তারকারা কেন এআইয়ের ডিপফেইক প্রযুক্তি গ্রহণ করছেন?
সিঙ্গাপুরের অভিনেত্রী, মডেল ও সাবেক রেডিও ডিজে জ্যামি ইয়ো সম্প্রতি ফাইনান্সিয়াল টেকনোলজি ফার্ম হুগোসেভের সাথে একটি চুক্তি করেছেন। চুক্তি অনুযায়ী এ অভিনেত্রী এআইয়ের মাধ্যমে নিজের অবয়বের ডিপফেইক প্রযুক্তি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন। খবর বিবিসির।
একইসাথে আজ (বৃহস্পতিবার) নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেতে যাচ্ছে চার্লি ব্রুকারের নতুন সিরিজ। সিরিজটির প্রথম এপিসোডে এআইয়ের মাধ্যমে অভিনেত্রী সালমা হায়েকের ফিকশনাল ভার্সন ব্যবহার করা হয়েছে।
এক্ষেত্রে সালমা হায়েক নিজের ফিকশনার ভার্সন ব্যবহারের জন্য একটি প্রোডাকশন কোম্পানির সাথে চুক্তিও করেছেন। তবে এ চুক্তিটিকে অনেকেই হয়তো ভালো চোখে দেখছে না।
অন্যদিকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অভিনয়ের মতো সৃজনশীল পেশার জন্য একটি অস্তিত্বের হুমকির তৈরি করবে।
তবে অভিনেত্রী জ্যামি অবশ্য এআই নিয়ে শঙ্কিত নন। বরং বহু অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে তিনিও একজন যিনি কি-না এআই ব্যবহার করে তারকাদের ভার্চুয়ালি ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন তৈরির ব্যাপারটিতে সম্মতি দিয়েছেন।
এআই ব্যবহার করে তারকাদের ভার্চুয়ালি ব্যবহারের নতুন প্রযুক্তিটি একইসাথে উচ্ছ্বাস ও আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। নতুন এ প্রযুক্তি ব্যবহারও খুব বেশি জটিল নয়।
মূলত অভিনেত্রী জ্যামিকে এক্ষেত্রে কয়েক ঘণ্টা গ্রীন স্ক্রিনের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা ও গতিবিধি রেকর্ড করতে হয়েছে। তারপর তিনি স্টুডিওতে আরও কয়েক ঘণ্টা ভয়েস রেকর্ড করেছেন।
পরবর্তীতে এআই প্রোগ্রামের মাধ্যমে জ্যামির ধারণকৃত ছবি ও আডিওগুলোকে বিশ্লেষণ করে ডিজিটাল রূপ প্রদান করা হয়। ফলে এখন সেই ডিজিটাল ভার্সন কোম্পানিটি নিজেদের পছন্দমতো ব্যবহার করতে পারবে।
এ বিষয়ে অভিনেত্রী জ্যামি বলেন, "আমি ডিপফেইক প্রযুক্তি নিয়ে আতঙ্কের বিষয়টাও বুঝতে পারছি। কিন্তু প্রযুক্তিটি মিডিয়ায় অবশ্যই ব্যবহৃত হবে। তাই আপনি নিজে যদি আতঙ্কিত হয়ে এটি বর্জন করেন, তবে অন্য কেউ না কেউ সেটিকে গ্রহণ করে ব্যবহার করবেই।"
অভিনেত্রী জ্যামির কথাই যেন সত্য হচ্ছে। পেপসিকোর সাথে চুক্তি অনুযায়ী ফুটবল তারকা লিওনেল মেসি নিজেও ডিপফেইক ভার্সন ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন।
এমনকি এআইয়ের কল্যাণে অনলাইন ব্যবহারকারীরা লিওনেল মেসির কৃত্রিম ভিডিও তৈরি করতে পারবেন। একইসাথে বিশ্বকাপজয়ী এ তারকা ইংলিশ, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ ইত্যাদি ভাষায় কথা বলছে, এমনটাও তৈরি করা সম্ভব।
একইসাথে ফুটবল তারকা ডেভিড বেখহ্যাম কিংবা হলিউড কিংবদন্তি ব্রুস উইলসও ডিপফেইক প্রযুক্তি গ্রহণ করেছেন। তবে অভিনেত্রী জ্যামির মতো পুরো ইমেজ সত্ত্ব বিক্রির মতো চুক্তি তারা করেননি।
কিংস কলেজ লন্ডনের মার্কেটিং এক্সপার্ট কার্ক প্লাঙ্গার বলেন, "আমি মনে করি যে, ডিপফেইক প্রযুক্তি আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বিজ্ঞাপন ইন্ডাস্ট্রি জগতে একটি সাধারণ প্রাকটিস হিসেবে চালু হবে। এটি সব ধরণের সৃজনশীল কাজে বিকল্পের দ্বার খুলে দেবে। এমনকি এটি ব্যবহার করে মাইক্রো-টার্গেট ভোক্তাদের কাছে পৌছানোও সম্ভব হবে।"
বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকেও ডিপফেইক প্রযুক্তি বেশ কার্যকরী বলে মনে হওয়ায় কোম্পানিগুলো আরও আকর্ষিত হচ্ছে। এ বিষয়ে প্লাঙ্গার বলেন, "তারকাদের ক্ষেত্রে তারা যে টাকা পাচ্ছেন, সে তুলনায় তাদেরকে কষ্ট করতে হচ্ছে না। আবার ক্লায়েন্টের বাজেটের ক্ষেত্রেও এটা সাশ্রয়ী। কেননা একটি নরম্যাল শুট থেকেই অনেক ধরণের কন্টেন্ট তৈরি করা যায়। তাই এটা সবার জন্যই সুবিধাজনক।"
ডিপফেইক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধার বিষয়টি সিঙ্গাপুরভিত্তিক টেকনোলজি ফার্ম হুগোসেভ তুলে ধরেছেন। এ সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটির সিইও ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা ব্রাহাম জিদজেলি বলেন, "প্রযুক্তিটি ব্যবহার করার মানে হচ্ছে আমরা সত্যিকার অর্থেই কয়েক দিনের মধ্যে শত শত ভিডিও তৈরি করতে পারবো। প্রথাগত পদ্ধতিতে সেটি চিত্রায়ন করতে যেখানে কয়েক বছর বছর কিংবা কয়েক মাস সময় লেগে যাবে।"
তবে বিশ্লেষক প্লাঙ্গার অবশ্য ডিপফেইক প্রযুক্তিটির 'ডার্ক সাইড' থাকার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, "প্রযুক্তিটি কিন্তু এমন নয় যে আমরা চাইলেই ফের সরে আসতে পারবো। তাই বিজ্ঞাপন ইন্ডাস্ট্রিকে এআইয়ের ঝুঁকি ও সম্ভবনার বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। এর মানে হচ্ছে, সামাজিকভাবে একটু পেছনে ফিরে প্রযুক্তিটির যথাযথ ও নৈতিক ব্যবহারের বিষয়টি ভাবতে হবে।"
বিশ্লেষক প্লাঙ্গার 'বিশ্বাসের সংকট' তৈরির বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কেননা প্রযুক্তিটি লাগামহীন ব্যবহারে কোনটা আসল আর কোনটা নকল ভোক্তা সেটিই বুঝতে পারবে না। এছাড়াও অনলাইনে পর্ণোগ্রাফি থেকে শুরু করে ভুল তথ্যের প্রচারে ইতোমধ্যেই প্রযুক্তিটি ব্যবহার করা হচ্ছে।
অন্যদিকে যেসব তারকা স্বেচ্ছায় ডিপফেইক ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে চুক্তি করছে, তাদের ক্ষেত্রেও ঝুঁকি রয়েছে। কেননা বর্তমানে এআই সম্পর্কিত পরিষ্কার কোনো আইন নেই যেখানে একজন ব্যক্তির ইমেজকে যথাযথভাবে সুরক্ষিত রাখার নিশ্চয়তা দিতে পারবে।
এ সম্পর্কে ইনটেলেকচুয়াল প্রোপার্টি আইনজীবী শেং রং বলেন, "এআই এবং ডিপফেক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমরা অনেকটা অজ্ঞাত অবস্থায় রয়েছি। এগুলো ঘিরে বহু ইস্যু তৈরি হতে পারে। যেমন, ইনটেলেকচুয়াল প্রোপার্টির মালিক কে? আপনি এ সম্পর্কিত আইনি আশ্রয়ের জন্য কার কাছে যাবেন? বাস্তবতা হচ্ছে, বিদ্যমান আইনে এই সমস্যাগুলি প্রতিরোধে শক্তিশালী কোনো নিয়ন্ত্রক কাঠামো প্রদান করতে পারে না।"