পালা গান থেকে হিপহপ: কুদ্দুস বয়াতির ঝলমলে যাত্রা
বাংলাদেশের লোকজ গানের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী, সুরকার ও গীতিকার কুদ্দুস বয়াতি শারিরীক অসুস্থতা কাটিয়ে এখন পুরোপুরি সুস্থ। তাইতো নিয়মিত গান গাইছেন। তিনি মূলত একজন পালাকার। শহর এবং গ্রামাঞ্চলে সমানতালে চলছে তার স্টেজ অনুষ্ঠান।
দীর্ঘ বিরতির পর নতুন একক গান প্রকাশ করার কাজ হাতে নিয়েছেন। তবে তা একটি নয়, একাধিক। গানগুলো তার নিজের লেখা এবং সুর করা। তবে কম্পোজিশন অন্যের করা। আগামী ঈদের পরই নতুন গানগুলো মুক্তি দেয়ার পরিকল্পনা তার। তবে গানগুলোর বিস্তারিত তথ্য এখনই প্রকাশ করতে চাইছেন না তিনি।
নতুন গান প্রসঙ্গে কুদ্দুস বয়াতি বলেন, 'আমি সারাক্ষণই গানের মধ্যে থাকি। যতক্ষন জেগে থাকি, ততক্ষণ গান আসতে থাকে মাথায়। যেহেতু পড়ালেখা জানি না, তাই সেগুলো লিখে রাখতেও পারি না। তবে অন্যদের দিয়ে মাঝেমধ্যে লিখিয়ে রাখি। অনেকদিন ধরেই আমার কোনো নতুন মৌলিক গান প্রকাশ হচ্ছে না। তাই শ্রোতাদের নতুন কয়েকটি গান প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করছি গানগুলো শ্রোতাদের পছন্দ হবে।'
এর আগে তার মাত্র দুটি গানের অ্যালবাম প্রকাশ হয়েছিল। 'সোনার নুপুর' এবং 'আম খায়ো জাম খায়ো তেঁতুল খায়ো না' অ্যালবাম দুটির প্রায় সব গানই শ্রোতাদের কাছে প্রশংসিত ছিল।
অ্যালবাম ছাড়াও তিনি নাটক, সিনেমা এবং তথ্যচিত্রে অসংখ্য গান গেয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত 'ঘেটুপুত্র কমলা'য় তার গাওয়া 'আমার যমুনার জল' গানটি সর্বশেষ তুমুল জনপ্রিয় গান। এছাড়া প্রীতম আহমেদের সুর ও সংগীতে ২০১৬ সালে 'আসো হে মামা' নামের একটি আধুনিক হিপহপ গানে কণ্ঠ দিয়েও সফলতা এবং তুমুল আলোচনায় জায়গা করে নিয়েছিলেন।
হিপহপ গানে কণ্ঠ দেয়া প্রসঙ্গে কুদ্দুস বয়াতি বলেন, 'কণ্ঠশিল্পী মিলু ভাইয়ের ছেলে প্রীতম একদিন তাদের বনশ্রীর বাসায় দাওয়াত দেয়। আমি আসলে দাওয়াত উপলক্ষ করেই যাই। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর প্রীতম আমাকে এই আসো হে মামা গানটিতে কণ্ঠ দেয়ার প্রস্তাব দেয়। এটি আমার ধারার পুরো বিপরীতমুখী সুরের একটি গান ছিল। তাদের ধারণা ছিল যে হয়ত গানটি আমি কণ্ঠে তুলতে পারব না। কিন্তু অল্প সময়েই সেটি কণ্ঠে তুলে দেখিয়ে দিয়েছিলাম যে কুদ্দুস বয়াতি সব পারে। গানের জায়গায় আমার সব মনোযোগ। গানটি প্রকাশ হওয়ার পর শ্রোতাদের কাছে থেকে অস্বাভাবিক ভালোবাসা পাই। রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে সবাই সেই গানের প্রসঙ্গটিই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেন এখনও।'
তবে হিপহপ গানে সফলতা পেলেও তিনি ট্র্যাকের বাইরে যাননি। নিজের শেকড়ের সঙ্গেই অবিচ্ছেদ্য হয়ে থেকেছেন। লোকজ গানেই তিনি স্থির হয়ে আছেন।
কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের পরিচালনায় একটি সচেতনতামূলক তথ্যচিত্রে 'এই দিন দিন নয় আরো দিন আছে' শিরোনামের গান গেয়ে ১৯৯২ সালে প্রথম দেশব্যাপী আলোচনায় আসেন কুদ্দুস বয়াতি।
ঢাকার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার পদচারণা ঘটে ১৯৮৮ সালে। সেই বছরের ১৯ নভেম্বর রাজধানীর বেইলী রোডের মহিলা সমিতি মিলনায়তনে একটি সাংস্কৃতিক উৎসবে শহরের দর্শকের সামনে প্রথম পালাগান পরিবেশন করেন তিনি। যা ছিল তার জীবনের নতুন এক অভিজ্ঞতা। এ প্রসঙ্গে কুদ্দুস বয়াতি বলেন, 'আমি তো গ্রামের মানুষ। গ্রামেগঞ্জেই গান করতাম। তাছাড়া আমার গানের শ্রোতা মূলত গ্রামেরই। একটা সময় বৃহত্তর ময়মনসিংহে আমার গানের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। সেই খবর ঢাকাতেও হয়ত পৌঁছায়। ঢাকা থেকে আমন্ত্রণ পাঠান রামেন্দু মজুমদার, গবেষক সাইদুর রহমানসহ অনেকে। কখনও ঢাকা দেখা হয় নাই আগে। ভয় এবং শঙ্কা নিয়ে ঢাকায় আসি। তবে মঞ্চে গান পরিবেশনের পর থেকে আমার ধারণা পরিবর্তন হয়ে যায়।'
'মানুষের কাছে থেকে ভালোবাসা পাই। সেই থেকেই শুরু নিজস্ব পরিমণ্ডলের বাইরে আসা। এই অনুষ্ঠানে এসেই কুদ্দুস থেকে কুদ্দুস বয়াতি হয়ে যাই। তাই এটি আমার জীবনের স্মরণীয় একটি ঘটনা।'
কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ নাটক ও সিনেমায় তার অসংখ্য গান ব্যবহার করেছেন। তার সংগীত জীবনে হুমায়ূনের প্রভাব প্রসঙ্গে কুদ্দুস বয়াতি বলেন, 'আসলে হুমায়ুন স্যারের কারণেই হয়ত সবাই আমাকে চেনেন বেশী। কারণ তিনি আমাকে যেভাবে ব্যবহার করেছেন এবং প্রচারণায় রেখেছিলেন, তার কারণেই মানুষ আমার সম্পর্কে আগ্রহী হয়েছেন। স্যারের প্রতি আমার আজীবন শ্রদ্ধা থাকবে। তার অবদানের কথা কখনই ভুলবনা আমি।'
সংগীত সাধনার পাশাপাশি এক দশক আগে তার জন্মস্থান নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় 'কুদ্দুস বয়াতি ফাইন্ডেশন' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শুরুতে এটির কার্যক্রম ভালোই চলচিল কয়েক বছর। কিন্তু শারিরীক অসুস্থতার কারণে কয়েক বছর তিনি সেটির তদারকি কাজ করতে পারেন নি। তাছাড়া অসুস্থতায় চিকিৎসার কারণে আর্থিক সামর্থও কমে যায়। ফলে সেই ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম অনেকটাই স্থবির। তবে এটি আবারও সক্রিয় করার পরিকল্পনা করছেন কুদ্দুস বয়াতি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমি নিতে আসি নাই, দিতে এসেছি। একসময় প্রচণ্ড অর্থকষ্টে ছিলাম। পড়ালেখা থেকে শুরু করে ঠিকমতো খেতেও পারি নাই একসময়। আমার যেহেতু সামর্থ হয়েছে, তাই আমি মনস্থির করেছি যে আমার মতো যারা কষ্টে আছেন এখন তাদের জন্য কিছু করব। সেই ভাবনা থেকেই ফাউন্ডেশনটা করেছি।'