পুলিশের চেকপোস্টে আটকে মাথায় আসে ‘মহানগর’
গল্পটা মাথায় এসেছিল আরও ৫-৬ বছর আগে। পরিচালক আশফাক নিপুন তখন ব্যাচেলর। থাকেন মিরপুরের ডিওএইচএসে। দিনের কাজ সেরে প্রায় রাতেই বাসায় ফেরার সময় বেশ কয়েকটা পুলিশের চেকপোস্টের সামনে পড়তে হতো তাকে। নানা ধরনের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে অনুমতি মিলত যাওয়ার।
প্রায় প্রতিদিনই একই ঘটনা, একই মানুষ। তখনই মাথায় গল্পটা আসে নিপুনের। সম্প্রতি ওটিটি প্লাটফর্ম হৈচৈ'য়ে রিলিজ হওয়া ও আলোচিত ওয়েব সিরিজ 'মহানগরে'র গল্প। যেটা বানিয়েছেন আশফাক নিপুন।
নিপুন বলেন, 'চেকপোস্টে নিয়মিত পুলিশের মুখোমুখি হওয়ার পর একদিন আমার মাথায় আসে, থানায় যদি এক রাতের জন্য নানা পেশার মানুষ আটক হয়, তাহলে কী ঘটতে পারে? মানে চেকপোস্ট থেকে যদি আটক করা হয়। গড়পড়তা আমরা সবাই কিন্তু থানায় যাওয়ার ব্যাপারটা ভয় পাই। অবশ্য দিনে থানা নিয়ে একরকম রিঅ্যাকশন হয়, আবার রাতে আরেক রকম। আমার গল্পটা এই সুতোর ওপর দাঁড় করাই। রাতে বিভিন্ন পেশার মানুষ যদি থানায় আটক হয়, তাহলে কী হবে? আইডিয়া আপাতত এতটুকুই।'
সেটা নিয়েই অনেকদিন চুপচাপ বসেছিলেন নিপুন। এরমধ্যে অনেক বিষয় নিয়ে কাজও করেছেন। কিন্তু এটা নিয়ে করা হয়নি। যেমন, এ বছরের শুরুতে হৈ চৈ'য়ে রিলিজ হয় নিপুনের বানানো ওয়েব ফিল্ম 'কষ্টনীড়'। রিলিজের পর হৈ চৈ থেকে আবার নিপুনের সাথে যোগাযোগ করা হয়, দেওয়া হয় সিরিজের প্রস্তাব।
নিপুন বলেন, "আমি কোনোভাবেই গতানুগতিক কোনো সিরিজ বানাতে চাই না। তাই ৫-৬ বছর আগের আইডিয়াটা ঝালাই করি। ভাবনায় আনি, থানার মধ্যে একরাতে যদি বিভিন্ন ধরনের মানুষ হাজির হয় তাহলে কী ঘটে বা ঘটতে পারে। একটু গুছিয়ে নিয়ে পাঠিয়ে দিই হৈ চৈ'তে। সাথে আরও দুটা স্টোরি দিই। কিন্তু আমার কনফিডেন্ট ছিল 'মহানগর' নিয়ে। দু-তিনদিন পরে হৈচৈ থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করে। স্ক্রিপ্ট ডেভেলপ করতে বলেন। আর জানতে চায়, কাস্টিংয়ে কাকে নিতে চান? কিংবা কাকে দেখেন? আমি শুরুতেই ওসি হারুনের চরিত্রের জন্য মোশাররফ করিমকে দেখি। তারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে জানান, তাদেরও এটাই মাথায় এসেছে।"
নিপুন বলেন, 'তখনো মোশাররফ করিম ওটিটিতে কোনো সিরিজ করেননি। তার নামসহ পুরো কাস্টিং পাঠিয়ে দিই। তারা আমার কাস্টিংয়ের সাথে সম্মতি জানান। এটাই সম্ভবত হৈ চৈ বা ওটিটি প্লাটফর্মের বিউটি। তারা কাস্টিংয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা দেন পরিচালকদের।'
মোশাররফ করিম তখন ভারতে। তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন নিপুন। মোশাররফ জানান, দেশে এসে বিস্তারিত আলাপ হবে। দেশে এসে গল্প শুনতে বসেন মোশাররফ করিম। গল্প শুনে শুরুতে রাজি হতে চান না। পরে অবশ্য মজা করেই নিপুনকে বলেন, 'আমি গল্প শোনার ৪-৬ মিনিটের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিই, কাজটা করব। এবং ওসি হারুনের চরিত্রটাই করতে চাই।'
তারপর বাকি আর্টিস্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সবকিছু কনফার্ম করে গত মার্চে শুটিংয়ে চলে যায় 'মহানগর' টিম। কোথায় শুটিং করেছেন, সেটা বলতে চান না। তবে ঢাকার বাইরে। গল্পটা যেহেতু রাতের, তাই নিপুন চেয়েছিলেন সব আর্টিস্ট যেন সবসময় সেটে থাকেন। ঢাকার বাইরে হওয়াতে সেই সুবিধা পেয়েছেন। কোনো আর্টিস্ট সেট থেকে বাসায় ফেরেননি। সারারাত শুটিং করে সেটেই ঘুমিয়েছেন।
নিপুন বলেন, 'একদিকে প্যান্ডেমিক, তার ওপর এটা আবার রাতের গল্প। তাই আমাদের পরিকল্পনা ছিল একদম সন্ধ্যা থেকে শুটিং শুরু করব। তারপর রাতে খাবার খেয়ে আবার শুটিং। ভোর পর্যন্ত শুটিং করে ব্রেকফাস্ট করে সবাই ঘুমাতে যাব। দুপুরে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নেব। তারপর শুটিংয়ের প্রস্তুতি। হয়েছেও তাই। টানা ২০ দিন একটা পুরোনো ভবন সংস্কার করে তারপর শুটিং করতে হয়েছে।'
শুটিং হাউসের পাশেই একটা রেস্টহাউস ছিল, সেখানেই থাকতেন শিল্পীরা। ২০ দিনের নিয়মিত একটা রুটিনে চলে এসেছিলেন সবাই। তবে রুটিনের ব্যতিক্রম ছিলেন পরিচালক আশফাক নিপুন। তিনি আর তার দুজন সহযোগী স্ক্রিপ্টরাইটার ঘুমাতেন মাত্র তিন ঘণ্টা। দ্রুত উঠে প্রতিদিনের স্ক্রিপ্ট প্রতিদিন ডেভেলপ করতেন। পরিকল্পনা করতেন, কীভাবে কী করা হবে সেদিন।
নিপুন বলেন, "আমি আসলে নির্মাণের নির্দিষ্ট কোনো ফরম্যাটে থাকি না। একেবারে রেডি স্ক্রিপ্ট নিয়ে সেটে যাওয়া হয় না আমার। 'মহানগরে'র বেলাতেও তাই হয়েছে। শুটিংয়ের প্রতিদিন স্ক্রিপ্ট লেখা হয়েছে। প্রতিদিন চিন্তা করতে হয়েছে। শিল্পীরাও আমার এই প্রাকটিসের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন।'
তবে কথা শেষ করার আগে জানালেন, মলয় চরিত্রে অভিনয় মোস্তাফিজুর নুর ইমরানকে পাওয়ার ঘটনা। আগে কখনোই তার সঙ্গে কাজ হয়নি নিপুনের। এমনকি দেখাও হয়নি। শুধু 'ইতি তোমার ঢাকা' চলচ্চিত্রে ইমরানের অভিনয় দেখেছিলেন। কিন্তু মলয় চরিত্রের জন্য তাকে লাগবেই। তার ফোন নম্বর জোগাড় করে কল দেওয়া হলো। কিন্তু বন্ধ। বন্ধ তো বন্ধই। তারপর খোঁজ খবর করে জানা গেল, তিনি মুম্বাইয়ে, বঙ্গবন্ধু চলচ্চিত্রের শুটিং করছেন। তার কাছে কোনোভাবে বার্তা পাঠানো হলো। তিনি ফেরার ডেট জানালেন।
ফিরে আসতে আসতে শুটিং শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু ইমরানকে তো জরুরি। তাই নিপুন বাকিদের শুটিং শুরু করলেন। এরমধ্যে ইমরানও চলে এলেন। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা ঢাকার বাইরে সেই শুটিং স্পটে। তখনই নিপুনের সঙ্গে দেখা হয় ইমরানের। চরিত্র বোঝান। তারপর গেটআপ নিয়ে স্ক্রিপ্টটা দেখিয়ে দেন নিপুন। ব্যস, মলয় চরিত্রে ঢুকে যান ইমরান।
'মহানগর' প্রজেক্টের জন্য নিপুন পুরো কৃতিত্ব দেন তার টিমের সদস্যদের। কথা শেষ করতে করতে বলেন, পু'রা টিমটা এত সাপোর্ট দিয়েছে যে, তাদের কারণেই আসলে কাজটা সম্ভব হয়েছে। যদি এটা দর্শকেরা পছন্দ করেন, তাহলে সেই কৃতিত্ব আমার টিমের অভিনয়শিল্পীদের। কারণ সবাই নিজের মনে করে কাজটা করেছেন।'