় গানের রেকর্ডিং টাও ঐদিনই সেড়ে ফেলি। কিন্তু রেকর্ডিং করতে যেয়ে কিছু সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। রানার সে সময় প্রফেশনাল মিউজিক বিট সেন্স ছিলো না। তাই বিটের সাথে মিলিয়ে গান করতে গিয়ে রানা তালগোল পাকিয়ে ফেলছিলো। তখন আমি কাপড় দিয়ে রানার চোখ বেঁধে দেই। যেন ওর সম্পূর্ণ মনোযোগ গানের দিকে থাকে। আমার নির্দেশনা অনুযায়ী বারবার আমি ও রানা গানের লাইনগুলো গাইতে থাকি। ১৫/২০ বার একই লাইন রেকর্ড করতে করতে পুরো গানের রেকর্ডিং দাঁড়িয়ে যায়। এই ছিলো রানা ও আমার একইপথের যাত্রী হওয়ার শুরুটা'।
২০১৯ সালের অক্টোবরে গালি বয় রানা গানটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ঝড় তুলে। সেখান থেকে কামরাঙ্গীচরের পূর্ব রসুলপুর এলাকার ৮ নম্বর গলির রানা সকলের কাছে পরিচিত হয়ে উঠে 'গালি বয় রানা' নামে। সে দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে অল্পবয়সী র্যাপার রানা বলে, 'আমি যখন মানুষের দ্বারে গিয়ে ফুল কেনার জন্য বলতাম, তারা নিতে চাইতো না। গান গাওয়ার পর অনেকেই ছবি তুলতে চাইতো, কেউ কেউ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে চেয়েছে। তবীব ভাই আমার পড়াশোনা, গান শেখানো সবকিছুর দায়িত্ব নিয়েছে।
আজীমপুরের অনুপম স্কুলে ক্লাস থ্রী থেকে এবার ক্লাস ফোরে উঠবে রানা। 'বড় হয়ে ইচ্ছা আছে আমি ডাক্তার হবো, অন্যদের সেবা করবো। পাশাপাশি গান শিখছি তবীব ভাইয়ের সাথে থেকে-এটা চলতে থাকবে। আমাদের ৩ ভাই ও ২ বোনের ইচ্ছা মায়ের জন্য কিছু করা। মা অসুস্থ থাকে-তাই অন্যদের বাড়ি কাজ করতে যেতে পারে না। মায়ের জন্য ভবিষ্যতে আমরা ভাই-বোনেরা মিলে একটা দোকান দিবো যেন বসে থেকে মা কাজ করতে পারে,' বলছিলো সে।
গান যখন হয়ে উঠে প্রতিবাদের নতুন ভাষা
প্রতিদিন চারিদিকে নৈতিক ও মানবাধিকার বিষয়ে চায়ের চুমুকে কতশত আলোচলার ঝড় উঠে। কিন্তু তা মানুষের বিবেকের দরজায় কড়া নাড়ে কতখানি? গানের ভাষায় যখন কোন অন্যায়, অবিচার ও সামাজিক বৈষম্যর কথা উঠে আসে-তা খুব সহজে অন্যকে প্রভাবিত করে। গানের প্রতিবাদী শব্দ যেমন সুক্ষ্ম তীর মানুষের চিন্তার জগতে ছুড়ে দেয়, তেমনি গানের দৃশ্যপটের ছবি মানুষের মনে রেখা টেনে দিতে পারে। এমনটাই হয়েছিল তবীব মাহমুদ ও রানার গাওয়া গানের ক্ষেত্রে।
প্রতিটি গানের ক্ষেত্রে একটি করে বিষয়বস্তুকে নির্ধারণ করে, সেটাকে বাস্তবতার নিরিখে স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তাদের গানে। গলির রানার বাস্তবিক জীবনের দৃশ্য তুলে ধরতে গানের শুট করা হয়েছে বস্তি ও রাস্তার মোড়ে মোড়ে। গানের দৃশ্যে রানা ও তার মতো অন্য পথশিশুদের খালি গায়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। র্যাপের সুরে সুরে তুলে ধরা হয়েছে-পথশিশুদের নিত্যদিন হাত পেতে টাকা চাওয়া ও না খেয়ে দিন কাটিয়ে দেওয়ার করুণ কাহিনী। বুড়িগঙ্গার নোংরা, অস্বাস্থ্যকর পানিতে এই শিশুদের হেসে খেলে বড় হয়ে উঠার মতো দৃশ্যপটও আছে সেখানে। গালি বয় রানা-পার্ট ২ গানটি রিলিজ হওয়ার পর এ পর্যন্ত ১ কোটি ৪০ লাখ ভিউ হয়েছে।
এপর্যন্ত তবীব মাহমুদ প্রায় ২৪/২৫টির র্যাপ গান গেয়েছেন। যার মধ্যে রানার সাথে একত্রে গাওয়া গান রয়েছে বেশ কয়েকটি। ইউটিউবে প্রায় প্রতিটি গানের ভিউ ১০ লাখ থেকে ১ কোটির ওপর। তাদের ২জনের গাওয়া সর্বশেষ গানটি ছিল- 'একটিভ লাইফে, টেনশন নাই'। গানটি চলতি মাসের শুরুতে রিলিজ করা হয়। ইতোমধ্যে ছোট্ট র্যাপার রানা নিজ উদ্যমে নতুন এক গানের জন্য কয়েক লাইন লিখিছে। ধীরে ধীরে গানের সুর, তাল, লয়ের সাথে গান গাওয়ার পাশাপাশি রানা গানও লিখতে চায়। রানার ইচ্ছা বস্তিতে থাকা তার বন্ধুদের পাশে সে দাঁড়াবে।
অন্যদিকে, পথশিশুদের কারিগরি ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার ব্যবস্থা তৈরি করার লক্ষ্যে তবীব মাহমুদ নিজ উদ্যোগে কাজ করে যাচ্ছেন। তার ইচ্ছা গৃহহীন এই শিশুদের কাজে লাগিয়ে তাদেরকে জনশক্তিতে রূপান্তর করা। তবীবের বিশ্বাস অন্য অবহেলিত শিশুদের মধ্যেও রানার মতো প্রতিভা সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে। যথাযথ শিক্ষা ও সুযোগ এই শিশুদের দিতে পারে এক সুন্দর জীবন, দেশকে দিতে পারে দক্ষ জনবল।