হাওয়া: যে ছবি শুধুই চঞ্চলের?
২০১৬ সালের শেষাশেষি চঞ্চল চৌধুরীকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে রেখে 'আয়নাবাজি' ছবিটি যখন মুক্তি পেল, আমি তখনও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পা রাখিনি। সেই সময়ই আমার প্রথমবারের মতো বড় পর্দায় দেখার সৌভাগ্য হয় চঞ্চলের অসামান্য অভিনয়। এখনও পরিষ্কার মনে আছে, কীভাবে চঞ্চল অভিনীত চরিত্রটির আবির্ভাব এবং ক্রমশ রূপান্তর মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখেছিলাম সিনেমা হলের পর্দায়।
এরপর কেটে গেছে প্রায় ছয় বছর। এই এতদিন পর, আজও আমি একটি সিনেমার শো দেখে বের হলাম মনের মধ্যে পুঞ্জিভূত একই ধরনের অনুভূতি সঙ্গী করে। আরও একবার দেখলাম কীভাবে দর্শককে অভিনয়ের ইন্দ্রজালে সম্মোহিত করেন চঞ্চল। এবং সাহস করে বলেই ফেলি, মেজবাউর রহমান সুমনের 'হাওয়া' ছবিতে চঞ্চল হয়তো ছয় বছর আগেকার নিজেকেও ছাপিয়ে গেছেন।
ছোট পর্দার নির্মাতা হিসেবে বহু আগেই হাত পাকানো সুমনের বড় পর্দায় অভিষেক হলো 'হাওয়া' দিয়ে। অথচ ছবিটি দেখতে দেখতে একবারও আমার মনে হয়নি, রূপালী পর্দায় পরিচালকের এটিই হাতেখড়ি। অবশ্য তাকে সাইডলাইনে সরিয়ে দিয়ে এই লেখা আমি শুরু করেছি চঞ্চল চৌধুরীর প্রতি কুর্ণিশ জানিয়ে, কেননা 'চান মাঝি' নামের অনবদ্য একটি চরিত্রে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত করে সুমনের গোটা ছবিটিকেই নিজের করে নিয়েছেন চঞ্চল।
'হাওয়া'র সূচনা হয় আটজন জেলের একটি দলকে নিয়ে। দেখানো হয় তারা মাঝ দরিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যাচ্ছে ডাঙা। আরও দেখা মেলে তাদের জীবনযাপনের স্বতন্ত্র নানা বৈশিষ্ট্যের। সমস্ত বিষয়টাকে বাস্তবসম্মত করে তুলতে নির্মাতা ছবির আদ্যোপান্ত যে পরিমাণ খেটেছেন, তার প্রশংসা না করলেই নয়। এ ছবিতে একেবারে পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রতিফলন ঘটেছে জেলেজীবনের, যা হয়তো খুব একটা তৃপ্তিজাগানিয়া বা সুখকর বিষয় নয়।
তবে তারপরও, 'হাওয়া' তো কোনোভাবেই জেলেজীবনের উপর নির্মিত তথ্যচিত্র নয়। তাই কাহিনিতে অদ্ভুত বাঁকবদল ঘটতে শুরু করে নাজিফা তুষির করা 'গুলতি' চরিত্রটির আবির্ভাবের মাধ্যমে। গল্পের মূল নির্যাসটুকু খোলসা না করেও বলা যায়, তুষির আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই দর্শকের সামনে স্পষ্ট হয়ে যায় যে কাহিনি কোনো গড়পড়তা পথ মাড়াবে না।
চলচ্চিত্রজুড়ে শরিফুল রাজের করা 'ইব্রাহিম' বা 'ইব্রা' চরিত্রটির সঙ্গে রসায়ন জমতে থাকে তুষি তথা গুলতির, যা মাঝেসাঝে কিছুটা অসঙ্গতিপূর্ণ বলেই মনে হয়। তবে পর্দায় তুষির উপস্থিতিকে যথাসম্ভব পরিমিত রাখা হয়েছে। যতবারই তাকে পর্দায় দেখা গেছে, সৌন্দর্যের সুবাতাস বয়েছে। কিন্তু আমি যেমনটা আশা করেছিলাম, তার চেয়ে পর্দায় শরিফুল রাজের উপস্থিতি বেশ কমই ছিল। কিন্তু স্বল্প পরিসরেও একজন মাথা গরম নাবিকের চরিত্রে তার অভিনয় ছিল প্রশংসনীয়।
মূল কাহিনির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে ছবিটির আবহকে সিরিয়াস রাখা হয়েছে বটে, কিন্তু তারপরও গোড়ার দিকে জেলেদের আমুদে, উৎসবমুখর জীবনের উপস্থাপন দেখা গেছে। 'সাদা সাদা কালা কালা' গানের আগ পর্যন্ত এই ব্যাপারটা অব্যাহত ছিল। আবার ওরকম আনন্দঘন সিকুয়েন্সের সঙ্গে সঙ্গে একই সমান্তরালে দর্শককে অস্বস্তি দেওয়া ঘটনার ঘনঘটাও চলতে থাকে, যা তাদেরকে আগাম ইঙ্গিত দিয়ে দেয় যে অচিরেই 'হাওয়া'র হাওয়া অন্যদিকে বইতে আরম্ভ করবে।
চঞ্চল যেমন নিজের সেরা কাজ দেখিয়েছেন এ ছবিতে, তেমনই পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন 'নাগু' চরিত্রের নাসির উদ্দিন খানও। প্রথমার্ধ্বে ইব্রা আর দ্বিতীয়ার্ধ্ব চান মাঝির সঙ্গে তার দৃশ্যগুলো দর্শকের জন্য হাজির হয়েছে দারুণ প্রাপ্তি হিসেবে। এছাড়া সোহেল মন্ডল, সুমন আনোয়ার ও রিজভি রিজুরাও তাদের অভিনয়ের সুবাদে জেলের জীবনযাত্রা আর গল্পের খোলসকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন।
দ্বিতীয়ার্ধ্বে এসে ছবির আবহ যেমন খোলনলচে পাল্টে যায়, তেমনই ছবির ক্লাইম্যাক্সও ছিল পিলে চমকানো। সব মিলিয়ে তাই ছবির গতি দ্বিতীয়ার্ধ্বে এসে বহুগুণে বেড়ে যায়। আদতে গল্পই হলো 'হাওয়া'র প্রাণ, এবং সেটিও খুব দুর্বোধ্য, জটিল কিছু না। এতটাই সাদাসিধেভাবে গল্পটাকে তুলে ধরা হয়েছে যে, অনেকেরই নজর এড়িয়ে যেতে পারে কীভাবে পৌরাণিক নানা থিম দ্বারা অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত হয়েছে 'হাওয়া'।
আবারও, ছবিটি দেখার আগেই আপনাদের যাবতীয় আনন্দে জল না ঢেলে দিয়েই বলছি, 'হাওয়া'র কাহিনি মূলত রূপকথা-ঘেঁষা, যেখানে ছোঁয়া রয়েছে হরর এবং আন্তঃপ্রজাতির প্রেমকাহিনিরও... খানিকটা আরকি!
এমন রোমহর্ষক অথচ চমকপ্রদ কাহিনিবিন্যাস জীবন্ত হয়ে ওঠে চঞ্চল চৌধুরীর কল্যাণে। তিনি সমস্ত লাইমলাইট নিজের দিকে টেনে নেন। তিনি দুর্ধর্ষ অভিনয় করেন এমন একটি চরিত্রে, যাতে তাকে ইতঃপূর্বে কখনো দেখা যায়নি। তার সংলাপ, কাজকারবার থেকে শুরু করে ক্ষণে ক্ষণে ভোল পাল্টে নিজের নিত্যনতুন দিকের উন্মোচন ঘটানো, সব মিলিয়ে যে বৈচিত্র্যময় অভিনয় তিনি দেখিয়েছেন, বেশ কিছুদিন তা আমাকে তাড়া করে ফিরবে!
পুরো কাহিনিই আবর্তিত হয়েছে মাঝ সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য ভাসমান একটি ট্রলারকে কেন্দ্র করে। ছবিটি দেখার আগে কেউ কেউ ভেবে বসতেই পারেন, একই ধরনের দৃশ্য ও ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে দর্শকমনে বুঝি বিরক্তির উদ্রেক ঘটবে। কিন্তু চিত্রগ্রাহক কামরুল হাসান খসরুকে বিশেষভাবে সাধুবাদ জানাতেই হয় যে তিনি সেটি ঘটতে দেননি। সমুদ্রের খুবই প্রাণবন্ত, কখনো বা আবার অতিপ্রাকৃত শটগুলো, এবং কমেডি সিকুয়েন্সগুলোতে অভিনব ক্যামেরার কাজ আমাকে যেমন চমৎকৃত করেছে, ঠিক তেমনই প্রতিক্রিয়া দেখেছি আশেপাশের অনেক দর্শকের মাঝেও।
একইভাবে, ছবিতে দর্শক যে ভিন্নধর্মী অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবে, সেজন্য তাদেরকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তুলতে বড় ভূমিকা রেখেছে রাশেদ শরিফ শোয়েবের করা নেপথ্য সংগীত। দুই-একটি অতিনাটকীয় কথোপকথন বাদ দিলে, ছবির সংলাপ ও ন্যারেশন স্টাইল আমার কাছে সত্যিকার অর্থেই ব্যতিক্রমধর্মী বলে মনে হয়েছে। তবে, কিছু কিছু দৃশ্যে আবহসঙ্গীত ও সংলাপের সমন্বয় হয়তো আরো ভালো হতে পারত। কাহিনির পরিধি ও পরিসরকে যতটা বিস্তৃত করে দেখানো হয়েছে, সে তুলনায় নাজিফা তুষির চরিত্রটির মোটিভেশন কারও কারও কাছে অতি-সাধারণ মনে হতে পারে।
খবর আসছে, প্রথমদিন দেশব্যাপী প্রায় সব সিনেমা হলেই নাকি 'হাওয়া' হাউজফুল যাচ্ছে। আমি বলব, এই ছবিকে নিয়ে দর্শকমনে যে উন্মাদনা, সেটি সম্পূর্ণ যৌক্তিক, কারিগরী এবং কলাকুশলীদের পারফর্মেন্সের জন্য। এমন একটি ছবির মাধ্যমে মেজবাউর রহমান সুমনের চলচ্চিত্র জগতে আত্মপ্রকাশও আমার মতে কম তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা নয়।