বাংলাদেশে হিপহপ: ক্রিটিক্যাল মাহমুদ, ক্রাউনইঞ্জিন...ব্রেক ড্যান্সারদের গল্প
স্প্রাইটের 'দিন ভারী, জীবন জারি' বিজ্ঞাপনের কথা মনে আছে? জিঙ্গেল শুনে সাধারণ গান থেকে ভিন্নরকম মনে হয়েছে, তাই না? পুরো বিজ্ঞাপনের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে, কয়েকটি বাক্য সুর দিয়ে ছন্দের মাধ্যমে কিংবা আরো ভালোভাবে বলা যায় র্যাপের মাধ্যমে আওড়ানো হচ্ছিলো। এই ছন্দটির জনপ্রিয়তা এতটাই বৃদ্ধি পায় যে, অচিরেই মানুষের মুখে মুখে তা ছড়িয়ে পড়ে। এই ছন্দটিই হচ্ছে র্যাপ যা হিপহপ সংস্কৃতিরই একটি অংশ।
'হিপহপ' শব্দটি শুনলেই অনেকে নাক সিঁটকে উঠেন। ত্রাহি ত্রাহি রব তোলেন চারপাশে। তর্কের খাতিরে অনেকে একে অপসংস্কৃতি বলে অভিহিত করতেও পিছপা হন না। এর পেছনে অবশ্য কাজ করে বঙ্গীয় মননশীলতা। বঙ্গদেশে নতুন কিছু সাদরে গ্রহণ করতে খানিকটা সময় লাগে; যেমনটা নব্বইয়ের দশকে ব্যান্ডসঙ্গীত নিয়ে দেখা যেতো। অথচ কালের পরিক্রমায় ব্যান্ডের গান এখন অনবদ্য সময় কাটানোর অংশ হয়ে উঠেছে।
বৈশ্বিকভাবে এমিনেম, পিটবুলের চর্চিত হিপহপ সংস্কৃতি জনপ্রিয়তা পেলেও বাংলাদেশে অনেকেই হিপহপকে নেতিবাচকভাবে দেখেন। অথচ বাংলাদেশে হিপহপের সূচনা সেই ১৯৯৩ সালেই হয়েছিলো। আব্দুল ওয়াজেদ চারু, আশরাফ বাবু ও পার্থ বড়ুয়ার হাত ধরে আসে প্রথম র্যাপ অ্যালবাম 'ত্রিরত্নের ক্ষ্যাপা'। এই ১৭টি র্যাপ গান সম্বলিত অ্যালবামটি বিপুল জনপ্রিয়তা পায় সেসময়। একই বছরেই তাদের মাধ্যমে আসে 'বায়ুচড়া' নামের আরেকটি অ্যালবাম। এরপর থেকেই দেশে অবিরামভাবে চলা র্যাপ গানের গতি আর কেউ রোধ করতে পারেনি। সাময়িকভাবে কিছু সমস্যা হলেও র্যাপ সঙ্গীতজ্ঞরা তা সামলে নেন।
হিপহপের ইতিহাস
বৈশ্বিকভাবে হিপহপ সংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছিলো ১৯৭০ এর দশকে। নিউইয়র্ক শহরের সাউথ ব্রনক্স এলাকায় এর চর্চা শুরু হয়েছিলো। হিপহপ শব্দটির প্রচলন করেন রবার্ট কিথ কাউবয় নামক একজন ব্যক্তি। তিনি র্যাপ করতেন যাকে হিপহপের ভাষায় এমসি হিসেবে অভিহিত করা হয়। কাউবয় তার মঞ্চে গাওয়া গানগুলোর মধ্যে হিপহপ শব্দটি ব্যবহার করতেন; যা পরবর্তী সময়ে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হিপহপের যাত্রা নিউইয়র্ক থেকে থেকে শুরু হলেও এর প্রকৃত উৎস আফ্রিকার সঙ্গীত। জ্যামাইকার বংশোদ্ভুত ডিস্ক জকি ক্লিভ ক্যাম্পবেল যিনি ডিজে 'কুল হার্ক' নামেও পরিচিত; তিনিই ১৯৭৩ সালের দিকে তার গানের লিরিকের মাধ্যমে হিপহপের প্রচলন করেন।
তৎকালীন সময়ে হিপহপ সঙ্গীত ডিস্কো সঙ্গীত দ্বারা প্রভাবিত ছিলো। সে সময় পশ্চিম আফ্রিকার 'গ্রিয়ট' নামের গানের দল ছিলো যারা ছন্দের মাধ্যমে এক ধরণের গান গাইতো। সেটি শুনতেও অনেকটা র্যাপ গানের মতো ছিলো। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবেই ব্যবহার করা হতো সেটিকে। তাই ধরা আফ্রিকান ঘরানার সঙ্গীত থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েই হিপহপের বিকাশ ঘটেছে।
হিপহপ সঙ্গীতের স্বর্ণযুগ হিসেবে আশির দশকের শেষ সময়কে ধরা হয়। ১৯৭৯ সালে 'সুগারহিল গ্যাং' ব্যান্ড কর্তৃক 'র্যাপারস ডিলাইট' নামে একটি গান প্রকাশিত হয়েছিলো। ধরা হয় এটি রেকর্ডকৃত প্রথম হিপহপ গান, যেটি বিশ্বব্যাপী বিপুল জনপ্রিয়তা পায়।
সত্তরের দশকের প্রাক্কালে র্যাপ সঙ্গীতের সাথে পাশাপাশি ব্রেকড্যান্সেরও বিকাশ ঘটে। ধরা হয়, অধিকার প্রকাশ কিংবা বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের উপায় হিসেবে প্রবর্তন ঘটে এর। দুপক্ষের নৃত্যশৈলী প্রদর্শনের পর যে দল নিজেদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখাতে সক্ষম হতো, তারাই বিজয়ী হতো। এভাবেই সময়ের আবর্তনে ব্রেকড্যান্স দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
১৯৭৩ সালের দিকে যখন হিপহপ সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে তখন চারটি বিষয়কে হিপহপের মূল উপাদান ধরা হতো। সেগুলো হলো- র্যাপ, ডিজে, ব্রেকড্যান্সিং বা বি-বয়িং ও গ্রাফিতি। তবে বর্তমান সময়ে এর সাথে আরো কিছু উপাদান যোগ হয়েছে। এখন হিপহপের মূল উপাদান বলতে র্যাপ, ডিজে, বি-বয়িং বা বি-গার্লিং, বিটবক্সিং ও হিপহপ সম্পর্কিত ফ্যাশন বা জ্ঞান।
বর্তমানে হিপহপ নিয়ে অনেক দর্শকদের মধ্যে ঋণাত্মক ধারণা থাকলেও তা নিয়ে কাজ করছে একদল তরুণ। এদের মধ্যে কেউবা র্যাপ পরিবেশন করছে আবার কেউবা ব্রেকড্যান্স আবার কেউ বিটবক্সিং। হিপহপ চর্চা করা এই প্রজন্মের সামনে হাজার বাধা আসলেও তারা সেটিকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যাচ্ছেন।
হিপহপে আগ্রহ যাদের!
'হিপহপের উপাদান র্যাপ হলেও সব র্যাপ হিপহপ নয়', বলছিলেন খালেদ মাহমুদ ওরফে ক্রিটিক্যাল মাহমুদ। বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ও হিপহপের চর্চা ছড়িয়ে দিয়ে কাজ করছেন খালেদ মাহমুদ ওরফে ক্রিটিক্যাল মাহমুদের দল আন্ডাররেটেড বাংলাদেশ। এই দলটি হিপহপের র্যাপ বা এমসি উপাদানের চর্চা করেন। ২০২০ সালে খালেদ ও তার আরো দুইজন বন্ধু মিলে 'রাজধানী স্ট্রিট' নামে একটি র্যাপ গান দর্শকদের উপহার দেন। এই গানটিই তাদের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা তৈরি করে দেয়।
'রাজধানী স্ট্রিট' এর সফলতার পর খালেদ দল তৈরির উদ্যোগ নেন; যার নাম দেন আন্ডাররেটেড বাংলাদেশ। হিপহপ শিল্পীদের জন্য আলাদা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করাই হলো এই দলের উদ্দেশ্য। খালেদ এ প্রেক্ষিতে জানান, 'আমাদের মূলমন্ত্র হলো আর্টিস্ট ফর আর্টিস্ট। দিন শেষে দেখা যায় হিপহপ শিল্পীদের জন্য আলাদা কোনো জায়গা নেই। বিভিন্ন মিডিয়া আমাদের ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে বা টিআরপির জন্য বিতর্কিতভাবে ব্যবহার করে।'
মোট ৯ জনকে নিয়ে তৈরি হয় আন্ডাররেটেড বাংলাদেশ দল। এদের মধ্যে রয়েছেন পাঁচজন র্যাপার, দুইজন অডিও ইঞ্জিনিয়ার ও দুই প্রোডিউসার। দলের মূল কাণ্ডারি হিসেবে আছেন খালেদ মাহমুদ ওরফে ক্রিটিক্যাল মাহমুদ। যিনি একই সাথে র্যাপিং, অডিও ইঞ্জিনিয়ারিং ও মিক্সমাস্টারিং এর কাজ করেন।
এছাড়াও রয়েছেন আবির ওরফে ক্রাউনইঞ্জিন, রাকিব ওরফে লেজিপান্ডা, মাহির ওরফে স্লিকফ্রিক, রোহান ওরফে ইউএচার, শুভ ওরফে সন্ন্যাসী, কামরুল ওরফে জিএক্সপি, জুবায়ের ওরফে দ্য মেলোডিয়ান এবং রাইভি ওরফে আরভি রাইভি। মূলত খালেদ ও শুভ মিলেই প্রাথমিকভাবে দলের কাজ শুরু করেছিলো; পরে একে একে যুক্ত হয় সবাই।
এমসি ছাড়াও আছে বি-বয়, বি-গার্ল!
ব্রেকড্যান্সার বা বি-বয় সাবিল ইমাদ হিপহপ সংস্কৃতির সাথে যুক্ত হওয়ার গল্প বলতে গিয়ে জানান ভিন্নরকম অভিজ্ঞতার কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগের নবীনবরণে প্রথম নাচ করলেও হিপহপে যুক্ত হবেন সে কথা কস্মিনকালেও কল্পনা করেননি। ২০১৯ সালে হিপহপের দল অ্যানোনিমাস ক্রু এর ওয়ার্কশপে প্রশিক্ষণ নেন সাবিল। সেখানেই সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা জন্মে যায়।
এক্ষেত্রে অনেকটা সেতু হিসেবে কাজ করে ছোটবেলায় শোনা র্যাপ গান। এরপর আর পেছনে তাকাননি, মন দিয়ে রপ্ত করেন নাচ। ভিন্নধর্মী এই নৃত্যকলার মাধ্যমে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে।
সৃষ্টি গুপ্তের নাচের প্রতি ভালোবাসা ছোটবেলা থেকেই; শিখতেন ক্ল্যাসিক্যাল নাচ। উড়ন্ত তিতলির মতো ছুটে চলা জীবনে আচমকাই আগমন ঘটে হিপহপের। ২০১৮ সালে হিপহপ দল ওটু স্ট্রিট ড্যান্স ক্রু'র হিপহপ নাচ দেখে ভালো লেগে যায় সৃষ্টির। ছোটবেলা থেকে ক্ল্যাসিক্যালে অভ্যস্ত হওয়া সৃষ্টির কাছে হিপহপের নাচের মুদ্রা বিস্ময় সৃষ্টি করে। ভালো লাগা থেকেই যুক্ত হয়ে যান হিপহপের ব্রেকড্যান্সের সাথে।
নিজেকে আন্ডারগ্রাউন্ড ড্যান্সার অর্থাৎ মূল স্রোতের চলতে থাকার বিপরীতে চলা নৃত্যশিল্পী হিসেবেই পরিচয় দিতে পছন্দ করেন সৃষ্টি। বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশের প্রথম নারী বি গার্ল বা ব্রেকড্যান্সার হিসেবেও উঠে আসে সৃষ্টির নাম।
মনোবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী জয়শ্রী দেবীর নাচের প্রতি আগ্রহ থাকলেও সেভাবে নাচ শেখা হয়ে ওঠেনি। ২০১৮ সালে তিনি হঠাৎ জানতে পারেন, গ্রিন ইউনিভার্সিটির ফিল্ম, টেলিভিশন ও ডিজিটাল মিডিয়া ডিপার্টমেন্ট হিপহপ নাচের কোর্স চালু করছে৷ আগে থেকে হিপহপ নিয়ে অল্পবিস্তর জানা থাকলেও সেভাবে পরিপূর্ণ জ্ঞান ছিলো না। নিছক আগ্রহের বশেই শুরু করেন কোর্সটি। তিন মাসের কোর্স শেষে হিপহপ সম্পর্কে নতুন দুনিয়া তার সামনে উঠে আসে, ভালোবেসে ফেলেন সেটিকে।
নেতিবাচকতাকে গায়ে মাখেন না তারা!
হিপহপের চর্চা বিশ্বব্যাপী দারুণভাবে এগিয়ে চললেও এটি নিয়ে কিছুটা নেতিবাচকতা দেখা যায় বাংলাদেশে। আন্ডাররেটেড বাংলাদেশের ধারক খালেদ বলেন, 'হিপহপ নিয়ে বাংলাদেশে নেগেটিভিটি থাকলেও আগের থেকে কমছে। আগে ৩০ শতাংশ দর্শক পজিটিভলি নিলে ৭০ শতাংশ মানুষ নেগেটিভ মন্তব্য করতো। এখন সেটা ৫০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে কারণ এখন নতুন দর্শক তৈরি হচ্ছে।'
হিপহপের নিয়ে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ব্রেকড্যান্সার বা বি-বয় সাবিল ইমাদ বলেন, 'বাংলাদেশের মানুষ এখনো পুরোপুরি হিপহপ সম্পর্কে জানে না, না জানার কারণে দেখেও না। এ কারণে বিভিন্ন পারফর্ম্যান্স তারা বুঝে উঠতে পারেননা। যার জন্য তারা নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে ফেলেন। এটা আমরা সমস্যা বলে ভাবছি না। আমরা এটা মোকাবেলা করে নিজেদের শিল্প প্রদর্শনের চেষ্টা করছি।'
বাংলাদেশে একজন পুরুষ নাচ করে তার জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করবে এই বিষয়টিকে সমাজে বাঁকাভাবে দেখা হয় এখনো। তাই বি-বয় সাবিলের পরিবারও এই দোলাচল থেকে বের হতে পারেনি প্রথমে। সাবিল জানান, 'প্রথম প্রথম পরিবার থেকে বলতো, এখন খেয়াল খুশি মতো পারফর্ম করলেও ক'দিন পর এগুলো ছেড়ে চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। কিন্তু পেইড কাজ পাওয়া শুরুর পরে এখন একটু নমনীয় পর্যায়ে আছে। তাও সামনে যেহেতু কোনো স্থির ক্যারিয়ার নেই, তাই এখনো কিছুটা বাধার মুখে পড়তে হয়।'
'হিপহপ সংস্কৃতিকে কেন জানি মানুষ অপসংস্কৃতি বলে। হিপহপ করলে মানুষ ভাবে খারাপ কিছুর সাথে যুক্ত আছি; অনেকে তো মাদকাসক্ত বা বিভিন্ন ড্রাগ গ্রহণ করে এমনও মনে করে। অথচ হিপহপের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, তরুণ প্রজন্ম মাদক থেকে যাতে বিরত থাকে তার জন্যই এর উদ্ভব হয়েছে', হিপহপ সংস্কৃতি নিয়ে জনমনের উদ্বেগ ব্যক্ত করতে গিয়ে জানান সৃষ্টি।
ইতিবাচকতা ও নেতিবাচকতা উভয়কেই শক্তি হিসেবেই গ্রহণ করেছেন সৃষ্টি। সৃষ্টির মতে, মানুষ তাকে কেন্দ্র করে যত নেতিবাচক মন্তব্য করবে, ততোই তিনি নিজেকে প্রমাণ করতে পারবেন।
হিপহপ নিয়ে দর্শক প্রতিক্রিয়ার ব্যক্ত করতে গিয়ে জয়শ্রী জানান, 'আমরা যখন লাইভ পারফর্ম করি, তখন দর্শকের প্রতিক্রিয়া ভালোই আসে। যখন সেটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যায়, তখন বাজেভাবে সেটার প্রচার করা হয়। যার জন্য মানুষ একে নেতিবাচকভাবে দেখে।'
নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াগুলোকে কীভাবে মোকাবেলা করেন জানতে চাইলে জয়শ্রী জানান, 'আমরা এর সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। যারা হিপহপ বুঝতে চায়, তারা বুঝতে পারবে আর যারা বুঝতে চায় না, তারা বুঝবে না। যার জন্য নিজেদের কাজ করে যাচ্ছি।'
পোশাকই যখন হিপহপের বহিঃপ্রকাশ!
যারা র্যাপ গান করে তাদের পোশাকের ব্যাপারে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম আছে কি না জানতে চাইলে আন্ডাররেটেড বাংলাদেশের দলের অন্যতম সদস্য আবির জানান, 'প্রত্যেক বিষয়ের ভিন্ন ভিন্ন স্টাইল থাকে। আমরা যা পরিধান করি সবই হিপহপ সংস্কৃতির সাথে যুক্ত। আমার টিশার্ট, মাথার স্ন্যাপব্যাক ক্যাপটিও এর অন্তর্ভুক্ত। তবে বিষয়টা সবসময় না যে আমি যেহেতু মিউজিক করছি, তাই আমাকে সবসময় এমন পোশাক পরেই থাকতে হবে। ফরমাল পোশাকও আমরা পরি।'
একইভাবে দলের কর্ণধার খালেদ জানান, 'হিপহপের পঞ্চম উপাদান হচ্ছে সংস্কৃতি ও ফ্যাশন। এমন না যে আমরা শুধু টিশার্ট-প্যান্ট এসবই পরিধান করি। আমরা যখন পাঞ্জাবি-পায়জামা পরি তার সাথেও হিপহপের ফ্যাশন বজায় রাখার জন্য স্নিকার্স পরি। আমরা যখন কোনো হিপহপের কনসার্টে যাই তখন আমরা আমাদের মতো পোশাকে যাই, কারণ তারা সেটা পছন্দ করে। তাই আমরা দৈনন্দিন জীবনে যা পরি তাই হিপহপ।'
দলের আরেকজন সদস্য রাকিব বলেন, 'রাজধানী স্ট্রিট গানটি যখন আমরা করি, তখন সেখানে বলা হয়েছিলো লুঙ্গি আমাদের গর্বের পোশাক। সবার কাছে আমি যেহেতু একজন হিপহপ জানাসম্পন্ন ব্যক্তি। যখন আমি লুঙ্গিও পরছি আবার হিপহপও করছি, তখনই সংস্কৃতির রসায়ন তৈরি হচ্ছে।'
বঙ্গীয় সমাজে পুরুষদের চাইতেও নারীদের পোশাক নিয়ে অধিক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। বি গার্ল সৃষ্টিও এর ব্যতিক্রম নন; পোশাকের ব্যাপারে বলতে গিয়ে সৃষ্টি জানান ভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা। উচ্চমাধ্যমিক পড়াকালীন ব্রেকড্যান্সের চর্চা করতেন বিধায় পোশাক নিয়ে অনেক নেতিবাচক মন্তব্যের মুখোমুখি হতেন।
বর্তমানে পরিস্থিতি ভিন্ন হলেও অতীতে সৃষ্টির আত্মীয়স্বজনরা পোশাক সংক্রান্ত চর্চা থেকে বের হতে পারেনি। বিশেষ করে ক্ল্যাসিক্যালের নাচের সময় সৃষ্টি একরকমের পোশাক পরতো, আর এখন হিপহপের জন্য টিশার্ট পরতে হয় সেটিই মূল চর্চার বিষয় ছিলো তাদের মধ্যে।
হিপহপে যত অর্জন তাদের!
আন্ডাররেটেড বাংলাদেশের 'রাজধানী স্ট্রিট' গানটির দর্শকপ্রিয়তা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিলো যে, ২০২১ সালে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ (আইপিএল) এর দল রাজস্থান রয়েলসও এই গানটিকে ব্যবহার করে মুস্তাফিজুর রহমানকে নিয়ে একটি ভিডিও তৈরি করেন। এছাড়াও স্প্রাইট কোম্পানির বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেলে 'দিন ভারী, জীবন জারি' র্যাপের কৃতিত্বও তাদের। এছাড়াও সম্প্রতি তারা রুচির বিজ্ঞাপনের জন্য সঙ্গীতশিল্পী প্রীতম হাসানের সঙ্গে কাজ করেছেন।
তবে তাদের জীবনের অন্যতম বড় প্রাপ্তি আশেপাশের মানুষ থেকে সম্মান পাওয়া। দলের সদস্য আবির, তিনি বলেন, 'আমাদের প্রতিদিনই কোনো না কোনো মানুষ শুনছে, এটাই বড় পাওয়া।' খালেদের মতে, টাকা পয়সা ছাড়াও আশেপাশের মানুষ থেকে যে শ্রদ্ধা তারা অর্জন করছেন, সেটিই তাদের এগিয়ে যাওয়ার মূল পাথেয়।
এ আর রহমানের মিউজিক প্ল্যাটফর্ম 'মাজা' থেকে একটি র্যাপ গান করার সৌভাগ্যও হয় তাদের। কীভাবে এই সুযোগ পেয়েছেন জানতে চাইলে খালেদ জানান, '২০২১ সালের শেষে ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে চেন্নাইয়ের একজন প্রোডিউসারের সাথে আলাপ হয়। তিনি বিভিন্ন দেশের র্যাপারদের সাথে যুক্ত হয়ে একটি অ্যালবাম করেন। বাংলাদেশ থেকে আমরাই সেখানে ছিলাম। অ্যালবামের নাম ছিলো টাইমমেশিন; যেটি পরবর্তী সময়ে মাজা থেকে মুক্তি পায়।' এখন পর্যন্ত দেশে এই বিষয়টি নিয়ে সেভাবে সাড়া পেলেও অদূর ভবিষ্যতে পাবেন সেটাই কাম্য দলের।
দর্শকের মধ্যে হিপহপ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে কাজ করেছেন সাবিল ইমাদ। অধিক প্রচারণার মাধ্যমে ধীরে ধীরে দর্শকের নেতিবাচক মনোভাব বদলে যাবে বলে আশাবাদী ব্রেকড্যান্সার সাবিল ইমাদ। বর্তমানে রেঁনেসাস দলের সাথে যুক্ত আছেন তিনি। সাবিলের ইচ্ছা রেঁনেসাস দলের মধ্য দিয়ে নাচের মাধ্যমে ইতিবাচকভাবে এমন কিছু দেখানো যা মানুষ আগে দেখেনি। সমষ্টিগতভাবে নাচ নিয়ে মানুষের মধ্যে যে চিন্তাভাবনা আছে তা বদলে দেয়ার উদ্দেশ্যেই কাজ করছেন তিনি।
বাংলাদেশে হিপহপের জন্য যতো আয়োজন…
২০১৪ সালে মার্কিন দূতাবাস 'নেক্সট লেভেল বাংলাদেশ' নামে একটি প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। সেখানে তাদের উদ্দেশ্যই ছিলো হিপহপের বিভিন্ন উপাদানকে ছড়িয়ে দেওয়া। যার মধ্যে ডিজেইং, র্যাপিং, ব্রেকড্যান্সিং অন্তর্গত ছিলো।
২০২২ সালেই যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সম্পর্কের ৫০ বছর উপলক্ষ্যে মার্কিন দূতাবাস আয়োজিত ইয়েস একাডেমি থেকে বাংলাদেশের তরুণদের র্যাপ, ব্রেক ড্যান্স শেখানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিলো। সেখানে প্রশিক্ষণের কাজে অংশ নেন আমেরিকার পুরষ্কারবিজয়ী চারজন হিপহপ শিল্পী।
ইয়েস একাডেমি বাংলাদেশ আয়োজিত কর্মশালার নেতৃত্বে ছিলেন ডেঞ্জারফ্লো ব্যান্ডের সদস্য ও এমসি অ্যাঞ্জেল 'ওশান' আলভারাদো, পুরস্কার জয়ী হিপ হপ ডিজে কার্ল 'ডিজে ইনভিজিবল' হলিয়ার, আন্তর্জাতিক বি-বয় চ্যাম্পিয়ন অ্যানেক্স 'বি-বয় এল নিনো' ডিয়াজ এবং দুইবারের এনবিসি ফাইনালিস্ট 'দি সিং অফ' রিচি 'রোবট' স্টেইগনার।
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট এর এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল অ্যাফেয়ার্স এবং আমেরিকান ভয়েসেস এর অংশীদারিত্বে পরিচালিত কয়েকটি আর্টস এনভয় প্রোগ্রামের মধ্যে একটি হলো ইয়েস একাডেমি। ইয়েস একাডেমির লক্ষ্য হলো আমেরিকার কয়েকটি শ্রেষ্ঠতম সাংস্কৃতিক ঘরানার উপর বিশ্বজুড়ে তরুণদের প্রশিক্ষণ দেয়া। এই প্রশিক্ষণের পর অংশগ্রহণকৃত তরুণদের হাতে তুলে দেওয়া হয় সার্টিফিকেট।
২০২২ সালের আগস্ট মাসে 'আন্ডাররেটেড বাংলাদেশ' দল নিজেদের প্রথম কনসার্ট আয়োজন করে। এই কনসার্টের উদ্দেশ্য ছিলো হিপহপের যে উপাদানগুলো আছে সেগুলো দর্শকদের সাথে পরিচিত করানো। কনসার্টে র্যাপিংই মুখ্য ছিলো না, বরং বি-বয়, বি-গার্ল, বিটবক্সার, ডিজে সবকিছুরই ব্যবস্থা ছিলো। নিজেদের ও দুটি মিউজিক কোম্পানির সহযোগিতায় পুরো অনুষ্ঠানটি পরিচালিত হয়েছে।
তাদের অনুপ্রেরণায় আছেন যারা!
হিপহপের চর্চাকারী তরুণদের কাছে কাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন জানতে চাইলে আন্ডাররেটেড বাংলাদেশের উদ্যোক্তা খালেদ জানান, 'আমরা সবকিছু থেকেই অনুপ্রেরণা নেই। আমাদের এলাকায় একজন রিক্সাচালক আছেন, উনি যখন রিক্সা চালান, তখন চুল বেঁধে সানগ্লাস পরে খুব সুন্দর স্টাইলে চলেন। আমরা উনাকে দেখে শিখছি যে এমন একটা জায়গায় উনি নিজের ধরনে আত্মবিশ্বাসের সাথে চলছেন।'
একইভাবে সাবিল জানান বাংলাদেশের মধ্যে তার কাছে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন এনোনিমাস ক্রু আর দেশের বাইরে এল নিনো। সৃষ্টির কাছেও তার প্রথম অনুপ্রেরণা ওটু স্ট্রিট ড্যান্স ক্রু'র প্রশিক্ষক রাকিব।
হিপহপকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চান এই তরুণেরা। সকল নেতিবাচকতার ঊর্ধ্বে গিয়ে হিপহপকে সবার মননে প্রতিষ্ঠিত করতে চান তারা। অদূর ভবিষ্যতে নিজের দেশকে বিশ্বমঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করার ইচ্ছা তাদের। হিপহপ নিয়ে মানুষের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব প্রতিষ্ঠিত হবে এমনটাই আশা তাদের।