অনেক বড় গায়ক হতে চেয়েছিলেন 'সাদা সাদা কালা কালা' গানের বিস্মৃত গীতিকার হাশিম
গত কয়েকদিন আগে স্যোশাল মিডিয়ায় রিলিজ হয়েছে মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত 'হাওয়া' সিনেমার গান 'সাদা সাদা কালা কালা'। রিলিজের পর থেকেই তুমুল আলোচনা হচ্ছে গানটি নিয়ে। শেয়ার কমেন্টের পাশাপাশি নেটিজেনরা নিজেরা গেয়েও সেগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন স্যোশাল মিডিয়ায়। গানটি রিলিজের পর থেকেই সবাই খোঁজ করছেন গানটির মূল শিল্পী হাসিম মাহমুদের। গানের লেখা ও সুর তারই করা। তবে শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়ায় গানটি তাকে দিয়ে গাওয়াতে পারেননি পরিচালক। গেয়েছেন অভিনেতা ও গায়ক এরফান মৃধা শিবলু।
গানটি ভাইরাল হওয়ার পর থেকেই সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন হাশিম মাহমুদ। তিনি কোথায় কেমন আছেন জানার আগ্রহ অধিকাংশ মানুষের। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড থেকেও খোঁজ করা হয় তার। তাকে পেতে সহযোগিতা করেন হাওয়া সিনেমার পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন। তিনি জানান, 'চারুকলায় পড়ার সময় থেকেই হাশিম ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। সেটা নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকের ঘটনা। তার গানে বুঁদ হয়ে দিনের অনেকটা সময় কাটিয়েছি আমরা। যখন এই সিনেমার কাজটা শুরু করি, তখনই ঠিক করেছিলাম গানটা সিনেমায় রাখব। কিন্তু হাশিম ভাইকে পাচ্ছিলাম না, তিনি এখন আর চারুকলায় আসেন না। পরে টানা চার মাস খোঁজ নিয়ে জানলাম তিনি অসুস্থ, থাকেন নারায়ণগঞ্জে। গানের অনুমতিও পেলাম, কিন্তু অসুস্থতার কারণে তাঁকে দিয়ে গাওয়ানো হলো না, সেটা হলে আরও ভালো লাগত'।
তার মাধ্যমে যোগাযাগ হাশিম মাহমুদের কাছের মানুষ সালেহ কাজলের সঙ্গে। তিনিসহ গায়ক এরফান মৃধা শিবলুকে নিয়ে গত রবিবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড বের হয় হাশিম মাহমুদের সঙ্গে দেখা করতে।
নারায়নগঞ্জের তল্লা এলাকার এ গলি ও গলি ঘুরে অবশেষে পাওয়া যায় তাকে। পৈতৃকসূত্রে পাওয়া একতলা বাড়ির একপাশে মাকে নিয়ে থাকেন হাশিম মাহমুদ। মায়ের বয়স হয়েছে। তারও বয়স কম নয়। ৫০ ছুঁই ছুঁই। গিয়ে দেখা যায় একা একটি ঘরে বসে আছেন হাশিম মাহমুদ। খাতায় কিছু একটা লিখছেন। গিয়ে পরিচয় ও কুশল বিনিময়ের পর বসতে বলেন। জানতে চাই গানের সেই কালাপাখিটা কে? যাকে বসন্তকালে কিছু বলতে পারেননি?
প্রশ্ন শুনে হাসেন হাশিম মাহমুদ। বলেন, 'আছে একজন। একটা মেয়েকে নিয়েই তো লেখা'।
অবশ্য যাওয়ার আগেই মেজবাউর রহমান সুমন সর্তক করে দিয়েছেন, শারীরিকভাবে একটু অসুস্থ হাশিম মাহমুদ। তাই তাকে খুব বেশি বিরক্ত করা যাবে না।
তার বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা হয় তার মা জমিলা আক্তার শেফালির সঙ্গে। তিনি বলেন, হাশিম এখন সারাদিন বাসাতেই থাকে। আপন মনে গান গায়। খাতায় লেখালেখি করে। কলম খাতা শেষ হয়ে গেলে সেগুলো কিনে দিতে বলে। তার গানটা ভাইরাল হওয়ার পর অনেকেই আসছেন তার সঙ্গে দেখা করতে। ছবি তুলতে। সে মন চাইলে সাড়া দিচ্ছে, না হলে না। তবে ওর যে স্বপ্ন ছিলো সেটা পূরণ হয়েছে'।
কথা হয় হাশিম মাহমুদের বোন দিলারা মাসুদ ময়নার সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা পাঁচ ভাই ও দুই বোন। তবে আমি আর হাশিম একসঙ্গে বেড়ে উঠেছি। একদম পিঠাপিঠি। আমাদের স্কুল, কলেজ একসঙ্গে। আমাদের পুরো পরিবারটাই সংগীতের পরিবার। বাবা গান করতেন। একভাই তবলার ওপরে পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু কর্মক্ষেত্র সবার আলাদা আলাদা। হাশিমই ছিলো একমাত্র ব্যতিক্রম। ১৯৯৪ সালে ডিগ্রি পাশ করার পর ও আর কিছুতে জড়ায়নি। গান নিয়েই থেকেছে। এই কারণেই ওই সময় থেকেই ওর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় যাতায়াত। সকালে চলে যেতো, রাতে ফিরতো। ওখানেই নিজের মতো করে গান করত। আমরা কেউ কিছু বললে ও বলত, আমি একদিন অনেক বড় শিল্পী হব। আমার সঙ্গে তোরা ছবি তোলার জন্য বায়না ধরবি। আজ আমার ভাইকে সবাই চিনছে। কিন্তু অসুস্থতার কারণে সে এটা বুঝতে পারছে না'।
হাশিম মাহমুদের দীর্ঘদিনের সঙ্গী সালেহ কাজল বলেন, 'চারুকলা থেকেই আমাদের হাশিম ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক। সেটাও প্রায় ২০-২৫ বছর আগে হবে। উনি তখন থেকেই চারুকলার বিভিন্ন জায়গায় বসে গান করেন। আমরা তার সঙ্গে গান নিয়ে নিয়মিত আড্ডা দিই। আমি তাকে ডাকতাম কাকা বলে। এখনও এইভাবেই ডাকি। আমি ডাকলে সাড়া দেন। গল্প করেন। তীব্র অসুস্থতার কারণে শেষ দিকে প্রায় তিন বছর চারুকলায় যাননি। অনেকদিন আমরা তার কোনো খোঁজ পাইনি। হাওয়ার সুত্রে আবার তার খোঁজ করি আমরা। হাশিম ভাই মানে আমাদের কাকা খুব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। কেউ কিছু দিতে চাইলে নিতেন না। এমনকি টাকাও না। খুব কাছের না হলে কারও কাছে কোনো কিছু আবদার করতেন না। ঘুরতে খুব পছন্দ করতেন। টাকাপয়সা ছাড়াই নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন তিনি। এমনও হয়েছেন পকেটে টাকা নেই অথচ হাঁটতে হাঁটতে নারায়নগঞ্জ থেকে চারুকলা চলে আসতেন। বৈরাগ্য নামে একটা ব্যান্ড করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা বেশিদূর আগায়নি।
গানটি নিয়ে মেজবাউর রহমান সুমন বলেন, 'সাদা সাদা কালা কালা' গানটায় খমক ছাড়া কোনো বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয় নাই। নৌকার কাঠ, বাঁশ, হাঁড়ি-পাতিল দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গানটি কম্পোজ করেছেন ইমন চৌধুরী, আর এই অ-যন্ত্রগুলো বাজিয়েছেন মিঠুন চক্র।
গানটির বর্তমান গায়ক শিপলু বাফা ও ছায়ানটে গান শিখেছেন। থিয়েটার করেছেন। অভিনয় করেছেন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর গেরিলা সিনেমায়। এছাড়া নিয়মিত নাটকে অভিনয় করেন ও ভয়েস ওভার দেন। ২০১২ সাল থেকে তিনি কাজ করছেন মেজবাউর রহমান সুমনের ফেসকার্ড প্রোডাকশন হাউসে।
গানটি গাইতে পেরে দারুণ খুশি এরফান মৃধা শিপলু। তিনি বলেন আমি হাশিম ভাইকে অনেকদিন ধরে চিনি। তার সঙ্গে চারুকলায় বহু সময় কাটিয়েছি। তার লেখা ও সুর করা গান গাইতে পারা আমার ভাগ্য।'