সামরিক প্রশিক্ষণে বিটিএস: কে-পপের সবচেয়ে বিখ্যাত তারকাদের ভবিষ্যৎ কী?
জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা অবস্থায় ইতিহাসের বিখ্যাত ব্যান্ড বিটলসের সদস্যদের যদি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হতো, তবে বিষয়টা কেমন হতো! ঠিক এমনটাই ঘটছে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় পপ ব্যান্ড বিটিএসের ক্ষেত্রে। খবর বিবিসির।
আগেই বিটিএসের বাকি ছয় সদস্য প্রশিক্ষণের জন্য সেনাবাহিনীটিতে যোগ দিয়েছিলেন। গত মঙ্গলবার শেষ সদস্য হিসেবে মূল ভোকালিস্ট জাং কুকও হেঁটেছেন একই পথে। কেননা দক্ষিণ কোরিয়ায় শারীরিকভাবে সক্ষম ১৮ থেকে ২৮ বছর বয়সী সকল পুরুষকেই বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হয়।
অথচ মাত্র চার সপ্তাহ আগেও জাং কুক ছিলেন ক্যারিয়ারের অনন্য উচ্চতায়। 'টুনাইট শো' এর হোস্ট জিমি ফ্যালনকে তিনি মাইকেল জ্যাকসনের গান গেয়ে ও নেচে দেখিয়েছেন। পরের রাতে তিনি একটি পাবলিক কনসার্টে পারফর্ম করেছেন।
গত কয়েক সপ্তাহজুড়ে জাং কুকের প্রথম অ্যালবাম 'গোল্ডেন' বেশ কয়েকটি চার্টের শীর্ষে অবস্থান করেছে। একইসাথে তুমুল জনপ্রিয়তা পাওয়া গান 'স্ট্যান্ডিং নেক্সট টু ইউ' তে তার একক নাচ টিকটকে ট্রেন্ড হিসেবে দেখা দিয়েছে।
কিন্তু জাং কুক যখন স্টারডমের সর্বোচ্চ উচ্চতায় যাচ্ছিলেন তখনই তাকে সবকিছু থামিয়ে দিতে হলো। বরং সিউলে ফিরে এসে সবকিছু থেকে বিরতি নিয়ে চলে গেলেন সেনাবাহিনীতে।
কিছুদিন আগেই জাং কুক বিটিএসের অন্য তিনজন সদস্যকে সাথে নিয়ে একটি পিৎজা পার্টির লাইভস্ট্রিম করেছিলেন। যেখানে তারা ভক্তদের জানান, ঐ তিনজনকে সামরিক দায়িত্ব পালনের জন্য যেতে হবে।
দক্ষিণ কোরিয়া এখনো কৌশলগত দিক থেকে প্রতিবেশী দেশ উত্তর কোরিয়ার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। তাই দেশটির বেশিরভাগ পুরুষকেই সেনাবাহিনীতে ১৮ মাসের বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ নিতে হয়।
বিটিএস বিশ্বজুড়ে দক্ষিণ কোরিয়াকে সংস্কৃতিগতভাবে তুমুলভাবে জনপ্রিয় করে তুলছে। সেক্ষেত্রে তাদেরও মিউজিক বাদ দিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণে বাধ্য করার প্রয়োজন আছে কি-না, সেটা নিয়ে রয়েছে বেশ বিতর্ক!
উত্তর কোরিয়ায় অবশ্য অলিম্পিক পদক বিজয়ী এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীতজ্ঞদের সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষণের ব্যাপারে ছাড় দেওয়ার ইতিহাস রয়েছে। এমনকি ২০২০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার পার্লামেন্ট বিটিএস সদস্যদের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের সময়সীমাও ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত বাড়িয়ে একটি একটি বিল পাস করেছে।
তৎকালীন সময়ে ব্যান্ডটির পক্ষে অবশ্য সরকারের উচ্চপদস্ত মন্ত্রী থেকে শুরু করে ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই দাঁড়িয়েছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল যে, কোরিয়ার সবচেয়ে বড় এই পপ তারকারা ইতিমধ্যেই বিলিয়ন ডলার উপার্জন করে তাদের দেশের উপকারে আসছেন। তাই তাদের সামরিক প্রশিক্ষণে না পাঠিয়ে বরং তারকা হিসেবেই ভূমিকা পালন করতে দেওয়া উচিত।
তবে গত অক্টোবরে বিটিএসের এজেন্সি বিগহিট মিউজিকের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এইচওয়াইবিই এর পক্ষ থেকে বলা হয়, ব্যান্ডটির সকল সদস্যকেই নিয়ম মেনে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হবে।
তাই ব্যান্ডটি প্রশিক্ষণ চলাকালীন একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিজেদের কার্যক্রম বন্ধ রাখবে। তবে তাদের নিজস্ব প্রকল্পগুলি শেষ করার জন্য সময় দেওয়া হয়েছে।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ও কে-পপ বিশেষজ্ঞ গ্রেস কাও বলেন, "পশ্চিমা শ্রোতাদের জন্য হয়তো এটি বেশ নিষ্ঠুর বলে মনে হয় যে, সাফল্যের শীর্ষে থাকা তারকাদের এখন বিরতি নিতে হবে। তবে সেটা কারও পছন্দ হোক বা না হোক; তাদের বাধ্যতামূলক বিরতি নিতেই হবে।"
গ্রেস কাও জানান, দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকদের জন্য এটাই বাস্তবতা। বিটিএস সেখানে অন্য কে-পপ আইডল ও কে-ড্রামা তারকাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে। যারা কি-না সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য বিরতি নিয়েছে।
বিটিএসের তারকারা যে সামরিক প্রশিক্ষণে যাচ্ছেন, সেটা বহু আগেই নিশ্চিত হয়েছিল। তবুও বিশ্বব্যাপী থাকা ব্যান্ডটির ভক্তরা শেষ মুহূর্তে যেন নিজেদের আবেগ ধরে রাখতে পারছে না।
চলতি সপ্তাহে বিটিএসকে ঘিরে ভক্তরা নানা আবেগপ্রবণ বার্তা লিখেছেন। গত সোম ও মঙ্গলবার ব্যান্ডটির বাকি চার সদস্য আরএম, ভি, জিমিন এবং জংকুকের ক্যাম্পে যাওয়ার ক্লিপে মন্তব্যের ঘরে কান্নার ইমোজি দিয়েছে অনুরাগীরা।
টিকটকে এক ভক্ত লিখেন, "একযোগে সবাই চলে গেল। আমি হৃদয়ে ব্যাথা অনুভব করছি। আমি এটা মানতে পারছি না। আমি তাদের খুব মিস করছি।"
ব্যান্ডটির ভক্তরা নিজেদের 'বিটিএস আর্মি' বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিল্পীদের ফ্যানবেসগুলোর মধ্যে এটি সোশ্যাল মিডিয়ায় সবচেয়ে বেশি জানান দিয়ে থাকে।
এ বিষয়ে মালয়েশিয়াভিত্তিক কে-পপ একাডেমিক জিমিন পারচ বিবিসিকে জানান, এর ফলে হয়তো অনেক ভক্তই মানসিকভাবে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়বে।
গত সোম ও মঙ্গলবার ছয় বছর আগের ব্যান্ডটির অপেক্ষাকৃত কম জনপ্রিয় একটি গান 'স্প্রিং ডে' হঠাৎ করে ইউএস আইটিউনস চার্টের শীর্ষে উঠে আসে।
এই প্রসঙ্গে রেডিটে ব্যান্ডটির ৬ লাখ ১০ হাজার সদস্যসমৃদ্ধ সাব-ফোরামে বলেন, "বিটিএস সদস্যদের অনুপস্থিতিতে ভক্তরা ব্যান্ডটির গানগুলি শুনছে। আমি সবসময় ভক্তদের এই ভালোবাসাকে প্রশংসা করেছি।"
বিটিএসের ভক্তরা সবসময়ই নিজেদের একনিষ্ঠতার প্রমাণ রেখে এসেছেন। তাই মাঝে বিরতি নিলেও ব্যান্ডটি নিজেদের সুনাম ধরে রাখতে পারবে বলে আশা ইন্ডাস্ট্রিটির সাথে যুক্ত বিশ্লেষকদের।
এ সম্পর্কে কে-পপ কলামিস্ট ও বিলবোর্ড ম্যাগাজিনের লেখক জেফ বেঞ্জামিন বলেন, "সাধারণভাবে আপনি বিশ্বের যেখানেই থাকুন না কেন, যদি একটি মিউজিক্যাল গ্রুপ বিরতি নেয় তবে সেটি তাদের জনপ্রিয়তাকে প্রভাবিত করে। কিন্তু আমি বলতে চাই, কোন গোষ্ঠী যদি সেই ধারা থেকে বের হয়ে আসতে পারে তবে তা হবে বিটিএস।"
এক্ষেত্রে বিটিএসের কন্টেন্ট ম্যানেজম্যান্টে কৌশল বেশকিছু আয়ত্ত করতে হবে। তিনি বলেন, "সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণে যোগদানের আগে গান, ভিডিও, ফটোশুট, ফ্যান বার্তাসহ আরও অনেক কিছু প্রস্তুত করা হয়েছে। এই জিনিসগুলিই সদস্যদের অনুপস্থিতিতে ব্যান্ডটির জনপ্রিয়তাকে ধরে রাখবে।
অন্যদিকে বিটিএসের অনুপস্থিতিতে অন্য কে-পপ ব্র্যান্ডগুলো নিজেদের মেলে ধরার অনন্য সুযোগ পাবে। এরমধ্যে 'নিউ জিনস' এর মতো কিছু কিছু ব্র্যান্ড ইতিমধ্যেই পশ্চিমা মূলধারার চার্টে জায়গা করে নিচ্ছে।
সহযোগী অধ্যাপক পারস বলেন, "বিটিএসকে মিডিয়া আউটলেটগুলোতে বেশ ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল। সাময়িক এই বিরতি অন্য কে-পপ ব্র্যান্ডগুলোকে লাইমলাইটে আনতে সহায়ক হবে। এটি শিল্পের জন্য একটি 'উইন-উইন' পরিস্থিতি।"