সংগীতাঙ্গণে আমার জীবন সার্থক: মকসুদ জামিল মিন্টু
জনপ্রিয় কথাশিল্পী হুমায়ুন আহমেদের লেখা এবং সুবীর নন্দীর কণ্ঠে 'ও আমার উড়াল পঙ্খীরে', 'একটা ছিল সোনার কন্যা' গান দুটো ছিল সুরকার ও সংগীত পরিচালক মকসুদ জামিল মিন্টুর সুর করা সর্বশেষ তুমুল জনপ্রিয় গান।
এর আগে শেখ ইশতিয়াকের গাওয়া 'নীলাঞ্জনা', 'আমার মনের ফুলদানিতে', 'একদিন ঘুম ভেঙে দেখি', 'নন্দিতা তোমার কথা', বেবী নাজনীনের গাওয়া 'এলোমেলো বাতাসে উড়িয়েছি শাড়ীর আঁচল', তপন চৌধুরীর কণ্ঠে 'কাইন্দা আসে ভবের মানুষ', শুভ্রদেবের 'কোনও এক সন্ধ্যায়', সাবিনা ইয়াসমিনের 'আমার ভাঙা ঘরে ভাঙা চালা' ও 'বরষার প্রথমদিনে', আগুনের কণ্ঠে 'মাথায় পড়েছি সাদা ক্যাপ', বারি সিদ্দিকীর 'ওগো ভাবীজান', অ্যান্ড্রু কিশোরের 'গরুর গাড়ীর দুই চাকা', মমতাজের 'ঢোল বাজে দোতরা বাজে', ফজলুর রহমান বাবু ও শফি মন্ডলের যৌথ কণ্ঠে 'বাজে বংশী রাজহংসী নাচে' শিরোনামের শ্রোতাপ্রিয় গানগুলোর সুর করে বাংলা গানের শ্রোতাদের মনে চিরস্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছেন মকসুদ জামিল মিন্টু।
যন্ত্রশিল্পী হিসেবে সংগীতজীবন শুরু করলেও গানের প্রতি অদম্য আগ্রহ তাকে দ্রুতই একজন সফল সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। সাংবাদিক পরিবারে জন্ম হলেও তিনি সাংবাদিকতায় আগ্রহী ছিলেন না। তার নানা 'দৈনিক আজাদ' পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন চাইতেন মিন্টু যেন যন্ত্রশিল্পী হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হন। বাবা একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও কবি মাহফুজ উল্লাহ তাকে এসব কাজে উৎসাহ দিতেন। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই সাংস্কৃতিক অঙ্গণে তার পদচারণা শুরু হয়। গানের কণ্ঠ যেহেতু 'সুরেলা' নয়, তাই নানার পরামর্শে যন্ত্রসংগীতের দিকে মনোযোগী হন। শুরুতে তিনি হারমোনিয়ামের প্রতি জোর দেন। অল্প সময়েই একজন দক্ষ হারমোনিয়াম বাদক হিসেবে পরিচিতি তৈরী হয় মকসুদ জামিল মিন্টুর। পুরান ঢাকার সংগীতানুষ্ঠানে নিয়মিত হারমোনিয়াম বাজাতে থাকেন। তার স্কুলজীবনের বন্ধু জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী শেখ ইশতিয়াক ও হ্যাপি আখন্দ তাকে এই জগতে প্রতিষ্ঠিত হতে উৎসাহ যোগান।
হারমোনিয়াম ছেড়ে ১৯৭৮ সালে গিটার বাজানো আয়ত্ত করেন গুণী মানুষটি। ১৯৭৯ সালে একজন গিটারবাদক হিসেবে বিটিভিতে কাজ শুরু করেন। ১৯৮২ সালে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সংগীত পরিচালনায় 'মেঘ বিজলী বাদল' সিনেমায় আবহ সংগীতে গিটার বাজান তিনি। সেই থেকে এখন পর্যন্ত এই কাজটি নিয়মিত করে যাচ্ছেন। মতিন রহমানের পরিচালনায় 'আগুন জ্বালো' সিনেমা দিয়ে বড়পর্দায় প্রথম গানের সুর করেন মিন্টু। তবে সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের সিনেমাতেই বেশি কাজ করেছেন। সিনেমার পাশাপাশি অডিও অ্যালবামের কাজেও তিনি সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
১৯৮৬ সালে শেখ ইশতিয়াকের একক গানের অ্যালবাম 'নন্দিতা' ও গানগুলো তারই সুর ও সংগীত পরিচালনা করা। এরপর বেবী নাজনীন এবং সুবীর নন্দীর একক গানের অ্যালবামের সুর করেও প্রশংসিত হন মিন্টু। ১৯৮৮ সাল থেকে তিনি টিভি নাটকের সংগীত পরিচালনার কাজ করছেন। এরইমধ্যে পাঁচ শতাধিকেরও বেশি নাটকের কাজ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাজ হলো সেলিম আল দীনের 'গ্রন্থিকগণ কহে', আবদুল্লাহ আল মামুনের 'শীর্ষবিন্দু' এবং মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর 'কোথাও কেউ নেই', হুমায়ূন আহমেদের 'আজ রবিবার'। হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত 'ঘেঁটুপুত্র কমলা' ছিল তার করা সর্বশেষ সিনেমার কাজ। হুমায়ুনের প্রয়াণের পর থেকে তিনি সিনেমার কাজে এক দশকের বিরতি দিয়েছিলেন।
গত বছরের শেষ প্রান্তে আবার তিনি ফিরেছেন সিনেমার গানে। ফজলুল কবির তুহিনের পরিচালনায় 'গাঙ কুমারী' নামের একটি সরকারী অনুদানের সিনেমার তিনটি গানের সুর ও সংগীত পরিচালনা করছেন। গানগুলোতে কণ্ঠ দিয়েছেন রাজীব, ঐশী, শফি মন্ডল ও চন্দনা মজুমদার। এ প্রসঙ্গে মকসুদ জামিল মিন্টু বলেন, 'সিনেমার গানের মজা অন্য রকম। তাই কাজটি আবার শুরু করলাম। তিনটি গানই যথেষ্ট মেলোডিয়াস। চেষ্টা করেছি সহজ সুরের মাধ্যমে গাওয়াতে। শ্রোতাদের কেমন লাগবে তা জানি না।'
হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত 'শ্রাবণ মেঘের দিন' সিনেমার 'একটা ছিল সোনার কন্যা' গানটির সুরকার হিসেবে তিনি ১৯৯৯ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। সম্প্রতি ২০২১ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরিবোর্ডের একজন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
সংগীতাঙ্গণে তার জার্নি প্রসঙ্গে জীবনের এ পর্যায়ে এসে তিনি বলেন, 'আমি সংগীতাঙ্গণ থেকে যা প্রত্যাশা করেছিলাম, তার সবটুকুই পেয়েছি। সংগীতাঙ্গণে আমার জীবন সার্থক। আমার আর চাওয়ার কিছু নাই। তারপরও যতদিন কর্মক্ষম থাকব কাজ করে যাব।'