সায়রা বানুর দিলীপ কুমার
৪৪ বছর বয়সে ২২ বছর বয়সী মুম্বাইর ডাকসাইটে নায়িকাকে বিয়ে করে ৫৫তম বিয়ে বার্ষিকীর দিকে এগিয়ে যাওয়া দিলীপ কুমার ছাড়া আর কারো পক্ষে কি সম্ভব? সেই নায়িকার নাম সায়রা বানু। দিলীপ কুমার ওরফে ইউসুফ খান ৯৮ পেরিয়ে ৭ জুলাই ২০২১ প্রয়াত হলেন। তাকে শ্রদ্ধা জানাতে সায়রা বানুর দিলীপ কুমার প্রকাশিত হলো।
১১ অক্টোবর ১৯৬৬ যখন দুজন বেশ ঘটা করে বিয়ে করেন গুঞ্জন উঠে, দু'বছর টিকে কিনা দেখা যাক। সন্দেহ দু'জনকেই, দিলীপ মধুবালার সাথে এমন প্রাণহরা সম্পর্কটি ভেঙ্গে দিলেন! আর সায়রা তো ইউরোপে পড়াশোনা করা মেয়ে।
বিয়ের বছরই মুক্তি পেয়েছে : ইয়ে জিন্দেগি কিতনি হাসিন হ্যায়, পিয়ার মুহাব্বত এর সাজ আওর আওরাজ; হাতে অনেক ছবি। ওদিকে দিলীপ কুমার মেজাজি মানুষ- দেখা যাক ক'দিন টিকে।
১১ অক্টোবর ২০২০ করোনাকালের প্রথম বছরে তারা উদযাপন করলেন ৫৫ তম বিয়ে বার্ষিকী। ৫৬তমটা আসতে অল্পসময় বাকি ছিল। কুড়ি বছর আগেই নিন্দুকেরাও সুর পাল্টে ফেলেছিলেন- তাজমহল ভেঙ্গে পড়তে পারে, দিলীপ আর সায়রার সংসার ভাঙ্গার নয়।
১১ ডিসেম্বর ২০২০, ৯৮ বছর পূর্ণ করে দিলীপ কুমার ৯৯ তে পা রাখলেন। বছরটা ভালো যায়নি হাসপাতালে আসতে হয়েছে।
সে সময় সায়রার দেওয়া কয়েকটি সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে এবং দিলীপ কুমারের আত্নজীবনী 'দ্য সাবস্ট্যান্স অ্যান্ড দ্য শ্যাডো' থেকে খানিকটা নিয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি ভালোবাসার এপিসোড উপস্থান করা হলো, সায়রার জবানীতেই:
আমার ভাই সুলতান আর আমি তখন ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করছি। আমার মা নাসিম বানু আমাদের ছুটি কাটাতে ইউরোপের অন্যদেশে নিয়ে গেলেন জুলাইতে ছুটি শুরু। প্রতিবারই মা আমাদের ভারতে নিয়ে আসবেনই। তার লক্ষ্য আমরা যেন ভারতীয় মূল্যবোধ থেকে ছিটকে না পড়ি। দিলীপ সাবকে আমি প্রথম লন্ডনে 'আন' সিনেমার পর্দার দেখি। রক্তমাংসের মানুষটিকে প্রথম দেখি মুম্বাই-ও মেহবুব স্টুডিওতে। তার পরনে সাদামাটা সাদা শার্ট সাদা ট্রাউজার, পায়ে সাদা চম্পল। অবাধে নেমে আসা চুল যেমনটা দেখেছি 'দুয়ার' সিনেমায় 'উড়ে জুলফে যাব যাব তেরি' গানের মানুষটির মতো। অভিজাত, ছিমছাম এবং মার্জিত। চারপাশের অন্য সবার চেয়ে ভিন্ন।
এটা ছিল মাদার ইন্ডিয়ার ডিরেক্টর মেহবুব খানের দেওয়া একটি পার্টি। সেখানেই প্রথম দেখা, আমি তাৎক্ষণিকভাবে তার প্রেমে পড়ি। আমি তখন কেবল ১২ বছরের একটি মেয়ে। তিনি চেয়ারে ঝুঁকে বসুন কিংবা দেয়ালে ঠেস দেন, দেখলেই বোঝা যায় তিনি অন্যকিছুতে গড়া, সবার চেয়ে বড় মাপের মানুষ।
'রাম আওর শ্যাম' 'লিডার' এবং 'শাগরিদ' ছবিতে অভিনেত্রী হিসেবে আমাকে নিতে দিলীপ সাব বাধা দিয়েছেন। তাহলে এর পরও সম্পর্কটা হলো কেমন করে? কে প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছে?
বেশ দিলীপ সাব ছিলেন পারিবারিক বন্ধু, আমার বাবা-মাকে তিনি চিনতেন। তাদের বাড়িতে যখন কোনো অনুষ্ঠান হতো আমরা দাওয়াত পেতাম। আমাদের বাড়িতে তারাও পেতেন। সময় গড়িয়ে যায়। আমি আমার ছবি 'জংলি'-তে অভিনয় করি। ছবিটা হিট হয়ে যায়। ইস্টম্যানকালারের এই সিনেমাটিতেই প্রথম বড় পর্দায় সত্যিকারের রঙ উদ্ভাসিত হয়। দিলীপ সাবের বিপরীতে 'রাম আওর শ্যাম' ও 'সংঘর্ষ' ছবিতে নায়িকা হিসেবে আমার নাম উঠে আসে। আমার বাড়িতে এসে তারা আমাকে রোলটা অফার করে; কিন্তু দিলীপ সাব বাধা দিলেন, তিনি চাইলেন না আমাকে রোলটা দেওয়া হোক।
দিলীাপ সাব ভাবলেন, আমি অনেক ছোট। তিনি সব সময়ই সচেতন ছিলেন তিনি আমার তুলনায় একটু বড়। শুধু তাই নয়, তিনি মনে করতেন আমি ঠিক নায়িকা হবার মতোন নই, কারণ আমি লাজুক ও শান্ত। সেই দিনগুলোতে মাহমুদ ও মমতাজ ছিলেন কমেডির হিট জোড়। মমতাজের সিনেমার দৃশ্য তুলে নিয়ে মেহমুদ দিলীপ সাবের কাছে গিয়ে বললেন, মমতাজকে রাম আওর শ্যাম-এ সুযোগ দিতে হবে। এভাবে মমতাজ 'এ' গ্রেড ক্যাটাগারিতে ঢুকলেন এবং বিখ্যাত হলেন। মমতাজ অবশ্যই সুন্দর লম্বা সুগাঠিত কিন্তু আমার বয়সের কাছাকাছি। তিনি তাকেই নিলেন।
আমি তার উপর ভয়ঙ্কর ক্ষিপ্ত হলাম, আমি ভীষণ অবাধ্য এবং উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। এমনকি যে 'লিডার' মুভিতে তিনি নায়ক তাতেও আমাকে পছন্দ করেলেন না। কিন্তু আমার নিয়তি যে ভিন্ন :পালি হিল এলাকায় দিলীপ সাব থাকতেন, আমাদের নতুন বাড়িটা হলো সেখানেই। আমার মা এবং গোটা পরিবার তার ভক্ত এবং তারা ইচ্ছে করেই দিলীপ সাবের বাড়ির কাছাকাছি একটি প্লট বেছে নিলেন। আমাদের একটি হাউস ওয়ার্মিং পার্টি হলো। ১৯৬৬ সালে আমার জন্মদিনে এই পার্টিটার আয়োজন করা হয়েছিল।
সে সময় মুম্বাইতে দিলীপ সাবের কিছু কিছু ব্যক্তিগত সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়েছে, তিনি সাউথে চলে এলেন। আমার মা তাকে দাওয়াত দিলে বললেন, আসতে চেষ্টা করবেন। তারপর ভাবতে পারেন কী হয়েছে! আমি যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম দেখলাম দিলীপ সাব চমৎকার স্যুট আর টাই পরা, তার সুন্দর গাড়ি থেকে নামছেন। তিনি ভেতরে এসে আমার সাথে হাত মেলালেন। তারপর আমি যা শুনলাম তা হচ্ছে 'আপনি দেখছি সুন্দর একটা মেয়ে হয়ে উঠেছেন।'
পরদিন সকালে তিনি ফোন করলেন।
তিনি বললেন, সায়রা বলছো?
কিন্তু তিনি যে আমাকে তার সাথে কাজ করতে নেননি- এটা তো ভুলে যেতে পারি না। আমি তখনও তার উপর বিরক্ত। কিছুটা কর্কশ সুরে তাকে বললাম, কী মনে করে আমাকে ফোন করলেন? আমার মাকে দেব? (তিনি সাধারণত আমার মাকেই ফোন করতেন।)
তিনি বললেন 'না না, আমি আপনাকে শুকরিয়া জানাবার জন্য ফোন করেছি। পার্টিটা চমৎকার হয়েছে এবং আপনাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল।' এভাবেই আমাদের ফোনালাপ শুরু হয়ে যায়।
আমার তখন শ্যুটিং চলছে 'পেয়ার মোহাব্বত' এবং 'ঝুক গ্যায়া আসমান' ছবির আর তিনি শ্যুটিং করছেন মাদ্রাজে (এখন চেন্নাই) 'রাম আওর শ্যাম' এবং 'আদমি' ছবির।
শ্যুটিং শেষে প্যাক আপ করার পর তিনি প্রতিদিন সন্ধ্যার ফ্লাইটে মাদ্রাজ থেকে মুম্বাই ফিরে আসতেন, আমাদের সাথে ডিনার সেরে চলে যেতেন। টানা ৭ দিন এমন করেছেন। চতুর্থ দিনে তিনি বললেন, তিনি সে ধরণের মানুষ নন যে, সরাসরি আমাকে তার সাথে লং-ড্রাইভে যেতে বলবেন। তবে এজন্য তিনি আমার মার অনুমতি নিতে চান। তিনি দু'জনের অনুমতিই নিলেন এবং আমরা আমরা গাড়ি থেকে নেমে হাটতে শুরু করলাম।
অল্পক্ষণের মধ্যে তিনি প্রশ্নটি নিয়ে আবির্ভূত হলেন। 'তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?' এটুকু বলে সায়রা বানু হেসে উঠলেন।
ভাবুন তো আমি তারপর বিদ্রুপের স্বরে জিজ্ঞেস করলাম- 'আপনি ক'জন মেয়েকে এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছেন?'
তিনি হেসে উঠলেন এবং বললেন, 'আমি বুঝতে পারি, আমি তোমার সাথে কাজ করিনি বলে তুমি রেগে আছো- আমি কী করবো- আমার সবসময়ই মনে হয়েছে তুমি অনেক ছোটো।'
আমি তাকে বললাম, বিয়ের মতো বিষয় নিয়ে মুরুব্বিদের সাথেই কথা বলা উচিত। তিনি বললেন এখনই ফিরে গিয়ে তিনি তাদের সাথে কথা বললেন। তখনও আমরা পালি হিলে নতুন বাসায় স্থানান্তরিত হইনি, আমরা থাকছি নাথিয়ান সি রোডে সি-বেল অ্যাপর্টমেন্টসে। তিনি ফিরে এলেন এবং এমনকি আমার দাদিরও ইজাজত প্রার্থনা করলেন।
এমন বিশাল সুপারস্টারকে বিয়ে অন্তত শুরুতেও সমস্যা হয়নি? মোটেও না। আমরা দুজনেই তখন আমাদের ক্যারিয়ারে যথযথ অবস্থানে পৌছে গেছি, দিলীপ সাবের যত ছবি করার কথা তিনি তার চেয়ে অনেক কম ছবি করেছেন। তার সাথে খাপখাওয়াতে সমস্যা হয়নি- কারণ তিনি ভনিতা ধরে থাকতেন না, তিনি ছিলেন বাস্তব জগতের মানুষ।